সলমন খুরশিদের ঘটনা আবারও প্রমাণ করল, সংঘ পরিবারের হিন্দুত্বকে ‘হিন্দুবিরোধী’ অভিহিত করা ব্যর্থ রাজনৈতিক কৌশল হিসাবেই থেকে যাবে, যদি না তা কোনও বিকল্প আদর্শগত অবস্থান দ্বারা সমর্থিত হয়। এবং ‘বিকল্প’ রূপে কংগ্রেস কোনও নৈতিক উচ্চ স্থান নিতে পারে না, কারণ অতীতে অস্থায়ী নির্বাচনী সুবিধার জন্য হিন্দু ও মুসলিম দলগুলির সঙ্গে তারা বিভিন্ন চুক্তি করেছে। ফলে এই বিতর্ক থেকে ইউপি নির্বাচনে কংগ্রেস সুবিধা পাবে, এ একরকমের দুরাশা। লিখছেন রাজদীপ সরদেশাই
সোশ্যাল মিডিয়ার বাড়বাড়ন্তে, প্রাইম টাইম খবরের চিৎকার-চেঁচামেচিতে এবং হোয়াটসঅ্যাপ ফরওয়ার্ডের হুড়োহুড়ির যুগে প্রকাশ্যে উচ্চারিত বা লিখিত যে-কোনও কথাই শব্দের চেয়ে দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ে মহাবিশ্বে। বিজেপির বিরাট সোশ্যাল মিডিয়া বাহিনী এক্ষেত্রে বিশেষ তৎপর। তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সামান্যতম বিচ্যুতি নিয়েও তারা ঝড় বইয়ে দিতে পারে সাইবার স্পেসে, এবং তার বাইরেও। এর সাম্প্রতিক নিদর্শন পাওয়া গেল কংগ্রেস নেতা সলমন খুরশিদের অযোধ্যা রায়ের উপর লেখা বইয়ের একটি বাক্য নিয়ে বিজেপির তীব্র প্রতিক্রিয়ায়- যেখানে খুরশিদ রাজনৈতিক হিন্দুত্বের ‘শক্তিশালী সংস্করণ’ ও ‘আইসিস’-‘বোকো হারাম’-এর মতো জিহাদি ইসলামি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে এক সমতলে এঁকেছেন। এই ঘটনা নির্বাচনী মরশুমের চেনা ধর্মীয় আক্রোশকে পুনরায় চাগিয়ে দিয়েছে।
খুরশিদ ক্রমাগত স্পষ্ট করার চেষ্টা করছেন এই বলে যে, তিনি ধ্রুপদী ‘হিন্দু ধর্ম’-কে ধর্মীয় বিশ্বাস এবং ‘হিন্দুত্ব’-কে রাজনৈতিক শোষণ বলার মাধ্যমে দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য টেনেছেন, কিন্তু ততক্ষণে যা ক্ষতি হওয়ার হয়েই গিয়েছে। এমনকী, কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন ‘হিন্দু ধর্ম মোটেই নিরপরাধ ব্যক্তিকে ঘৃণা বা হত্যা করা নয়, বরং হিন্দুত্ব তাই’- মন্তব্যটি করে। ফলশ্রুতিতে, রাহুল গান্ধী খুরশিদের কথাকে সরাসরি সমর্থন না করেও সংঘ পরিবারের বিরুদ্ধে একটি আদর্শগত ‘যুদ্ধের’ আহ্বান জানিয়েছেন।
বিশুদ্ধ অ্যাকাডেমিক যুক্তি হিসাবে, ‘হিন্দু ধর্ম বনাম হিন্দুত্ব’-র ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নির্মাণের প্রতিযোগিতাটি বিতর্কের যোগ্য, কিন্তু তারপর তাকে প্রসারিত করে হিন্দুত্বের একটা ‘সংস্করণ’-এর সঙ্গে আইসিস-বোকো হারামের ‘মিল’ আছে বলাটা ঘোলা জলকে আরও ঘোলা করে তোলা। রাজনৈতিক হিন্দুত্বের বিষাক্ত রূপগুলি অবশ্যই হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কে চিড় ধরিয়েছে, এমনকী, ধর্মের নামে ভয়ানক হিংস্রতার দিকে নিয়ে গিয়েছে: গোরক্ষক বাহিনী এবং বজরং দলের হিংসাত্মক আক্রমণ উন্মত্ত ধর্মীয় বিদ্বেষ দ্বারাই চালিত। আরএসএস-বিজেপি নেতৃত্বের ব্যর্থতা এই ধরনের প্রতিটি হিংসাত্মক কাজকে দ্ব্যর্থহীনভাবে নিন্দা না করায়, যা কিনা হিংসার ‘স্বাভাবিকীকরণ’ ঘটিয়েছে এবং পৈশাচিক ধর্মান্ধতার এই শক্তিগুলোকে দায়মুক্ত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। কিন্তু সংঘ পরিবারের ‘হিন্দুরাষ্ট্র’-র ধারণা, তার সমস্ত সমস্যাজনক সংবিধান-বিরোধী বিকৃতি নিয়েও কি ইসলামিক রাষ্ট্রের সমতুল? যারা সশস্ত্র জিহাদি সন্ত্রাসী সংগঠন, যাদের পদচিহ্ন বিশ্বজোড়া, যাদের স্বীকৃত বিশ্বাস হল জাতি-রাষ্ট্রের সহিংস দখল এবং যাদের প্রধান শত্রুই সহ-নাগরিক ইসলামপন্থীরাই? না কি এর সঙ্গে মিল রয়েছে নাইজেরিয়াভিত্তিক বোকো হারামের, যাদের সন্ত্রাসী হামলায় হাজার হাজার মানুষের
মৃত্যু হয়েছে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষকে যারা বাস্তুচ্যুত করেছে?
খুরশিদের বইয়ের এই বিতর্কিত বাক্যটি হয়তো লেখককে আরও কয়েক কপি বই বিক্রি করতে সাহায্য করেছে, এবং রাহুল গান্ধীর ভিডিওটা হয়তো ‘ভাইরাল’ হয়েছে, কিন্তু এতে তাদের দলের ভোটবাক্সে অতিরিক্ত ভোট পড়বে না, বিশেষ করে হিন্দুত্বের হৃদয়ভূমি উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনে। হয়তো ভারতের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্যের নির্বাচনী লড়াইয়ে কংগ্রেস এখনও প্রান্তিক খেলোয়াড়, কিন্তু দলের নেতৃত্ব মনে করে, এর ফলে তাদের হারানোর কিছুই নেই। কিন্তু এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের ঠিক আগে এই ঘটনাটি বিজেপিকে আরও একটি সুযোগ করে দেয় জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, কোভিড-সংক্রান্ত অব্যবস্থা এবং ধর্মীয় মেরুকরণের আখ্যানের মতো সম্ভাব্য ক্ষতিকারক ‘জনভিত্তিক’ ও আঞ্চলিক সমস্যাগুলো থেকে জনসাধারণের মনোযোগ বিপথগামী করার। নির্বাচনের মুখে, এই মুহূর্তে, ধর্মীয় রাজনীতির বলয়ে না ভেবেচিন্তে প্রবেশ করা বিস্ফোরকভর্তি খনিতে পা রাখার মতোই, যা একটি তীব্র বিভাজনকারী যুদ্ধ, যেখানে কেবল একজন জয়ী হতে পারে।
এক অর্থে, রাজনৈতিক হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে সম্প্রতি কংগ্রেসের এই সম্মুখ সমর আসলে এটাই প্রমাণ করে যে, বিরোধী দলগুলো এখনও স্পষ্ট দোলাচলে রয়েছে- কীভাবে এই গেরুয়া ঢেউয়ের মোকাবিলা করা যাবে, তা নিয়ে। চার বছর আগে, ২০১৭ সালের গুজরাট নির্বাচনের সময় রাহুল গান্ধী হঠাৎ তাঁর হিন্দু পরিচয়টি গায়ে চড়িয়ে মন্দির পরিদর্শনে বেরলেন এবং সগর্বে নিজেকে ঘোষণা করলেন ‘পৈতেধারী’ হিন্দু হিসাবে। অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক নেতাও তাঁদের ধর্মীয় পরিচয় প্রকাশ্যে প্রদর্শনের মাধ্যমে তাঁদের হিন্দু শিকড়কে জোর দেওয়ার বিষয়ে সচেতন হয়েছেন। ২০২০ সালের দিল্লি নির্বাচনের আগে অরবিন্দ কেজরিওয়াল হনুমান চালিশা পাঠ করলেন, এ-বছর পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের পরিচয় দিলেন হিন্দু ব্রাহ্মণ-কন্যা হিসাবে, যিনি চণ্ডীপাঠ করতে পারেন। হিন্দু মন্ত্রকে কৌশলগতভাবে ‘নরম’ হিন্দুত্ব ডিজাইন করতে ব্যবহার করা হয়েছে তথাকথিত হিন্দু ভোটব্যাঙ্কের উপর বিজেপি নেতৃত্বের একচেটিয়া অধিকারকে চ্যালেঞ্জ করতে।
তাহলে কোন পথে চলতে হবে? সংঘ পরিবারের হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা না কি এর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক হিন্দুত্বের বিকল্প প্রস্তাব করা? সাম্প্রতিক নির্বাচনের ইতিহাস ঘাঁটলে বোঝা যাবে যে, সংঘ পরিবারের হিন্দুত্বকে ‘হিন্দুবিরোধী’ বলে অভিহিত করা ব্যর্থ রাজনৈতিক কৌশল হিসাবেই থেকে যাবে, যদি না তা কোনও শক্তিশালী, বিকল্প আদর্শগত অবস্থান বা বিশ্বাসযোগ্য নেতৃত্ব দ্বারা সমর্থিত হয়। ২০১৩ সালে প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীলকুমার শিন্ডের ‘গেরুয়া সন্ত্রাস’ মন্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়ার কথা মনে করে দেখুন। উদাহরণস্বরূপ, রাহুল-খুরশিদের এই সমালোচনা সংঘ পরিবারকে ইচ্ছাকৃতভাবে ‘হিন্দু খতরে মে হ্যায়’ মনোভাব সাধারণের মধ্যে চাগিয়ে তোলার অনুমতি দিয়ে দেয়, যা ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদী’ এবং ইংরেজ অভিজাতদের মধ্যে একটি বিস্তৃত ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের অংশ। খুরশিদকে একজন প্রভাবশালী ভারতীয় মুসলিম হিসাবে উপহাস করা হবে, যিনি হিন্দুধর্মকে অপমান করেছেন, আর রাহুলকে উপহাস করা হবে হিন্দুফোবিক কৌশলী ‘নামদার’ (উচ্চবংশীয়) হিসাবে।
সাম্প্রদায়িকতায় ক্ষতবিক্ষত উত্তরপ্রদেশকে ক্ষমতাসীন বিজেপি নেতৃত্বের পক্ষে সামান্যতম সুযোগেই কাল্পনিক ভয় এবং অভ্যন্তরীণ কুসংস্কারে আচ্ছন্ন করে দেওয়া সহজ এবং তার নেপথ্যে একটি সংখ্যাগরিষ্ঠের দৃষ্টিভঙ্গিও জোগানো সহজ। খেয়াল করে দেখুন, জিন্নাকে ‘স্বাধীনতা সংগ্রামী’ বলার জন্য সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ যাদবকে বিজেপি কীভাবে কবজা করেছে বা প্রকৃতপক্ষে কীভাবে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের ‘আব্বা জান’ ডাক বা তালিবানি গালি বারবার ব্যবহার করা হয়েছে মুসলমানদের ‘অ্যান্টি ন্যাশনাল’ বা ‘সংখ্যালঘু তোষণ’-এর সুবিধাভোগীর বাঁধাধরা ছকে ফেলে দেওয়ার জন্য।
যাই হোক, ভয়ে চুপ করে থাকা এখন আর বিকল্প নয়। দীর্ঘ সময় ধরে ধর্মীয় উত্তেজনা-সৃষ্টিকারী এবং জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে স্বল্পমেয়াদি সমঝোতা জাগ্রত ধর্মনিরপেক্ষতার প্রচুর ক্ষতি করেছে, যে ধর্মনিরপেক্ষতা রাজনীতির সঙ্গে ধর্মকে মেশানোর যে-কোনও প্রচেষ্টাকে প্রত্যাখ্যান করে। কংগ্রেস কোনও নৈতিক উচ্চ স্থান নিতে পারে না, কারণ তারা অতীতে অস্থায়ী নির্বাচনী সুবিধার জন্য হিন্দু ও মুসলিম দলগুলির সঙ্গে বিভিন্ন চুক্তি করেছে, তা সে মহারাষ্ট্রের শিবসেনাই হোক কি কেরলের মুসলিম লিগ। উপরন্তু যদি রাহুল গান্ধী-খুরশিদের ধর্মীয় হিংসার প্রতি শূন্য সহিষ্ণুতার পথই অনুসরণ করতে হয়, তাহলে তা কিন্তু প্রসারিত করতে হবে প্রতিটি সাম্প্রদায়িক হিংসার অপরাধীর জন্য।
১৯৮৪-র শিখবিরোধী গণহত্যার জন্য যারা দায়ী, যারা কাশ্মীরি পণ্ডিতদের টার্গেট করেছিল, বা যারা অযোধ্যা ও গোধরা হিংসার সঙ্গে যুক্ত, বা যারা আরএসএস কর্মীদের কেরলে মারে- তাদের সকলের জন্য। অন্যথায় এটি একটি ভণ্ডামি, একতরফা রাজনৈতিক বাগাড়ম্বরপূর্ণ বক্তৃতা, যা ক্ষতি ছাড়া ভাল করবে না।
পুনশ্চ খুরশিদের সঙ্গে এই কলামিস্টের সাম্প্রতিক একটি ইন্টারভিউতে তিনি জানিয়েছিলেন যে, শুধুমাত্র তাঁর মন্তব্যের ফলে সম্ভাব্য প্রতিকূল নির্বাচনী ফলাফল কী হতে পারে, সে কথা ভেবে তাঁকে বাকস্বাধীনতার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা উচিত নয়। কিন্তু একজন লেখক যে-ধরনের সাহিত্যিক স্বাধীনতা উপভোগ করতে পারেন, তা অনেক ক্ষেত্রেই একজন অনুশীলনকারী রাজনীতিবিদের থেকে আলাদা। হয়তো খুরশিদ এবং খুরশিদের মতো যাঁরা, তাঁদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে: তাঁরা কি বিদ্বান আইন-বিশেষজ্ঞ, যাঁরা বৈদগ্ধে্যর বিরল বিতর্কের সন্ধান করেন, না কি তাঁরা প্রাথমিকভাবে সক্রিয়, কঠোর রাজনীতিবিদ?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.