শ্রীজাত: অঝোর বৃষ্টির রাত জেগে কাটানোর কোনও দরকার কি ছিল তাঁর? দরকার ছিল কি, দফায়-দফায় বৈঠক করে পরিকল্পনা শানিয়ে নেওয়ার? এলাকাভিত্তিক খবরাখবর নিয়ে নিজে হাতে ব্যবস্থা গড়ে তোলার কোনও দরকার তাঁর সত্যিই ছিল কি? না কি আদৌ দরকার ছিল, কীভাবে প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবকরা দ্রুত ত্রাণের কাজে ফিরতে পারেন, তা খতিয়ে দেখার? আর এই দুর্যোগের মুখে, ভেসে যাওয়ার মতো কিনারায় থাকা মানুষজনকে কীভাবে আগাম সরিয়ে নেওয়া যায়, নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তার ছক কষারও কোনও দরকার সত্যিই কি ছিল? আমাদের দেশের রাজনীতিগত পরিকাঠামোয় এর সহজ উত্তর, না। ছিল না। কোনও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বা সুপ্রিমো থাকাকালীন, এ-সমস্ত কাজ কেবল নির্দেশ দিয়েই করিয়ে নেওয়া যায়, আর তাতেও কারও কোনও অভিযোগ করার থাকে না। মোদ্দাকথা, কাজের কাজটা হলেই হল।
তবু তিনি, আমাদের মুখ্যমন্ত্রী, নিজে কেন উপস্থিত থাকতে গেলেন সবটা জুড়ে? কেন দৌড়ে গেলেন এ-মাথা ও-মাথা, কেন কাপের পর কাপ চা নিঃশেষিত করে রাতভর বসে থাকলেন কন্ট্রোল রুমে? কিছু প্রমাণ করার জন্য কি? ভোটের আগে হলে সে-তত্ত্ব নয় খাড়া করাও যেত। সামনে নির্বাচন, মানুষের মন জয় করলে তবেই ইভিএমে তার ছাপ পড়বে, ভাবমূর্তি পরিচ্ছন্ন রাখা, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু মাসখানেকও হয়নি ভোট হয়ে গিয়েছে এবং তিনি যে-দলের নেত্রী, সে-দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে এ-রাজ্যে ফের শাসনে এসেছে। এরকম সময়ে আমাদের মতো দেশে সুপ্রিমো হয়ে ঘুমিয়ে নেওয়াই যায়। ফোন তুলে কয়েকখানা নির্দেশ জারি করে নিশ্চিন্ত থাকাই যায়। তাতে কেউ শাপশাপান্ত করে না। কিন্তু তা-ও যে তিনি সারাক্ষণ নিজে পাশে থাকছেন সকলের, নিজে খতিয়ে দেখছেন সমস্তটা, নিজে দায় নিচ্ছেন সবকিছুর, তার কারণ আলাদা।
প্রথমেই লিখেছিলাম, দরকার আছে কি না। তাহলে এবার বলি, দরকার আদতে নেই। এবং এ-জিনিস কেউ দরকার থেকে করতে পারেও না। দরকার থেকে মানুষ ভোট চায়। দরকার থেকে মানুষ বক্তৃতা দেয়। দরকার থেকে মানুষ রাস্তা সারাই করে দেয়। কিন্তু দরকার থেকে কেউ রাত জাগে না। বিশেষত, ভোটের সেই ‘দরকার’ নির্বিঘ্নে মিটে গেলে। এই রাতজাগাটুকু ভালবাসা থেকে আসে, এই পাশে দাঁড়ানোটুকু মমত্ব ছাড়া আসে না। নিজের নামের প্রতি তাই অবিচার তিনি করেননি, এ-কথা বলাই যায়। বাড়িতে কেউ অসুস্থ হলে উদ্বিগ্ন অভিভাবক যেমন রাত জাগেন, শিয়রে এসে বারবার দাঁড়িয়ে দেখে যান, এ-ও তেমনই। নাহ্, কোনও বাড়তি আবেগ থেকে আগের বাক্যটি লেখা নয়। কেননা, রাজ্য আবেগে চলে না, চলে ব্যবস্থাপনায়। সেটুকু এই ঝড়-জলের বেলায় সরকারি তরফে করাই হচ্ছে, দৃশ্যমান তা। তার বাইরে এই যে ব্যক্তি-উপস্থিতির সংযোজন, সেটিই রাজনীতির চেয়ে বড়। সেইটে মানবিক মুখ। এবং আজকের দিনে, ওটুকুই ভরসা।
যদিও কাজটা সহজ ছিল না মোটেই। পুনর্বার রাজ্যের ভার হাতে পেলেন যে-সময়ে, তার চেয়ে ঘোর দুর্দিন আর আসেনি। তাই নাটকীয় জয়ের পরপরই যুদ্ধকালীন তৎপরতায় ঝাঁপিয়ে পড়া। কোভিড পরিস্থিতির বাড়বাড়ন্ত তো ছিলই, তার মোকাবিলায় এঁটে উঠতে না উঠতেই ‘যশ’-এর (মতান্তরে ‘ইয়াস’) (Cyclone Yaas) আছড়ে পড়া। সর্বার্থে বিপন্ন, আক্রান্ত একটা রাজ্যের হাত ধরে টেনে তোলার মরিয়া চেষ্টায় কেটে গেল তাঁর এই ক’টা দিন। এবং সামনের দিনগুলোও কোনও মসৃণতার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে না। অতীতেও ছিল না অবশ্য সেসব প্রতিশ্রুতি। এবং সেই প্রতিটি ক্ষেত্রে, সব ব্যবস্থাপনা ও বিপর্যয় মোকাবিলায় তাঁর সশরীর উপস্থিতির কথা আমরা মনে রাখব। মনে রাখব, দলনেত্রীর পোশাকের বাইরেও সামগ্রিক দায়ভার নেওয়ার একটা ছবির কথা, যা তিনি তৈরি করতে পেরেছেন সফলভাবে। সাধারণ মানুষ এটুকুই চায়। আছে। কেউ একজন আছে। আসবে। সে নিশ্চয়ই আসবে। ব্যস।
ভোটের ঠিক আগে, মানুষের জন্য কাজ করতে না-পারায় যাঁদের দম খুব বন্ধ হয়ে আসছিল, কোভিড ও সাইক্লোন হাতে হাত মিলিয়ে তাঁদের সেই কাজের সুযোগ করে দিয়েছে। কিন্তু তাঁরা কেউ এই দুর্যোগে সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করলেন কি না, সে-হিসাব মানুষ রাখবে। কেবল বলি, পৃথিবী অনেক স্বার্থপরতার শাস্তি দিচ্ছে আমাদের। এখনও সময় আছে, আরও আরও সৈনিক তৈরি হোক, মানুষের জন্য। চারপাশের কিছু ছবি অবশ্য আশ্বাস জোগাচ্ছে যে, সবটা ফুরিয়ে যায়নি। দলের বাইরে, রঙের বাইরে সকলকে নিয়ে চলার একটা পরিসর যে তৈরি হচ্ছে এই বিপদের দিনে, সেটাই আনন্দের, সেটাই প্রত্যাশার। তবে কেবল একজন নয়, দু’জন নয়, দশজন নয়, সময় থাকতে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো সেনানী তৈরি হোক। এবং সময় বেশি নেই।
শেষে বলি, ‘দখল করা’ আর ‘আগলে রাখা’ এক নয়। ‘কর্তৃত্ব’ আর ‘অভিভাবকত্ব’ এক নয়। ‘কায়েম থাকা’ আর ‘পাশে থাকা’ এক নয়। ‘কথা দেওয়া’ আর ‘কথা রাখা’ এক নয়। তফাতগুলো নিশ্চয়ই আমরা জানি, কিন্তু অনেক সময়ে মনে রাখি না। তবে সময় আর দুঃসময়ে বড়রকমের ফারাক আছে বলেই দুঃসময় এলে এসব তফাত স্পষ্ট হয়ে যায়। বোঝা যায়, কোনটা দখলের ইচ্ছা, কোনটা আগলে রাখার তাগিদ। কোনটা মাটি জয় করার খিদে আর কোনটা মাটি আঁকড়ে থাকার জেদ। এই তফাতটুকুই দুর্দিনে আমাদের আরও একবার ভরসা দেয়, সাহস দেয়, যেমন এবারও দিচ্ছে। আমাদের মুখ্যমন্ত্রীকে (Mamata Banerjee) কৃতজ্ঞতা জানাই, ভালবাসাও জানাই, এই বিপন্নতায় আদত ফারাকগুলো আরও একবার বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য। এসব কেবল তেমন কারও পক্ষেই বোঝানো সম্ভব, যিনি নিজে অন্তর থেকে ফারাকগুলো ভালভাবে বোঝেন। ‘ভোট’ আর ‘সমর্থন’ এক হতে পারে। ‘ভোট’ আর ‘ক্ষমতা’ এক হতে পারে। কিন্তু ‘ভোট’ আর ‘ভালবাসা’ কখনওই এক নয়। এ-কথা তিনি ভালই বোঝেন। আর, বোঝেন বলেই ভালবাসা তাঁর প্রাপ্য হয়ে ওঠে। বারবার।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.