Advertisement
Advertisement

Breaking News

ইতিকথা নীতিকথা

রাজ্যে-রাজ্যে কংগ্রেসের সংগঠন যেভাবে মুখ থুবড়ে পড়ছে তারপর ‘ইতিকথা’-র অর্থ ব্যাখ্যা করার দরকার আছে কি? আর, নীতির প্রশ্নে অনড় থেকে সফল হওয়ার যে-মন্ত্র ধবনিত হচেছ সোনিয়া গান্ধীর কণ্ঠে, তা যেন ভরাডুবির নম্র কৈফিয়ত!

congress failure in assembly election in five states
Published by: Sangbad Pratidin Digital
  • Posted:May 25, 2016 11:14 am
  • Updated:May 25, 2016 11:14 am  

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: শেষমেশ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা ধার করে সাফাই গাইতে হল কংগ্রেসের ‘ফার্স্ট লেডি’ সোনিয়া গান্ধীকে! পাঁচ রাজ্যে দলের ভরাডুবির কৈফিয়ত দেওয়ার মতো কোনও কিছুই তাঁর ছিল না৷ অগত্যা বাঁচলেন দু’দিন আগে মমতার বলার কথার রেশ ধরে৷ বললেন, ‘ইফ ওয়ান স্টিক্স টু প্রিন্সিপল্স, নো ফেলিওর ইজ পার্মানেণ্ট৷’

কংগ্রেস-বামপন্থীদের নির্বাচনী জোটকে কটাক্ষ করে দু’দিন আগে মমতা বলেছিলেন, ‘যাদের নীতি ও আদর্শ থাকে না, তাদের কিছুই থাকে না৷ একটা সময় আমিও একলা হয়ে পড়েছিলাম৷ কিন্তু নীতির রাস্তা থেকে কখনও সরিনি৷ নীতি ও আদর্শ হারালে মানুষ সব হারায়৷’

Advertisement

নীতির কথা বলেছিলেন মমতা, সোনিয়াও নীতি ও আদর্শের ঢালের আড়ালে মান বাঁচাতে চাইলেন৷ কংগ্রেস সভানেত্রীর মুখে এই কথাটা কেমন নতুন নুতন লাগল৷ স্রেফ বিজেপির বিরুাচরণ ছাড়া এ-যাবৎ এই নীতি ও আদর্শের বাণী তাঁর মুখ থেকে কখনও বেরয়নি৷ চারদিক দিয়ে সমালোচনার তির ধেয়ে আসছে৷ প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র রাহুলের অক্ষমতা ঢাকতে প্রাণপাত করতে হচ্ছে৷ কোনওভাবেই দলে রাহুলের নিরুঙ্কুশ আসন পেতে দেওয়া সম্ভব হচেছ না৷ নির্বাচনী ব্যর্থতার দরুন বারবার তাঁকে পিছু হটতে হচেছ৷ এইরকম একটা অসহনীয় অবস্থায় আধ্যাত্মিকতায় গা না-ভাসিয়ে তিনি ভবিষ্যতের সোনালি রেখার আবাহন করলেন নীতি ও আদর্শের ডিঙিতে চেপে৷ তিনি জানেন, পৃথিবীতে চিরন্তন বলে কিছু হয় না৷ তিনি বোঝেন, একদিন না একদিন কোথাও না কোথাও দলীয়-ভাগ্যের চাকা ঘুরবেই৷ সেই সুদিনের আশাতেই তাঁর এই আশ্বাসবাণী৷ নিজের পরিবারের জন্য তো বটেই, দলের জন্যও, ভাগ্যের হাতে নিজেদের সঁপে দিয়ে৷

ভাগ্য তাঁর যতটা খারাপ, ততটাই ভাল তাঁর ‘চিরশত্রূ’ বিজেপির একমেবাদ্বিতীয়ম কান্ডারির৷ দিল্লি ও বিহারের পর নরেন্দ্র মোদির ‘ভ্যানিশ’ হয়ে যাওয়া ম্যাজিক নিয়ে যখন গবেষণা শুরু হব-হব করছে, ঠিক তখনই কী দুর্দান্তভাবে ফিরে এল মোদি-শাহ জুটির ভেলকি! এ শুধু ফিরে আসাই নয়, মোদির বড় সাধের স্লোগান ‘কংগ্রেসমুক্ত ভারত’কে প্রায় সার্থক করে তোলারই শামিল৷ অসম ছিনিয়ে নেওয়াটা বিজেপির পক্ষে যতটা কৃতিত্বের, ততটাই সন্তুষ্টির কেরলে ভোট-শতাংশ বাড়িয়ে বিধানসভায় খাতা খোলার সঙ্গে সঙ্গে কংগ্রেসের ঝাঁপ বন্ধ করে দেওয়া৷ কথায় বলে, ভগবান যখন দেন তখন নাকি ‘ছপ্পর ফাড়কে’ দেন৷ মোদির কপালে এবার সেই সৌভাগ্যের চন্দন ঈশ্বর নিজে হাতে লেপে দিলেন৷ দেখা গেল, কেরলের বাড়তি ভোট শতাংশ যতটা এসেছে কংগ্রেসের বাক্স থেকে, তার চেয়ে বেশি দিয়েছে বামপন্থায় বিশ্বাস করে আসা মানুষজন! তামিলনাড়ুর এক্সিট পোল আম্মার স্হলাভিষিক্ত করেছিল করুণানিধির প্রিয় পুত্র স্ট্যালিনকে৷ সেই গুড়ে বালি দিয়ে আম্মার টিকে থাকাটাও পুলকিত করেছে টিম মোদিকে৷ করবেই৷ আর যাই হোক, জয়ললিতা তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হলেও কেউ কাউকে কখনও একঘরে করেনি৷ আপদে-বিপদে বরং পাশে দাঁড়িয়েছে৷ একে অন্যকে বারবার ভরসা দিয়েছে৷

মমতার দ্বিতীয় ইনিংসও সেই অর্থে মোদির কাছে বসন্ত সমীরণের মতোই ফুরফুরে ও স্বস্তিদায়ক৷ এর একটা কারণ, রাজ্যে মমতার চ্যালেঞ্জার ‘নীতিহীন জোটের’ দুই শরিকের নিদারুণ ব্যর্থতা৷ কংগ্রেস ও বামপন্থীদের সঙ্গে বিজেপির সম্পর্কটা চিরকালই তেল ও জলের মতো৷ সেই শক্তিদ্বয়ের মুখ থুবড়ে পড়ার মধ্যে একটা তৃপ্তি তাই রয়েছে৷ দ্বিতীয় কারণ, প্রশাসক হিসেবে ক্রমশই মমতার বাস্তববাদী হয়ে ওঠা৷ যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় কেন্দ্রের সহযোগিতা ও সাহচর্য রাজ্যবাসীর জন্য যে প্রয়োজনীয়, মমতার এই উপলব্ধি কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ককে অনেকদিন ধরেই অনেকটা স্বাভাবিক করে তুলেছে৷ মোদি জানেন, ক্ষমতায় থাকার জন্য রাজনীতিক মমতাকে নিজ রাজ্যে বিজেপির বিরুাচরণ করতেই হবে৷ কিন্তু তিনি এ-ও জানেন, রাষ্ট্রীয় স্বার্থে সংসদের ভিতর ও বাইরে কেন্দ্রীয় শাসকদের সহযোগিতা দিতে মমতা কার্পণ্য করবেন না৷ এই উপলব্ধি ও বোধোদয় দুই মেরুকেই সমৃদ্ধ করায় মোদি এখন প্রয়োজনীয় আর্থিক সংস্কারের কাজগুলো হাতে নেওয়ার বিষয়ে আশাবাদী হতেই পারেন৷ ভোটের এই ফলাফল তাই মোদির দ্বিতীয় বছর পূর্তির প্রাক-মুহূর্তগুলি ঝলমলে করে তুলল৷ এতটাই যে, হীনবল কংগ্রেসের বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি সংসদের আাগমী অধিবেশনে অভিন্ন পণ্য ও পরিষেবা বিল (জিএসটি) পাসের বিষয়ে আশাবাদী হয়ে উঠছেন৷

নীতি ও আদর্শের কথা উচ্চারণের পাশাপাশি সেই একই দিনে মমতা আরও একটা অপ্রিয় অথচ সত্য কথা বলেছিলেন৷ তিনি বলেছিলেন, মোদির সবচেয়ে বড় সম্পদ রাহুল গান্ধী! যাঁর পিতাকে মমতা চিরদিন স্নেহপ্রবণ জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার আসনে বসিয়ে এসেছেন, মা সোনিয়াকে কোনও দিন অসম্মান করেননি, সেই অনুজপ্রতিম রাহুল সম্পর্কে তৃণমূলেশ্বরীর এহেন মন্তব্য কিছুটা বিস্ময়কর, সন্দেহ নেই৷ পার্ক সার্কাস ময়দানে বুদেব-রাহুলের অবিশ্বাস্য যুগলবন্দি হতে পারে ওই বিদ্রূপের কারণ৷ রাহুলের মতো এতবছর ধরে ‘অ্যাপ্রেণ্টিস’ থাকার সুযোগ দেশের আর কোনও রাজনীতিক কখনও পেয়েছেন কি না সন্দেহ৷ এত সুযোগ ও ঘষামাজা সত্ত্বেও নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে না পারার স্বাভাবিক বিস্ময়ও হয়তো ওইভাবে মমতার কণ্ঠে ঝরে পড়েছিল৷

আমার অবাক লাগে, এতদসত্ত্বেও শতাব্দীপ্রাচীন এই দলটার বাস্তুঘুঘুদের মধ্যে আদৌ কোনও হেলদোল নেই দেখে! দলের উপর থেকে নীচ পর্যন্ত আপনি কথা বলুন, সবাই একবাক্যে স্বীকার করবে, দলে সর্বভারতীয় স্তরে এমন কোনও মুখ নেই যাঁর দিকে তাকিয়ে সুদিনের ভরসা পাওয়া যায়৷ রাহুলকে দেখে সবসময়েই মনে হয়, তিনি এক অনিচ্ছুক রাজনীতিক৷ ক’দিন খুব তেড়েফুঁড়ে উঠলেন তো তারপর একেবারে চুপ৷ দলের সবাই যখন প্রিয়াঙ্কার দিকে চাতক-দৃষ্টিতে চেয়ে, সোনিয়া তখন বাণী দিচেছন, ‘নো ফেলিওর ইজ পার্মানেণ্ট’৷ তার চেয়ে তিনি যদি প্রিয়াঙ্কার ঘরের আগলটা টান মেরে খুলে দিয়ে বলতেন, আয়, এগিয়ে চল, বাজি ধরে বলা যায়, আসছে বছর ‘মিনি ইন্ডিয়া’ উত্তরপ্রদেশের নির্বাচন তা হলে সাতরঙে রাঙা হয়ে উঠবে৷

কিন্তু তা তিনি করবেন না৷ এত দ্বিধা, এতই দ্বন্দ্ব! কেন? তা কি স্রেফ নিজেদের ব্যর্থতাকে স্বীকার করে নেওয়া হবে বলে? উত্তর সোনিয়াই জানেন৷ আগামী বছর দেশের সাতটি রাজ্যে বিধানসভার ভোট৷ এর মধ্যে কংগ্রেসের হাতে রয়েছে তিনটি৷ হিমাচলপ্রদেশ, মণিপুর ও কোর্টকাছারি করে ফিরে পাওয়া হারানিধি উত্তরাখণ্ড৷ সোনিয়া-রাহুলের এতদিনের নেতৃত্ব অসমে যেমন তরুণ গগৈয়ের সার্থক উত্তরসূরিকে প্রতিষ্ঠা দিতে পারেনি, তেমনই পায়নি হিমাচলপ্রদেশে বিরাশি বছরের অবিসংবাদিত নেতা বীরভদ্র সিং-এর বিকল্পের সন্ধান৷ প্রথমে অরুণাচল কবজা, তারপর অসমে ড্যাং ড্যাং করে জেতার পর উত্তর-পূর্বের ছোট রাজ্যগুলি বিজেপি এবার টপাটপ গিলে ফেলতে চাইবে৷ মণিপুরের কংগ্রেস মুখ্যমন্ত্রী ওকরাম ইবোবি সিং তা রুখতে পারবেন কি না সংশয় রয়েছে৷ ছোট রাজ্য রয়েছে আরও একটি৷ গোয়া৷ বড় রাজ্য তিনটি৷ উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব ও গুজরাত৷ গুজরাত নিয়ে বিজেপির চিন্তা কম৷ মোদি-রাজ্যে কংগ্রেসই প্রধান শক্তি৷ মুখ্যমন্ত্রীর বদল ঘটিয়ে হাল শোধরানোর  একটা চেষ্টা বিজেপির একাংশ সেখানে করতে চাইছে৷ মোদি এখনও স্থির নিশ্চিত নন৷ তাঁর দুশ্চিন্তা গোয়া, পাঞ্জাব নিয়ে৷ এই দুই রাজ্যে এখনও পর্যন্ত খাতায়-কলমে কংগ্রেসই প্রধান চ্যালেঞ্জার৷ কিন্তু নিঃশব্দে দুই রাজ্যেই এগিয়ে এসেছে আমআদমি পার্টি৷ কংগ্রেসের বাড়া ভাতে তারা ছাই দিতে পারবে কি না সেই প্রশ্নের চেয়েও পাঞ্জাবে বড় হয়ে উঠছে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী ভোট ভাগাভাগিতে বাপ-বেটা দুই বাদলের সরকার টিকে থেকে মোদিকে আশ্বস্ত করতে পারবে কি না৷

বাকি থাকছে ‘ব্যাটল অফ দ্য ব্যাটলস’, মানে উত্তরপ্রদেশের মহাযুদ্ধ৷ কংগ্রেস এখনও পর্যন্ত সেখানে চতুর্থ খেলোয়াড়৷ কফিনের শেষ পেরেকটা তারা মারতে দেবে কি না, তাদেরই ঠিক করতে হবে৷ উত্তরপ্রদেশে ল্যাজে-গোবরে হলে ২০১৮ তে কর্নাটক ধরে রাখাও হয়ে যাবে কঠিন৷ মোদির কৃপায় দলে ফিরে আসা ইস্তক আহত ইয়েদুরাপ্পা রক্তাক্ত তালু চেটেই চলেছেন৷ মেন ল্যান্ড ইন্ডিয়ায় কর্নাটকই একমাত্র বড় রাজ্য যার দেউড়িতে কংগ্রেসের বাতি জ্বলছে৷

আগামী দু’বছরের রিপোর্ট কার্ডও যদি এই বছরের মতো হয়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হয়তো তা হলে আবার নতুন কিছু একটা বলতে হবে যা ধার করে সোনিয়া গান্ধী পরের বছরগুলোর অক্সিজেন জোগাড় করতে পারবেন৷

[email protected]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement