দিল্লিতে ‘ইন্ডিয়া’-র বৈঠকে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গের নাম প্রস্তাব করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
দিল্লিতে ‘ইন্ডিয়া’-র বৈঠকে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গের নাম প্রস্তাব করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অনেকে অসন্তুষ্ট হলেও, পাশে পেয়েছেন কেজরিওয়ালকে। বার্তা দিলেন, তিনি নিজে প্রধানমন্ত্রিত্বের রেসে নেই। বোঝালেন, রাজ্যস্তরে কংগ্রেসের বিরোধিতা থাকলেও জাতীয় স্তরে খাড়গেকে গ্রহণ করতে তাঁর কোনও ‘ইগো’ নেই। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল।
দিল্লিতে তিনদিন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (CM Mamata Banerjeee) এবার তিনদিনে তুলকালাম কাণ্ড করে ফিরে গেলেন। মমতা-বিরোধী রাজ্য সিপিএম এবং কংগ্রেস নেতারা রে-রে করে উঠেছেন, এদিকে জাতীয় রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে সোনিয়া গান্ধী, এমনকী, রাহুলও এবার মমতাকে সবিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন। দিল্লি আসার আগে রাহুল তৃণমূল নেত্রীকে ফোন করে এবারের জোট বৈঠকে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। হিন্দি বলয়ে তিন রাজ্যে দলীয় ভরাডুবির পর কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বের এই স্বাভাবিক বোধদয় হয়েছে যে, জোট রাজনীতির জন্য বামদের চেয়েও মমতাকে এখন প্রয়োজন অনেক বেশি।
এরপর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা ফিরে গেলেন। আপাতত প্রশ্ন, তিনি তিনদিনে যা-যা করলেন তার রাজনৈতিক তাৎপর্য কী? এই ঘটনাবলি সর্বভারতীয় ও রাজ্য রাজনীতিতে ঠিক কী প্রভাব ফেলতে পারে? বিশেষত, ২০২৪ সালের প্রাক্কালে এই ঝটিকা সফরের রূপ-রস, বর্ণ-গন্ধ নানা কারণে চিত্তাকর্ষক এবং সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির সম্ভাবনাময়।
তিনদিনে তৃণমূলনেত্রীর কাজকর্মের ময়নাতদন্ত করলে প্রথমেই বলতে হবে, উনি তিনদিনে কোনও কিছুই আচমকা করেননি। যা কিছু করেছেন তার নেপথ্যে আছে গভীর ভাবনা। এমনকী, কোনও সংবাদমাধ্যমে তঁার ‘প্ল্যান অফ অ্যাকশন’ আগাম ফঁাস হয়ে যায়নি।
প্রথম দিনে তিনি দলের সকল সাংসদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তিনি যখনই দিল্লিতে আসেন সবসময় দলের সাংসদদের সঙ্গে মুখোমুখি বৈঠকের আয়োজন করেন। যখন পুরনো সংসদের সেন্ট্রাল হল চালু ছিল, তখন সেখানে ‘বেঙ্গল কর্নার’-এ বাংলার তৃণমূল সাংসদদের সঙ্গে নেত্রী জবর আড্ডা মারতেন। খাওয়াদাওয়া হত। অনেক সময় গান-বাজনাও হত। এখন পুরনো সংসদ নেই। নতুন সংসদে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা। তবু মমতা সাংসদদের সঙ্গে বৈঠকের কর্মসূচি বাতিল করেননি। সংসদে বিরোধীদের অভূতপূর্ব সাসপেনশনের বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার হয়েছেন। মোদি-সরকার বিরোধী আক্রমণাত্মক বিরোধিতার সতীর্থদের কাছে দলীয় লাইন স্পষ্ট করে দেন।
এরপর, তিনি সার্কুলার রোডে নতুন বঙ্গভবনেই দেখা করলেন দিল্লির সম্পাদক-সাংবাদিকদের সঙ্গে। এটি সাংবাদিক বৈঠক ছিল না। ছিল মিডিয়া ইন্টার্যাকশন। এখানে প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক চ্যানেল, এমনকী, ডিজিটাল মিডিয়ার বিশিষ্ট সাংবাদিকরা ছিলেন। হাজির হন সংবাদমাধ্যমের কিছু মালিকও। এমনকী, সোশ্যাল মিডিয়ার বেশ কিছু জনপ্রিয় নেটিজেন, সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্সার পর্যন্ত ছিলেন। এই বৈঠকে অংশগ্রহণকারীদের কথাবার্তার সংখ্যাগত ও গুণগত বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়– ২০২৪ সালের লোকসভা ভোট যখন দরজায় কড়া নাড়ছে তখন মমতা সম্পর্কে সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমের আগ্রহ-কৌতূহল ষোলো আনার উপর আঠারো আনা। ১৯৮৪-তে মমতা সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে হারিয়ে লোকসভায় আসেন। কর্মসূত্রে আমি দিল্লি এসেছি ’৮৭ সালে। সেদিন থেকে এখনও পর্যন্ত প্রায় চার দশক ধরে দেখছি মমতাকে নিয়ে জাতীয় মিডিয়ার আগ্রহ প্রবল।
এবার সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে মমতা বলেন, ‘দেখুন, আমার ইংরেজিতে ভুল থাকতে পারে, হিন্দিভাষীদের মতো হিন্দি না-ও বলতে পারি। কিন্তু আপনাদের প্রতিটি প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব আমি দিচ্ছি। আমার জবাবে কোনও ধূসরতা নেই।’ অর্থাৎ, মমতা প্রথমেই যা বলেন তার মর্মকথা, ‘no grey area, I can call a spade a spade.’ আর ‘আমি আপনাদের জন্য সবসময় অ্যাভেলেবল।’ সাংবাদিকদের মধ্যে একজন উঠে বলেন, এ ব্যাপারে আমরা সবসময়ই আপনার তারিফ করি। দেশের প্রধানমন্ত্রী তো আজ পর্যন্ত কোনও সাংবাদিক বৈঠক পর্যন্ত করেননি!
এই ‘মিট দ্য প্রেস’ চা-চক্রের আয়োজনের নেপথে্যর প্রধান মস্তিষ্ক অভিষেক বন্দে্যাপাধ্যায়ের। তঁারা একসঙ্গেই দিল্লি এসেছেন। এমনকী, সাংবাদিক বৈঠকের সময়ও তিনি বঙ্গভবনেই ভিতরে ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মমতার বৈঠকেও অন্য সাংসদদের সঙ্গে অভিষেক ছিলেন, ছিলেন ‘ইন্ডিয়া’ বৈঠকেও। কিন্তু মঞ্চে মমতার উপরই ছিল ফ্লাডলাইট। সচেতনভাবেই অভিষেক ছিলেন পাদপ্রদীপের আড়ালে। বলতে পারেন,
এ-ও এক যৌথ রণকৌশল। বরং যারা ‘দিদি বনাম ভাইপো’-র বিরোধের কল্পকাহিনি রচনায় মশগুল, তারা যথেষ্ট হতাশ।
সাংবাদিকদের এই কথোপকথন প্রথমে ‘অফ দ্য রেকর্ড’ রাখার কথা বলা হয়। ক্যামেরাও থাকবে না। সবটাই অফ ক্যামেরা এটা দলের পরিকল্পনা থাকলেও বাস্তবে দেখা গেল, সাংবাদিকরা প্রায় প্রত্যেকেই মোবাইলে মমতার কথোপকথন রেকর্ড করছেন। এ ব্যাপারে মমতার দিক থেকে কোনও অাপত্তি ছিল না। তিনি বলেই দেন, ‘যা বলছি সবই অন রেকর্ড। আই ডোন্ট হ্যাভ এনিথিং টু হাইড।’
কী বললেন, মমতা? তিনি বললেন, কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করতে তিনি রাজি। রাজে্য যদি
বামেরা কংগ্রেসের সঙ্গে জোটবদ্ধ থাকে, সেটা কংগ্রেসের ব্যাপার। এই ‘১:১ আসন’ সমঝোতার প্রস্তাব দিয়ে তিনি মোদি ও বিজেপি বিরোধিতায় জোটগঠনের স্পষ্ট বার্তা দিয়ে দেন, পরের দিন জোট বৈঠকের আগেই।
দ্বিতীয় দিন, ‘হোটেল অশোক’-এ ‘ইন্ডিয়া’-র বৈঠকে তিনি কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গের নাম প্রস্তাব করেন। অনেকে অসন্তুষ্ট। এমনকী, লালুপ্রসাদ ও নীতিশ কুমারও।
এই প্রস্তাবে মমতা কিন্তু এক ঢিলে অনেক পাখি মেরেছেন। প্রথমত, এই নাম প্রস্তাব করে তিনি বার্তা দিলেন, তিনি নিজে প্রধানমন্ত্রিত্বের রেসে নেই। তৃণমূল মুখপাত্ররা-সমর্থকেরা তঁাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে চাইতেই পারেন। যেমন, আপ-মুখপাত্ররা কেজরিওয়ালের নাম বলেছিলেন, ডিএমকে সমর্থকেরা বলেছেন স্ট্যালিনের নাম। সেখানে মমতা ও কেজরিওয়াল এই প্রস্তাব দিয়ে আরও বোঝালেন যে, কংগ্রেস যতই রাজ্যস্তরে তঁাদের বিরোধিতা করুক না কেন, জাতীয় স্তরে খাড়গেকে গ্রহণ করতে মমতার কোনও ইগো সমস্যা নেই।
তৃতীয়ত, খাড়গে দক্ষিণ ভারত ও দলিত সমাজের প্রতিনিধি। কংগ্রেসের ভিতরেও এই আলোচনা চলছিল। (যেমন, মোদির বিরুদ্ধে প্রিয়াঙ্কাকে প্রার্থী করার প্রস্তাব চলছিল।) উত্তরপ্রদেশের কংগ্রেসের সভাপতি এই প্রস্তাব সমর্থন করেছেন। দক্ষিণ ভারতে প্রায় ১৪০টি আসন। খাড়গের নাম আলোচনা হলে তা দক্ষিণ ভারতেও ভাল প্রভাব ফেলবে। অনেকে বলছেন, মমতা এই নাম বলায় সোনিয়া গান্ধীও নিজে অখুশি নন। খাড়গেকে লোকসভায় প্রার্থী করার কথাও তো দল অনেক দিন থেকেই ভাবছে।
মমতার এ প্রস্তাব তো কংগ্রেস দলের ভিতর নাক গলানো নয়। কোনও আনুষ্ঠানিক স্ট্রাকচার্ড প্রোপোজালও নয়। ভোটের পরই প্রধানমন্ত্রী ঠিক হবে এ-কথাও তো মমতাই বলেছেন, কিন্তু মোদি যখন লড়াইকে রাহুল বিরোধী করতে চাইছেন, তখন খাড়গের মুখ সামনে নিয়ে আসা বিরোধীদের সমবেত মাস্টারস্ট্রোক হতে পারে। কারণ, কংগ্রেসই তো প্রধান বিরোধী দল। তাছাড়া কংগ্রেস দলেক কাজে নাক না-গলালেও জোটের রাজনীতি ঘরোয়াভাবে খাড়গের নাম প্রস্তাব করার মধে্য কোনও অস্বাভাবিকতা নেই।
পরদিন মমতা বৈঠক করলেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। সিপিএম ও রাজ্য কংগ্রেসের কিছু নেতা এই বৈঠককে ‘সেটিং’ হিসাবে অভিহিত করেছেন। কিন্তু স্ট্যালিন দু’দিন আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করলেও কংগ্রেস সেই সাক্ষাৎকে ‘সেটিং’ আখ্যায়িত করেনি। কেরলের মুখ্যমন্ত্রী সোনা পাচারের মামলা ওঠার সঙ্গে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করলেও সে ব্যাপারে সিপিএম-কংগ্রেস নীরব। কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রীও তো বৈঠক করলেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে।
সেজন্য মমতা এবার সাংসদদের প্রতিনিধি দল নিয়ে গিয়েছেন। ১০০ দিনের কাজের বকেয়া টাকা আদায়ের আন্দোলনে এ তো পুরনো ঘোষিত কর্মসূচি। সাংসদদের সাসপেনশনের প্রতিবাদে মমতা এই বৈঠক বয়কট করেননি। করেননি, সে-ও তো রণকৌশল। যেদিন দিল্লি এসে অভিষেক আন্দোলন শুরু করেন, সেদিন মমতা বিদেশে ছিলেন, সেখান থেকে মোবাইলে পুরো আন্দোলনটি দেখেন। তারপর রাজভবন অভিযান।
তৃতীয় দিন, মুখ্যমন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী বৈঠক করলেন। আমার তো মনে হচ্ছে মমতা এই বৈঠকে বিজেপিকেই উভয় সংকটে ফেলেছেন। প্রধানমন্ত্রী যদি সময় না দিতেন, তাহলে মমতা হয়তো-বা বলতেন, ‘প্রধানমন্ত্রী সময় দিলেন না। গরিব মানুষের বকেয়া টাকার ব্যাপার। এখন অফিসার নিয়োগ করে যৌথভাবে সমস্যার সমাধান হবে।’
কেন্দ্র বকেয়া মিটিয়ে দিলে ভোটের মুখে মমতার বিরাট জয়। আবার না দিলে রাজে্যর প্রতি বঞ্চনা অব্যাহত। অভিষেক বলেছিলেন, কোথাও গরমিল বা সমস্যা থাকলে সেগুলো চিহ্নিত করা হোক। সেগুলো বাদ দিয়ে বাকি টাকা দেওয়া হোক। তা বলে সমস্ত টাকাই বন্ধ করা মানে তো রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র!
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মাত্র চারবার বৈঠক করলেন। আমার মনে হয়, রাজনীতি রাজনীতির জায়গায় থাক, প্রশাসনের ক্ষেত্রে ডা. বিধান রায়, জে্যাতি বসু ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য-র ট্র্যাডিশন মেনে মমতার আরও বেশি করে বৈঠক করা উচিত।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.