ফাইল চিত্র
নদিয়ায় ‘সুরক্ষিত’ বাঙ্কারে কয়েক লক্ষ কাফ সিরাপের বোতল! উদ্দেশ্য, শারীরিক সর্বনাশ সাধন, অবৈধ বাণিজ্য, কালো টাকার বেসাতি।
‘বাঙ্কার’ শব্দটাই গোলমেলে। ‘অক্সফোর্ড ডিকশনারি’-র মতো জাঁদরেল অভিধান পর্যন্ত শব্দের উৎসের নাগাল পায়নি। মাটি খুঁড়ে তৈরি করতে হয় মানুষের এই গোপন আশ্রয়, যার দেওয়াল হবে এমন মজবুত যে, মানুষ যুদ্ধের সময় সেখানে নিরাপদে লুকিয়ে থাকতে পারবে। বাঙ্কার বললেই তাই চোখের সামনে ভেসে ওঠে যুদ্ধ, গোলাগুলি, বোমাবর্ষণ। তা থেকে বাঁচতে নিহিত পাতালগর্ভে মানুষের নিরাপদ আশ্রয়ের বিদেশি নাম ‘বাঙ্কার’– যা বাংলা ভাষায় ঢুকে পড়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়।
সম্প্রতি একটি ঘটনাসূত্রে বাঙ্কার পাতাল থেকে ডাঙায়! নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জে, বাংলাদেশ বর্ডারের খুব কাছে, মুখে মুখে রটেছে কয়েকটা বাঙ্কারের অবৈধ নির্মাণ ও আকস্মিক আবির্ভাবের গল্প। যে-গল্পের কেন্দ্র: ওসব বাঙ্কারের গর্ভে নাকি সুরক্ষিত কয়েক লক্ষ নিষিদ্ধ কাফ সিরাপের বোতল! যা পাচার হয় পড়শি বাংলাদেশে। অর্থাৎ, এসব বাঙ্কার মানুষের সুরক্ষার জন্য নয়। সস্তার সর্বনেশে মাদক-সিরাপ গোপন গর্ভে সুরক্ষিত রেখে বিক্রি করার জন্য। এসব পাতালকুঠুরির সঙ্গে যুদ্ধের অনুষঙ্গ নেই। বরং আছে অবৈধ বাণিজ্য, নিষিদ্ধ পণ্য, কালো টাকার বেসাতি, সামাজিক অপরাধ, এবং মানুষের শারীরিক সর্বনাশের নিশ্চয়তা। এই ধরনের বাঙ্কার সারির প্রধান উদ্দেশ্য সামাজিক পাপ এবং সর্বনাশের সুরক্ষা।
তবে এ-কথাও অস্বীকার করার উপায় নেই পাতালের প্রতি মানুষের টান ছুঁয়ে আছে আদিম অতীত। কল্পিত পাতালকন্যার আকর্ষণ পুরাণ-রূপকথা থেকে মহাকাব্যে প্রসারিত। হোমারের ইউলিসিস ট্রয়ের যুদ্ধশেষে স্ত্রী-পুত্রের কাছে ফেরার পথে বেশ কয়েক বছর পড়ে রইলেন এক পাতাল সুন্দরীর প্রণয়পাশার ফাঁদে। গ্রিক পুরাণের হেকেটি রহস্যময় পাতালের দেবী। ‘হেকেটি’ নামের অর্থ সুদূরবাসিনী– ‘হার নেম মিন্স দ্য ডিস্ট্যান্ট ওয়ান’ বলছে অভিধান। এই সুদূর রহস্যলোক তো অতল পাতালেই হতে পারে, যা এখনও মানুষের বাস্তব নাগালের বাইরে গহন-গভীর জলের তরল শক্তি দিয়ে ঘেরা সাগর সুন্দরীদের অভেদ্য বাঙ্কার।
প্রথম যৌবনে রবীন্দ্রনাথ তাঁর একটি কবিতার বই উৎসর্গ করে লিখেছিলেন: হে-কে। কে এই ‘হে’, মেলেনি উত্তর, যতদিন না প্রশান্তকুমার পাল তাঁর ‘রবিজীবনী’তে জানিয়েছেন কিশোর রবীন্দ্রনাথ মালতীপুঁথি নামের কবিতার খাতায় বারবার লিখেছেন এই ব্যাকুল ডাক, হেকেটি বৌঠান, হেকেটি বৌঠান, হেকেটি বৌঠান। জলের তারল্যও যে গড়তে পারে বিপন্ন মানুষের
চারধারে অভেদ্য দেওয়ালের রক্ষাকবচ, ভাবতে পেরেছিলেন কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস, এবং তাঁর নামেই তৈরি সেই জলের তরল বাঙ্কার দ্বৈপায়ন হৃদের স্ফটিক স্বচ্ছতায় লুকিয়ে রেখেছিলেন যুদ্ধ থেকে পলাতক দুর্যোধনকে। সবাই দুর্যোধনকে দেখতে পাচ্ছে। অথচ স্বয়ং ভীমেরও ক্ষমতা নেই জলের বাঙ্কার ভেঙে দুর্যোধনের কাছে পৌঁছনোর। কবেকার প্রাচীন মহাকাব্যে ম্যাজিক বাস্তবের এই অলীক বাঙ্কার! তুলনাহীন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.