Advertisement
Advertisement
Congress

‘হাই কমান্ড’ বনাম ‘আঞ্চলিক মসিহা’

‘জননায়ক’ নেতা হিসাবে রাহুল গান্ধী কি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন?

Congress now relies on regional leadership rather than high command-based organization। Sangbad Pratidin

ফাইল ছবি।

Published by: Biswadip Dey
  • Posted:November 11, 2023 12:59 pm
  • Updated:November 11, 2023 12:59 pm  

দেশের রাজনীতিতে কেন্দ্রীভূত ও বিপুল শক্তিধর ‘হাই কমান্ড’ সংস্কৃতির উত্থান ঘটেছিল ইন্দিরা গান্ধীর হাত ধরে। বিজেপির বর্তমান শীর্ষ নেতৃত্ব কেন্দ্রীভূত শক্তিতেই বিশ্বাস করে। কিন্তু সময়ের খেলায় কংগ্রেসের অভ্যন্তরে দেখা দিয়েছে অন্য ধারা। হাই কমান্ড নয়, রাজ্যওয়াড়ি ‘আঞ্চলিক মসিহা’-দের রমরমা এখন কংগ্রেসে। লিখলেন জয়ন্ত ঘোষাল

ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটা সময় ছিল যখন কংগ্রেসের আধিপত‌্য ছিল সবার উপর। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রজনী কোঠারি সেই সময়, সেই রাজনৈতিক দলীয় পরিস্থিতির নাম দিয়েছিলেন, ‘কংগ্রেস সিস্টেম’। সেকালে প্রত্যেক রাজ্যে কংগ্রেসের বেশ কিছু বিশিষ্ট আঞ্চলিক নেতা ছিলেন। স্বাধীনতার আগেও এই নেতাদের আমরা দেখেছি। স্বাধীনতার পরও ডা. বিধান রায়, বিজু পট্টনায়েক, কামরাজ বসন্ত, দাদা পাতিল অথবা পাঞ্জাবে জ্ঞানী জৈল সিংহ, দরবারা সিংহর মতো নেতা ছিলেন ‘আঞ্চলিক মসিহা’। তখন কংগ্রেসের সাংগঠনিক নেতৃত্ব ছিল অনেক বেশি বিকেন্দ্রীকৃত। ’৭০ সালে ইন্দিরা গান্ধী কংগ্রেসে কেন্দ্রীভূত রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিয়ে এলেন। ‘হাই কমান্ড’ নামক এক বিপুল শক্তির জন্ম হল। বর্ষীয়ান নেতাদের মতামত ইন্দিরা অগ্রাহ‌্য করেছেন। শক্তিশালী মুখ‌্যমন্ত্রীদের ক্ষমতা খর্ব করার জন‌্য তাদের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী করে ভিন্ন রাজ‌্যনেতাদের মুখ‌্যমন্ত্রী পদে নিযুক্ত করতেন। ইন্দিরার সময় দলে রাজ‌্যওয়ারি গোষ্ঠীদ্বন্দ্বর রমরমাও সে-সময় থেকেই।

Advertisement

সেদিন টের পাওয়া যায়নি, পরবর্তী কালে বোঝা গেল, এই একনায়কতন্ত্রর জন‌্য রাজ্যে রাজ্যে কংগ্রেস কতখানি দুর্বল হয়ে গেল। আর এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ক্রমশ কংগ্রেসের রাজনৈতিক পরিসর দখল করল বিজেপি। প্রথমে জোট শরিক। এর পর ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্ব বিজেপি একক শক্তি নিয়ে ক্ষমতাসীন হল। বিজেপির এই দশ বছর দেখে বলা যায়, রজনী কোঠারির সেই পরিভাষা বদলে এখন এসেছে ‘বিজেপি সিস্টেম’।

[আরও পড়ুন: সুশান্ত সিং রাজপুত মৃত্যু মামলায় জামিন আরও এক অভিযুক্তর, আদৌ মিলবে ন্যায় বিচার?]

বিজেপি দলটিও এই বিপুল আধিপত‌্য সংস্কৃতিতে মোদিময় হয়ে গিয়েছে। দেবকান্ত বড়ুয়া একদা স্থাবক-বৃত্তি করেই বলেছিলেন, ‘ইন্দিরা ইজ ইন্ডিয়া’। এখন বিজেপি নেতারাও মনে করেন– ‘মোদিই হল ভারত’। বাজপেয়ী-আদবানির সময়ও রাজ্যে রাজ্যে বিশিষ্ট বিজেপি নেতারা ছিলেন। মধ‌্যপ্রদেশে সুন্দরলাল পাটোয়া, উমা ভারতী, রাজস্থানে বসুন্ধরা রাজে, যশবন্ত সিংহ, ছত্রিশগড়ে রমন সিং, অন্ধ্রপ্রদেশে বেঙ্কাইয়া নাইডু, মহারাষ্ট্রে প্রমোদ মহাজন, হরিয়ানায় সুষমা স্বরাজ, দিল্লিতে মদনলাল খুরানা প্রমুখ লম্বা তালিকা। বাজপেয়ী-আদবানি সচেতনভাবে রাজ্যে রাজ্যে এই নেতাদের তৈরি করেন। বিকেন্দ্রীকৃত ব‌্যবস্থা। এখন, এত বছর পর আবার ইতিহাসের চাকা ঘুরে গিয়েছে।

এখন রাজ্যে রাজ্যে বিজেপির সেসব শক্তিশালী আঞ্চলিক মসিহা অদৃশ‌্য। হেমন্ত বিশ্বশর্মা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু হাইকমান্ডের বশংবদ। অসমের হিতেশ্বর শইকিয়া তিনি হতে পারেননি। শিবরাজ সিংহ, রমন সিংহ চেষ্টা করেছিলেন আঞ্চলিক মসিহা হওয়ার জন‌্য– কিন্তু দু’জনেই মোদি-শাহর দ্বৈত হাইকমান্ড জমানায় দিল্লির আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত। গেরুয়াধারী যোগী অবশ‌্য এখনও এককভাবে লড়ছেন বিকেন্দ্রীকৃত নিজস্ব পরিসরে সম্রাট হওয়ার প্রয়াসে, তবে এখনও তিনি গোবিন্দবল্লভ পন্থ এমনকী এন. ডি. তিওয়ারি বা বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ হতে পারেননি।

[আরও পড়ুন: ভারত-আমেরিকা বৈঠকে খলিস্তানি মেঘ! ওয়াশিংটনকে পরিস্থিতি ‘বোঝাল’ দিল্লি]

বিজেপি যখন ইন্দিরা-জমানার কংগ্রেস হাই কমান্ড সংস্কৃতির গভীরে, তখন কংগ্রেসে এক বিপরীত দৃশ‌্যপট দেখা যাচ্ছে। এই যে রাজস্থান, মধ‌্যপ্রদেশ, ছত্রিশগড়ের মতো রাজ্যে বিধানসভা ভোট পর্ব শুরু হয়েছে। এই রাজ‌্যগুলোয় বিজেপির বিরুদ্ধে কংগ্রেস টক্কর দিচ্ছে। নির্বাচনী সমীক্ষাগুলি বলছে– মধ‌্যপ্রদেশ, ছত্রিশগড়ে কংগ্রেসের জয়ের সম্ভাবনা প্রবল। এমনকী, রাজস্থানেও কংগ্রেস জয়ের জন‌্য লড়ছে। যেখানে সাধারণত রাজস্থানে পাঁচ বছর অন্তর শাসক বদলানোর পরম্পরা।

আর, এই প্রতিটি রাজে‌্যই দেখা যাচ্ছে কংগ্রেস হাইকমান্ডের জন‌্য নয়, রাজ্যে রাজ্যে বিজেপি-বিরোধী আমজনতার অসন্তোষ যাদের ‘বিকল্প’ হিসাবে অঁাকড়ে ধরেছে তারা আঞ্চলিক মসিহা। ওই রাজে‌্যর পরিচিতি বহনকারী জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্র‌্যান্ড। রাজস্থানে অশোক গেহলট, মধ‌্যপ্রদেশে কমলনাথ, ছত্রিশগড়ে ভূপেশ বাঘেল, তার আগে কর্নাটক সিদ্দারামাইয়া তারও আগে হিমাচলপ্রদেশে সুখবিন্দর সিং– এঁরা প্রত্যেকে হাইকমান্ডের চরণাশ্রিত ভৃত‌্য নয়। বরং এসব রাজ্যে ভোট পর্বে তথাকথিত ‘হাইকমান্ড’ বা রাহুল গান্ধী বা এমনকী ‘অ-গান্ধী’ দলের সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গেরও কোনও ভূমিকা নেই।

দ্রুত ও সংক্ষেপে এবার এই রাজ‌্যনেতাদের সাফলে‌্যর রসায়নের কিঞ্চিৎ আলোচনা করি। ছত্রিশগড়ের মুখ‌্যমন্ত্রী বাঘেল, বয়স মাত্র ৬৩। ’৯৩ সালে প্রথম এমএলএ হন। মধ‌্যপ্রদেশ দিগ্বিজয় সিংহর মন্ত্রিসভায় ’৯৯ সালে তিনি প্রথম রাজ্যের মন্ত্রী হন। জাতে কুর্মি। ছত্রিশগড়ে তাঁর বিরুদ্ধে সোচ্চার, মুখ‌্যমন্ত্রী হতে চান টি. এস. সিংদেও।

ছ’-মাস অন্তর মুখ‌্যমন্ত্রী বদল হবে এমনটাই ছিল হাইকমান্ড ফরমুলা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দু’জনকে ডেকে বারবার বৈঠক করলেও হাইকমান্ড বাঘেলকে সরাতে পারেননি। আমজনতার সমর্থন আবার অন‌্যদিকে দলীয় বিধায়কদেরও সংখ‌্যাগরিষ্ঠ সমর্থন ছিল বাঘেলের দিকে। চতুর এই নেতা বর্তমানে রাজে‌্য সবচেয়ে বড় ‘ব্র‌্যান্ড ইকুইটি’– এজন‌্য মোদির আক্রমণেরও প্রধান লক্ষ‌্য বাঘেল– রাহুল গান্ধী নন।

অশোক গেহলট ও কমলনাথ দু’জনেই কেউ নবীন নন। গেহলট ’৭১ সালে বাংলাদেশের উদ্বাস্তু শিবিরে সক্রিয় কর্মী ছিলেন, ইন্দিরার নজরে পড়েন। এখন বয়স ৭২। শচীন পাইলটের পক্ষে হাইকমান্ডের সমর্থন থাকা সত্ত্বেও গেহলটকে রাহুল-প্রিয়াঙ্কা সরাতে পারেননি। এমনকী, গেহলটকে দলের সভাপতি হওয়ার প্রস্তাব দেন খোদ সোনিয়া গান্ধী! তিনি রাজি হননি, মুখ‌্যমন্ত্রীর পদ ছাড়তেও নারাজ।

কর্নাটকে ধনী ও প্রভাবশালী হওয়া সত্ত্বেও ডি. কে. শিবকুমার মুখ‌্যমন্ত্রী হতে পারেননি। কারণ ৭৬ বছর বয়সের সিদ্দারামাইয়া কুরুবা জাতের মানুষ, কর্নাটকে যাদের ‘ওবিসি’ বলা হয়। সিদ্দারামাইয়া কতটা জনপ্রিয় দিল্লি টের পায় যখন ২০২২ সালে কর্নাটকে ‘সিদ্দোরামোৎসব’ হয় আর সেখানে কমপক্ষে ২০ লাখ মানুষ হাজির হয়। হিমাচলে সুখবিন্দর সিং ওরফে সুখুর বয়স মাত্র ৫৯, কিন্তু এই রাজপুত নেতা এলাকায় ক্রমশ নিজের নিজস্ব পরিসর তৈরিতে ব‌্যস্ত।
যদিও রাহুল গান্ধী ডিসেম্বর মাসে আবার ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’-র ‘পার্ট টু’ শুরু করতে চলেছেন– জাতীয় স্তরে মোদি-বিরোধী জোটের তিনিই প্রধান ‘অবয়ব’ হতে চেয়ে। চাওয়ার মধে‌্য কোনও অন‌্যায়ও নেই। কিন্তু দেশে মোদি-বিরোধী জননেতা রাহুল গান্ধী একা নন। তিনি নানা রঙের রামধনু নেতৃবৃন্দের মধে‌্য একজন। গৌরবে বহুবচন।

দেশে ‘জননায়ক’ নেতা হিসাবে রাহুল গান্ধী কি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন? ২০২৪ লোকসভা ভোটের তো আর বাকি মাত্র পাঁচ মাস। কংগ্রেসের নির্বাচনী ব‌্যর্থতার জন‌্য নরসিংহ রাও এবং সীতারাম কেশরীকে বিদায় নিতে হয়। ’৯৯ সালে কংগ্রেসের ভোট-ব‌্যর্থতা কিন্তু সোনিয়া গান্ধীকে দলের মধ্যে কোনও চ‌্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয়নি। কিন্তু আমেঠিতে হেরে যাওয়া এবং ’১৯ সালে দলের ভয়াবহ বিপর্যয়ের পরেও রাহুল গান্ধীকে কেউ ইস্তফা দিতে বলেননি। তবু রাহুল গান্ধী বুঝতে পেরেছিলেন– তাঁর ইস্তফাই দলে তাঁর বিশ্বাসযোগ‌্যতা বৃদ্ধিতেই সাহায‌্য করবে। জানি না। আমার অবশ‌্য মনে হয়, এ যেন আরও বড় ধরনের রসিকতা। আমি দলের সভাপতি পদ ছেড়ে দিয়েছি কিন্তু আমিই দলের প্রধান নিয়ন্ত্রক। এই ‘খাচ্ছি, কিন্তু গিলছি না’-কে বিবেকের তাড়না বললেও তাতে রাহুল গান্ধীর কতটা লাভ হবে জানি না। তবে এই যে রাজ্যে রাজ্যে হাইকমান্ডের দুর্বলতার জন‌্য আঞ্চলিক নেতৃত্বের আবার পুনরুত্থান হচ্ছে সেটি ভারতীয় গণতন্ত্রের জন‌্য ইতিবাচক। কংগ্রেসের সাংগঠনিক গণতন্ত্রের পুনরাবির্ভাব, আর বিজেপির কেন্দ্রীভূত আধিপত্য যেন সমকালীন ইতিহাসে একে-অন্যের পরিপূরক।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement