স্বৈরতন্ত্রীর ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে শুধুমাত্র কর্তৃত্ববাদী চরিত্র নয়, গণতন্ত্রের নামাবলি জড়িয়েও এক ভয়ংকর দুঃশাসন আমজনতার উপর চাপিয়ে দেওয়া সম্ভব। ‘ভি-ডেম ইনস্টিটিউট’-এর সাম্প্রতিকতম রিপোর্ট ভারত সম্পর্কে সে কথাই বলছে। মার্চ মাসের সর্বশেষ রিপোর্ট অনুসারে, পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ স্বৈরতন্ত্রর ‘মডেল’– ভারত। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল।
সুইডেনের গোথেনবার্গের বিশ্বখ্যাত ‘ভি-ডেম ইনস্টিটিউট’ প্রতি বছর মার্চ মাসে পৃথিবীর নানা দেশের গণতন্ত্র নিয়ে গবেষণাভিত্তিক একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। এবার মার্চ মাসের সর্বশেষ রিপোর্ট অনুসারে, পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ স্বৈরতন্ত্রের ‘মডেল’ ভারত।
‘ভি-ডেম’ শব্দটির অর্থ, ‘ভ্যারাইটিজ অফ ডেমোক্রেসি’। সংস্থাটি ১৬৯টি দেশের উপর সমীক্ষা চালিয়েছিল। অধুনা এই প্রতিষ্ঠানটির গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে গবেষণা খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এবারের রিপোর্টে বলা হচ্ছে, অনেক ছোট ছোট দেশ ধীরে ধীরে স্বৈরতন্ত্র বদলে গণতন্ত্রকে বিকশিত করছে– যেমন তিউনিসিয়া, ফিজি, আর্মেনিয়া এমনকী শ্রীলঙ্কা। অন্যদিকে ‘জি২০’ গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলোর মধে্য আমেরিকা, তুরস্ক, ব্রাজিল ও ভারতের মতো দেশে ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’ তৈরি হয়েছে। ভারতেও শাসক দল নির্বাচিত, তা সত্ত্বেও দেশে গণতন্ত্রর বদলে স্বৈরতন্ত্র ছড়িয়ে পড়ছে।
২০১৮ সালে প্রথম ভি-ডেম ইনস্টিটিউট ভারতে মোদি সরকারকে ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’ নামে অভিহিত করে। তারপর প্রতি বছর ভারতীয় গণতন্ত্রর হালের মডেলকে গণতন্ত্র নয়, স্বৈরতন্ত্রই বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে। মোদির নেতৃত্বে হালের ভারতকে ‘শক্তিশালী মহান গণতান্ত্রিক’ রাষ্ট্র বলে তুলে ধরার যে প্রয়াস বিজেপি এবং সংঘ পরিবার করছে, তাকে এ পৃথিবীর বহু রাজনৈতিক দার্শনিক মানতে রাজি নন। তবে মোদিপন্থী বহু দক্ষিণপন্থী ভারততত্ত্ববিদ এই রিপোর্টের সমালোচনাও করছেন। তঁারা বলছেন, কর্তৃত্ব ও স্বাধীনতার মধে্য চিরকালই এ দুনিয়ায় টেনশন ও সংঘাত ছিল। বরং মানুষ যখন ভোটে কোনও জনপ্রিয় ব্যক্তি-নেতাকে পছন্দ করে বেছে নেয়, তখন গণতন্ত্রের নামে নৈরাজ্য ডেকে আনতে দেওয়া যায় না। সংখ্যালঘু তোষণের নামে সংখ্যাগরিষ্ঠর স্বাধীনতাকে খর্ব করে দেওয়া গণতন্ত্র নয়।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা ইরিকা বেনার মনে করছেন, পৃথিবীর বহু রাষ্ট্র ছদ্মবেশে
চুপি চুপি আমজনতাকে বুঝতে না-দিয়ে গণতন্ত্র থেকে স্বৈরতন্ত্রে পৌঁছে যাচ্ছে। প্রথমে শাসক দলের এই প্রক্রিয়াটা বোঝা-ই যাচ্ছে না, কয়েক দশক পর মানুষ বুঝতে পারছে– কিন্তু তত দিনে মানুষ রাজনৈতিক স্বাধীনতার পরিসরটুকু হারিয়েছে।
ইরিকা বেনারের জন্ম জাপানে। পড়াশোনা করলেন লন্ডনে। লন্ডন ছাড়াও জার্মানি, হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ডে থেকেছেন। লন্ডনে অক্সফোর্ডের সেন্ট অ্যান্টনি কলেজে শিক্ষকতা ছাড়াও তিনি লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্স ও ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষকতা করেন। ’৯৩ সালে সাম্প্রতিক গণতন্ত্র নিয়েই অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি-ফিল করেন।
৬১ বছর বয়সের এই বিদূষি লেখিকা বলছেন– জাপানে জন্ম নিয়েছি। ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি ‘গণতন্ত্র’ আর ‘স্বৈরতন্ত্র’ বিপরীতার্থক। গণতন্ত্রর মানে বহু মানুষের শাসন। স্বৈরতন্ত্র মানেই এক ব্যক্তি বা এক দলের নিয়ন্ত্রিত শাসন। ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’-র সময় আমার বয়স খুবই কম– তখনও বলা হত– গণতন্ত্রর নৈতিক শত্রু হল স্বৈরতন্ত্র। ছাত্রজীবনেও জেনেছি আমেরিকা ও ইউরোপের পশ্চিম প্রান্তে গণতন্ত্র বিরাজমান আর জাপানের প্রতিবেশী বহু রাষ্ট্রে স্বৈরতন্ত্র। আবার চিন, সোভিয়েত ইউনিয়ন, উত্তর কোরিয়া সর্বত্রই স্বৈরতন্ত্রর দাপট। জাপানে জন্মে আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি।
ইরিকা বেনার সম্প্রতি বলছেন, সেদিন শৈশবে আমাদের জানানো হয়নি, জাপানের মতো রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো যতই সুষ্ঠু হোক, জীবনধারা যতই গণতান্ত্রিক হোক, সেই ব্যবস্থার মধে্যও স্বৈরতান্ত্রিক সংবেদ ছিল– যা গণতন্ত্রকে একদিন ধ্বংস করে দিতে পারে। শুধু পুরনো স্টাইলে কোনও স্বৈরতন্ত্রীর ক্ষমতা দখল (যাকে লেখিকা বলছেন ‘প্যাথোলজিকাল’) কর্তৃত্ববাদী চরিত্র নয়, গণতন্ত্রের নামাবলি জড়িয়েও এক ভয়ংকর স্বৈরতন্ত্রী দুঃশাসন আমজনতার উপর চাপিয়ে দেওয়া সম্ভব। ভি-ডেম ইনস্টিটিউটের সাম্প্রতিকতম রিপোর্ট ভারত সম্পর্কে সে-কথাই বলছে।
এরিকা বেনার তঁার ‘অ্যাডভেঞ্চারস ইন ডেমোক্রেসি দ্য টারবিউলেন্ট ওয়ার্ল্ড অফ পিপল পাওয়ার’ বইয়ে দেখিয়েছেন– ভোটে জিতে গণতান্ত্রিক ক্ষমতা অর্জন করে কীভাবে অগণতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্রী হয়ে ওঠা সম্ভব। তিনি এ ব্যাপারে বেশ কিছু সহজ পথ দেখিয়েছেন। কীভাবে মানুষকে বুঝতে না দিয়েও ধীরে ধীরে একনায়কতন্ত্রী হয়ে ওঠা সম্ভব। ওঁর নিজের ভাষায়, ‘হোয়েন ইজ আ ডেমোক্রেসি নো লংগার ডেমোক্র্যাটিক?’
লেখিকা বলছেন– প্রথমত, ক্ষমতায় এসেই এহেন শাসকেরা অভিবাসনের বিষয়ে সোচ্চার হয় এই মর্মে যে, জাতিগত-ধর্মগত-সম্প্রদায়গত সংখ্যালঘুর বিরোধিতা করতে হবে। অনুপ্রবেশকারী, উদ্বাস্তু-অভিবাসনকারীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। এবং তা করতে হবে জাতীয় স্বার্থে।
এভাবেই একজন ‘সম্মিলিত দানব’ থেকে তৈরি হয় রাষ্ট্রনেতা। যে-দানবের সঙ্গে যেন আপামর
মানুষের লড়াই।
দ্বিতীয়ত, নির্বাচন কেন্দ্রে ভোটারদের পুনর্মূল্যায়ন। অর্থাৎ, নির্বাচনী ডিলিমিটেশন।
প্রতিটি তৃণমূল স্তরে নিজের দলের সমর্থকদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নির্বাচন কেন্দ্রে নিশ্চিত করা। যারা সমর্থন করে না– সেই ভোটারদের ভোটের বুথ থেকে কীভাবে দূরে সরিয়ে দেওয়া সম্ভব, তা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই সুনিশ্চিত করা হয়।
তৃতীয়ত, স্কুল তারপর কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস ও পাঠ্যগ্রন্থে সংস্কার সাধনের নামে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণকে প্রতিষ্ঠা করা। দেশের অতীতে ইতিহাসের ক্ষত, লজ্জাকে জাগানো ও তা পরিবর্তনের আশা জাগানো। দায়িত্ব নেওয়া।
চতুর্থত, দ্রুত মিডিয়ার উপর নিয়ন্ত্রণ বাড়ানো। লেখিকা বলছেন, এটা খুব সাবধানে করতে হয়। কারণ, যে প্রধান শাসক, সে দেখাতে চায়, সে মানুষকে ম্যানিপিউলেট করতে চায় না। যে চ্যাম্পিয়ন, সে কেন মিডিয়াকে তৈলমর্দন করবে? বরং এই ধারণা তৈরি করতে হবে, সে মিডিয়াকে পরোয়া করে না। কিন্তু দেখা গিয়েছে তারাই টাকার বিনিময়ে বন্ধুদের দিয়ে মিডিয়া হাউস কেনায়।
পঞ্চমত, মানুষকে যখন এভাবে কেউ অনেকটাই পাশে পেয়ে যাবে তখন বিচারপতিদের কাছে যাওয়ার পালা। যারা বেশি আইনের পথে গিয়ে ঝামেলা করছে বা করতে পারে, তাদের সরিয়ে দেওয়া। সুপ্রিম কোর্ট,
হাই কোর্ট ও নিম্ন আদালতে নিজের লোকেদের বসানো, যাতে প্রশাসনকে বল জোগায় বিচারবিভাগ। বিচারপতিরাও যখন দেখবেন প্রশাসন ‘বন্ধু’ হলে ভাল পোস্টিং, এমনকী, রাজনৈতিক সুবিধাপ র্যন্ত যাওয়া সম্ভব– তখন বিদ্রোহীদের সংখ্যা আরও কমবে। এটাই হল, হব্স এবং ম্যাকিয়াভেলির মানব-মনস্তত্ব সম্পর্কে উপলব্ধি।
ষষ্ঠত, মানুষের সামনে সর্বদাই এই বার্তা দিতে হবে, ভগবান তার সঙ্গে আছে। ‘God on your side’ তত্ত্ব। ব্যাপকভাবে ঘোষণা করতে হবে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে এ হল ধর্মযুদ্ধ। পবিত্র ভোট-লড়াই। ‘হোলি ফাইট’।
সপ্তমত, বলতে হবে দেশ ও জাতি আক্রান্ত। শত্রুরা আক্রমণ হানছে। রাস্তায় মানুষের প্রতিবাদকে দাগিয়ে দিতে হবে শত্রুর ষড়যন্ত্র বলে– কারণ রামরাজ্যর সম্ভাবনাকে শত্রুরা খতম করতে চাইছে। ভোটে হেরে গেলেও বলতে হবে, শত্রুরা আইন ভেঙে নৈরাজ্য আনছে। এরিকা বেনার উপসংহারে বলছেন, এই কাজগুলো করে ফেলতে পারলেই নিঃশব্দে গণতন্ত্র থেকে স্বৈরতন্ত্রে পৌঁছে যাওয়া নিশ্চিত। এই রূপান্তর সফল। শুধু নতুন নাম ‘স্বৈরতন্ত্র’ ব্যবহার করা যাবে না, পুরনো নাম ‘গণতন্ত্রই’ ব্যবহার করে যেতে হবে।
ভারতে মোদি-ভক্তরা এই নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্রী মডেলের সমালোচনায় মুখর। তারা বলছে, অসহিষ্ণুতা মানেই স্বৈরতন্ত্র বলে শাসক সব ব্যাপারে সব বেয়াদপি সহ্য করে যাবে– সেটাই গণতন্ত্র? এই তত্ত্ব ভুল। ডেনমার্কে ইসলাম গুরুকে নিয়ে কার্টুন অঁাকা হয়। তাই ইসলামিক উগ্রপন্থীরা কোপেনহেগেনে বিদ্রোহ করে। সরকার আইন করে যে, কোনও ধর্ম বা ধর্মগ্রন্থে আঘাত দেওয়া চলবে না। এ ধরনের কার্টুনে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। সংঘ পরিবারের বক্তব্য, ভারতে ‘মনুসংহিতা’ পুড়িয়ে দিলেও আমরা চুপ করে থাকি। কারণ, আমরা সহিষ্ণু হিন্দু। এটা গণতন্ত্রের প্রকৃত সূচক নয়। তাই গণতন্ত্রর নামে নৈরাজ্য নয়, গণতন্ত্রের জন্য এক-নেতার শাসনও থাকা প্রয়োজন।
১৪০ কোটি মানুষের দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য এই স্বৈরতন্ত্রই এক ভয়াবহ দর্শন। মানুষ এইভাবে স্বৈরতন্ত্রী ‘কাল্ট’-কে ভোট দেয়, আর ধীরে ধীরে আমাদের অজান্তে কখন গণতন্ত্রর মৃতু্য হয়, আমরা জানতেও পারি না।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.