COVID-19’এর দ্বিতীয় দফার প্রাদুর্ভাব হতে পারে আরও ভয়ানক। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চলছে ভাইরাস দমনের প্রস্তুতি। তবে তার মারণ ক্ষমতা মনে করাচ্ছে স্প্যানিশ ফ্লু-এর ইতিহাস। লিখছেন হীরালাল মজুমদার মেমোরিয়াল কলেজের অধ্যাপক ঋত্বিক আচার্য।
নোভেল করোনা ভাইরাসের হানায় বিধ্বস্ত সারা পৃথিবীতে এই মুহূর্তে চলছে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই। ভারতবর্ষে তৃতীয় পর্যায়ের লকডাউন সত্ত্বেও আক্রান্তের সংখ্যা ৫০ হাজারের গণ্ডি ছাড়িয়েছে। প্রথম পর্যায়ের এই প্রাদুর্ভাবেই সারা বিশ্বের আর্থ-সামাজিক অবস্থা গিয়ে ঠেকেছে তলানিতে। তার মধ্যে চিন্তা বাড়াচ্ছে চিন, আমেরিকা, ইটালি এবং ইংল্যান্ডের গবেষকদের COVID-19 এর পুনরায় প্রাদুর্ভাব তত্ত্ব। গবেষকদের মতে এই প্রাদুর্ভাব হতে পারে আরও মারাত্মক, প্রভাব হতে পারে আরও গুরুতর। এই তত্ত্বের ভিত্তি মূলত দুটি; একটি হলো সারা পৃথিবীতে এই ধরনের অতিমারি সম্পর্কে সংগৃহীত তথ্য এবং দ্বিতীয়টি – এই মারণ ভাইরাসের এখনও পর্যন্ত নির্ধারিত প্রকৃতি।
পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম দৃষ্টান্ত সৃষ্টিকারী অতিমারী স্প্যানিশ ফ্লু কে Covid 19 সম্পর্কে পর্যালোচনায় অতি গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ্য বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। যার কারণ মনে করা হয় H1N1 ভাইরাসকে। Pandemic স্প্যানিশ ফ্লু’র প্রথম দেখা মেলে ১৯১৮ সালে এবং বিভিন্ন পর্যায়ে এই ফ্লু’র প্রাদুর্ভাব চলে ১৯২০ সাল পর্যন্ত। একদম সঠিক তথ্য না থাকলেও মনে করা হয় যে এই অতিমারিতে মৃত্যু হয়েছিল ৫-১০ কোটি মানুষের। ফ্রান্সের সেনাঘাঁটিতে শুরু হয়ে এই ভাইরাস ক্রমশ ছড়িয়ে পরে প্রায় সারা পৃথিবীতে। কানাডার বিখ্যাত ইতিহাসবিদ মার্ক হামফ্রিস মনে করেন, চিন থেকে ব্রিটেন এবং ফ্রান্সে কাজ করতে আসা ৯৬ হাজার শ্রমিকই ছিলেন এই সংক্রমণের মূল উৎস। ভারতবর্ষেও এই রোগের প্রভাব পড়েছিল মারাত্মক।
১৯১৮ সালে তৎকালীন বোম্বেতে আসা এক জাহাজ থেকে ছড়িয়ে পরে এই সংক্রমণ, ভারতবর্ষের ইতিহাসে এই রোগটি ‘বোম্বে ফ্লু’ বলে পরিচিত। ভারতের প্রায় সর্বত্র ছড়িয়ে পরে এই ভাইরাস। প্রাণ হারান প্রায় ১ কোটি ২০ লক্ষ ভারতবাসী। আক্রান্ত হয়ে পড়েন মহাত্মা গান্ধীও। তৎকালীন বিশেষজ্ঞদের মতে এই রোগের দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রাদুর্ভাব ছিল বেশি মারাত্মক, এমনকি মহাত্মা গান্ধীও তাঁর জীবনীতে দ্বিতীয় দফার প্রাদুর্ভাব অনেক বেশি ভয়াবহ বলে উল্লেখ করেছেন।
করোনা ভাইরাসের ৭ টি প্রকারের মানুষকে আক্রান্ত করার তথ্য গবেষণাপত্রে পাওয়া যায়। যার মধ্যে ৪টি SARS CoV-2 এর বেশ কাছাকাছি। বিজ্ঞানীদের ভাবিয়ে তুলেছে এই চারটি ভাইরাসের মরশুমি হওয়া, যা SARS CoV-2 এর দীর্ঘকালীন স্থায়িত্বের দিকে ইঙ্গিত করে। এই মুহূর্তে বিজ্ঞানীদের বিচার্য বিষয় মূলত চারটি। প্রথমত, SARS CoV-2 বছরের যে কোনও সময়ে একই ভাবে সংক্রমণে সক্ষম কিনা। দ্বিতীয়ত, আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হওয়া মানুষের ক্ষেত্রে প্রাপ্ত প্রতিরোধ ক্ষমতার স্থায়িত্ব কতটা। এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে যে HCoV-OC43 এবং HCoV-HKU1 করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে প্রাপ্ত প্রতিরোধ ক্ষমতার স্থায়িত্বকাল মাত্র এক বছর। SARS CoV এর ক্ষেত্রে যা কিছুটা হলেও বেশি। তৃতীয়ত, বিজ্ঞানীদের মতে আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হওয়া মানুষের ক্ষেত্রে প্রাপ্ত ইমিউনিটির মেয়াদ বেশী হলে অচিরেই অবলুপ্ত হবে এই ভাইরাস। চতুর্থত, SARS CoV-2 এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে কাছাকাছি থাকা করোনা ভাইরাসের কোনওরকম পুরোনো সংক্রমণ ওই ব্যক্তির মধ্যে SARS CoV-2 এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে পারছে কিনা।
প্রসঙ্গত, আমাদের মনে রাখতে হবে যে ভ্যাকসিন অথবা অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ কোনওটাই আমাদের হাতে এসে এখনও পৌঁছায়নি। পৌঁছতে সময় লাগতে পারে আরও অন্তত মাস ছয়েক। ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লু’র সময়েও বিশেষভাবে কাজে এসেছিল সামাজিক দূরত্ব, মাস্কের ব্যবহার এবং আংশিক লকডাউনের মতো সাম্প্রতিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি। বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত পৃথিবীতে চিকিৎসা ব্যবস্থা তখন ছিল অনেকটাই পিছিয়ে। অ্যান্টিবায়োটিক এবং ভ্যাকসিন – দুটোই তখন অমিল।
একশো বছরেরও বেশি আগের এই মহামারি আবারও বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে বর্তমান পরিস্থিতিতে, মূলত
তিনটি কারণে। প্রথমত, এই ভাইরাস সংক্রমণের বিস্তার ছিল প্রায় বিশ্বজোড়া। দ্বিতীয়ত, তখনকার মতো এখনো SARS CoV-2 নিয়ে সীমিত ধারণা এবং তৃতীয়ত, স্প্যানিশ ফ্লু এর বারংবার ভয়ংকর প্রত্যাবর্তনের ইতিহাস। চিন, আমেরিকা, ইটালি, ইংল্যান্ড-সহ বাকি বেশ কিছু দেশ COVID-19’এর আবার প্রাদুর্ভাবের বিরুদ্ধে প্রস্তুতি নিচ্ছে, দ্বিগুণ করা হচ্ছে চিকিৎসা ব্যবস্থা, সামাজিক রীতিনীতির ক্ষেত্রেও নিয়ে আসা হচ্ছে পরিবর্তন। সামাজিক দূরত্ব, মাস্কের ব্যবহার, সামাজিক ও ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাই এই মুহূর্তে ঠেকিয়ে রাখতে পারে এই মারণ ভাইরাসের সংক্রমণ। সুদীর্ঘ ব্যক্তিগত শৃঙ্খলাপরায়ণতাই হয়তো বাধা হয়ে উঠতে পারে এই ভাইরাসের আবার প্রাদুর্ভাবের পথে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.