কুণাল ঘোষ: কমরেড, গত কয়েকদিন আপনাদের কিছু কাজকর্ম দেখে এবং শনিবার অকারণ বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টার পর সবিনয় কিছু নিবেদন। আনিস খানের মৃত্যু দুর্ভাগ্যজনক। এটি হত্যা বা অনিচ্ছাকৃত হত্যা হলেও নিন্দনীয়, প্রতিবাদযোগ্য। এই ঘটনার যথাযথ তদন্ত চাই। দোষীদের শাস্তি চাই। এটা সকলেরই স্পষ্ট বক্তব্য। কিন্তু এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আপনারা, আপনাদের কিছু শাখাপ্রশাখা জনজীবনকে যেভাবে ব্যাহত করছেন, যে অপপ্রচার করছেন এবং যে রাজনীতিটা করার চেষ্টা করছেন, তার প্রতিবাদটাও জরুরি।
সোজাভাবে দু’টো কথা বলা যাক। এক, মুখ্যমন্ত্রী নিরপেক্ষ তদন্তের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সিট গঠন করেছেন, তদন্ত চলছে, গ্রেপ্তার শুরু। হাই কোর্টও আপাতত সিটের তদন্তে আস্থা রেখেছেন। তাহলে, এই পর্যায়ে আপনাদের মিটিং, মিছিল, অতিবিপ্লবের দরকার আদৌ থাকে কি? দুই, আপনাদের ইতিহাসে, আপনাদের জমানায় যে সন্ত্রাস আপনারা করেছেন, ন্যায়বিচার দেননি, তারপর এখন হঠাৎ বড়বড় কথা বলে প্রতিবাদের নাটক করার নৈতিক অধিকার আপনাদের থাকতে পারে না। ছাত্রহত্যা, যুবহত্যা, ধর্ষণ করে খুন, গৃহবধূহত্যা, কৃষকহত্যা, শ্রমিকহত্যা, পরের পর গণহত্যা, কী হয়নি আপনাদের জমানায়।
মিডিয়ার রমরমা ছিল না, এত চ্যানেল ছিল না, হাতে হাতে ফোন ক্যামেরা ছিল না। ছিল বিজন সেতুতে সতেরোজন আনন্দমার্গী সন্ন্যাসীকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা, ছিল ছোট আঙাড়িয়া থেকে নানুর, নেতাই, নন্দীগ্রাম গণহত্যা। ছিল ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই কলকাতার রাজপথ থেকে কোচবিহার, সর্বত্র পুলিশের গুলিতে মৃত্যুর মিছিল। আপনাদের ইতিহাসে রয়েছে সাঁইবাড়ি থেকে মরিচঝাঁপির পৈশাচিক তাণ্ডব। এবং আরও অসংখ্য খুন, জখম, সন্ত্রাসের ঘটনা। তার মধ্যে মহাকরণ আর লালবাজারের নাকের ডগায় বউবাজার বিস্ফোরণ আর তাতে সিপিএম নেতানেত্রীদের ভূমিকার ঘটনাক্রম। আপনাদের সময়ে পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু যেমন ছিল, তেমনই ছিল পুলিশের ডিসি পোর্ট বিনোদ মেহতা বা ওসি তিলজলাকে খুন। রিজওয়ানুর রহমানের মৃত্যুর পরেও আপনাদের পুলিশের ভূমিকা সবাই দেখেছেন। সেই আপনারা এখন বিচার চাই বলে নাটক করতে নামলে তার কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা থাকতে পারে না। নেই।
আনিসের মৃত্যুতে মুখ্যমন্ত্রী সিট গঠন করেছেন। তদন্ত চলছে। গ্রেপ্তার হচ্ছে। আদালত বলেছে সিট এখন তদন্ত করে রিপোর্ট দেবে। তাহলে এর বাইরে এখন সরকার কী করবে? এই সময়ে মিছিল, মিটিংয়ের নামে পুলিশকে আক্রমণ, অরাজকতা কেন? রবিবার পুরভোট, তার আগে ধর্মীয় ভোটের অঙ্কে ভেসে থাকার মরিয়া চেষ্টা?
যখন বামজমানায় পরের পর হত্যা, কোথায় ছিল সিপিএমের ছাত্রযুবরা? অতীতের সুদেব ঘটক থেকে শুরু করে সিঙ্গুরের তাপসী মালিক বা রিজওয়ানের মৃত্যু, কোথায় ছিল এসএফআই, ডিওয়াইএফ? বাম সরকার পরের পর ঘটনায় ন্যায়বিচার দেয়নি বলেই আন্দোলন দরকার ছিল, প্রতিবাদ হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রী সিট গঠন করেছেন, হাই কোর্ট তাতে মান্যতা দিয়েছেন, ১৫ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দেওয়ার কথা বলা হয়েছে; তারপরেও এখন আন্দোলনের নামে অরাজকতা কেন?
কমরেড, আপনাদের নেতৃত্ব মানুষের দরবারে প্রত্যাখ্যাত। কংগ্রেসের বা ভাইজানের হাত ধরেও বিধানসভায় শূন্য। যতদিন ক্ষমতায় ছিলেন, নতুন প্রজন্মের কথা মনে পড়েনি। এখন, কমবয়সিদের ভোকাল টনিক দিয়ে গোলমাল করতে পাঠাচ্ছেন। শনিবার হাওড়া গ্রামীণে সুপারের অফিসের সামনে এসব কী করালেন আপনারা? এর নাম বিপ্লব? পুলিশ সংযত ছিল। আপনারা সমানে উসকানি দিয়ে গেলেন। যদি বড় গোলমাল হয়, যদি পুলিশ গুলি চালায়, আপনাদের সস্তা রাজনীতির খানিকটা লাভ হবে ভেবেছিলেন। কমরেড, নতুন প্রজন্মের কিছু ছেলেমেয়েকে এগিয়ে দেওয়ার আগে তাদের বলুন: আমরা প্রাথমিক শিক্ষা থেকে ইংরেজি তুলে দিয়েছিলাম। বলুন, আমরা আটের দশকে কম্পিউটার ঢুকতে দেব না বলে বাংলাকে কয়েক বছর পিছিয়ে দিয়েছিলাম। বলুন: বন্ধ , ধর্মঘট আর উগ্র শ্রমিক আন্দোলনে রাজ্যের শিল্পক্ষেত্রকে এতটাই পিছিয়ে দিয়েছিলাম যে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকেও বলতে হয়েছিল, “আমার দুর্ভাগ্য যে আমার পার্টি বন্ধ করে।”
বাংলার একাধিক প্রজন্মের ক্ষতি করার পর আজ কিছু ছেলেমেয়েকে ভুল বুঝিয়ে লেলিয়ে দিচ্ছেন কমরেড? এখনও কি মানুষের রায় মেনে নেবেন না? কমরেড, আপনারা ভোটে হেরেছেন। হারছেন। আপনাদের সদস্য, সমর্থক কমছে। বহু জায়গায় প্রার্থী পান না, এজেন্ট পান না। তাই দিশেহারা হয়ে এই আনিস মৃত্যুরহস্যকে নিজেদের অস্তিত্বের জন্য কুৎসিতভাবে ব্যবহার করছেন। পুরভোটের আগের দিন গোলমাল পাকানোর সবরকম অপচেষ্টা করলেন। কী ভাবছেন কমরেড? আপনাদের মেকি দরদে কিছু মানুষ তৃণমূলকে কম ভোট দেবেন আর বিজেপি কিংবা আপনারা কোথাও কিছু বাড়তি লাভ পাবেন? অঙ্ক মিলবে না।
বামেদের জনসমর্থন লাটে উঠেছে। মূলত এঁরা ফেসবুক, টুইট আর টিভিতে থাকেন। তবু, যে ক’জন আছেন, তার মধ্যে দু’তিনটি ভাল ছেলেমেয়ে অবশ্যই আছে। কমরেড, আপনাদের ভুলের ধারাবাহিকতা এদের ঘাড়ে চাপিয়ে এদের ক্ষতিও করছেন কেন? এসপি অফিসের সামনে আপনাদের পরিকল্পিত গোলমালকে যতই বিপ্লবের রোমাঞ্চকর মুখোশ পরান, বাস্তবে এটা ছোটদের কাঁধে বিভ্রান্তির বন্দুক রেখে বড়দের ভেসে থাকার মরিয়া চেষ্টা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.