মণিশংকর চৌধুরি: সোমবার লোকসভায় পেশ হতে চলেছে বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল (ক্যাব)। নির্বাচনী ইস্তেহারে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ করে, পাকিস্তান, আফগনিস্তান, বাংলাদেশে ‘নিপীড়িত’ সংখ্যালঘুদের ভারতে আশ্রয় দিতে প্রস্তুত দ্বিতীয় মোদি সরকার। ‘সাম্প্রদায়িকতা’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র অবমাননার অভিযোগ এনে পালটা দিতে তৈরি বিরোধীরাও। ভারতের অন্যান্য প্রদেশে এই বিতর্কিত বিলের তেমন একটা জোরদার প্রতিবাদ না হলেও, কার্যত ফুঁসছে উত্তর-পূর্ব ভারত। অসম-সহ ‘সেভেন সিস্টার’ উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে গেরুয়া শিবিরের ‘শাঁখের করাত’ হয়ে উঠেছে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল।
মনে রাখতে হবে, উত্তর-পূর্ব ভারতের জনবিন্যাস, সংস্কৃতি এবং সমস্যা দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে অনেকটাই আলাদা। বিদেশি, বিশেষ করে ‘বাংলাদেশি’ অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে প্রায় সবক’টি রাজ্যেই প্রবল ক্ষোভ রয়েছে। রাজনীতির দাড়িপাল্লায় পরিস্থিতি মাপতে গেলে দেখা যাচ্ছে- অসম ও ত্রিপুরা ছাড়া উত্তর-পূর্বের বাকি রাজ্যগুলিতে আঞ্চলিক দলের হাত ধরেই কিন্তু ক্ষমতায় রয়েছে বিজেপি। মেঘালয়ে মুখ্যমন্ত্রী কনরাড সাংমার দল এনপিপি থেকে মিজোরামে জোরামথাঙ্গার এমএনএফ-এর সঙ্গে জোট সরকার–আঞ্চলিক দল ছাড়া ‘ট্রাইবাল’ বা আদিবাসী অধ্যুষিত রাজ্যগুলিতে হিন্দুত্ব বা গো-বলয়ের রাজনীতিকে আশ্রয় করে অস্তিত্ব বাঁচাতে পারবে না পদ্মশিবির। অসমেও উগ্র অসমিয়া জাতীয়তাবাদ উসকে বাংলাদেশি বিতাড়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েই ক্ষমতায় এসেছে দলটি। সেই মতো সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে নাগরিকপঞ্জি নবায়িত করতে গিয়ে দেখা গেল, বাদ পড়ছে ১৯ লক্ষ মানুষ, যার মধ্যে প্রায় ১২ লক্ষই হিন্দু বাঙালি। খুশি নন অসমিয়ারাও। এ যেন- ‘শিরে সর্পাঘাত হইলে তাগা বাঁধি কোথা।’ অথচ, হিন্দু ভোটব্যাংক বাঁচাতে হলে তাগা বাঁধতেই হয়।
[আরও পড়ুন: ‘ধর্ষকদের ফাঁসি দেখে যেতে চাই’, মৃত্যুর আগে বলেছিলেন উন্নাওয়ের নির্যাতিতা]
সমস্যার সমাধান খুঁজতে গতমাসের শেষের দিকে উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলির মুখ্যমন্ত্রী, ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দিল্লিতে বৈঠকে বসেন অমিত শাহ। বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলভুক্ত ও আইএলপি (ইনার লাইন পারমিট) বা যে সমস্ত রাজ্যে প্রবেশের জন্য আলাদা অনুমতিপত্র প্রয়োজন হয়, সেই সমস্ত এলাকা নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের আওতায় আসবে না। বলে রাখা ভাল,অসম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরামের স্বায়ত্বশাসিত এলাকাগুলি সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলভুক্ত। অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড ও মিজোরামে প্রবেশ করতে গেলে প্রয়োজন হয় আইএলপি-র। বিজেপির দাবি, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাশ হলেও এর প্রভাব পড়বে না উত্তর-পূর্বের জনবিন্যাসে। উল্লেখ্য, অসমে ষষ্ঠ তফসিলভুক্ত তিনটি স্বায়ত্বশাসিত পরিষদ আছে, যথাক্রমে– বড়োল্যান্ড টেরিটোরিয়াল কাউন্সিল, ডিমা হাসাও অটোনমাস কাউন্সিল ও কারবি আংলং অটোনমাস ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল। ওই এলাকাগুলির জমির সত্ত্ব সম্পূর্ণরূপে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর। বাকি রাজ্যগুলিতে রয়েছে একাধিক এমন পরিষদ। ফলে অসমের উপমুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার দাবি, ক্যাব পাশ হলেও ভূমিপুত্রদের স্বার্থে কোনও আঘাত আসবে না। তাঁদের স্বকীয়তা বজায় থাকবে।
এবার প্রশ্ন হচ্ছে, উত্তর-পূর্বে বিশেষ করে অসমে বসবাসকারী বাঙালি, সে হিন্দুই হোক বা মুসলমান, ক্যাব পাশ হলে তাঁদের ভবিষ্যৎ কী হবে? ইতিহাসবিদদের একাংশের মতে, অসমের বাঙালিদের দু’টি অংশে ভাগ করা যায়। প্রথমটি হচ্ছে, যাঁরা ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় বর্তমানের সিলেট (যা অসমের অংশ ছিল) বা পূর্ব-পাকিস্তান থেকে ১৯৭১-এর ২৪ মার্চের মধ্যে অসমে চলে আসেন। দ্বিতীয় অংশটি, যাঁরা ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের পর মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ থেকে অসম, ত্রিপুরা বা উত্তর-পূর্বের অন্য রাজ্যে প্রবেশ করেছিলেন। এক্ষেত্রে ক্যাব পাশ হলে বা না হলেও প্রথম অংশটির বিশেষ কিছু সমস্যা হবে না। কারণ অসম চুক্তি অনুযায়ী, ১৯৭১-এর ২৪ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের নাগরিকত্ব দেওয়া নিয়ে কোনও বাধা নেই। কিন্তু, খানিকটা সমস্যায় পড়বেন দ্বিতীয় অংশের মানুষজন বা যাঁরা ৭১-এর ২৪ মার্চের পর অসমে প্রবেশ করেন। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে ওই সময়সীমার পর অসমে আসা এবং নাগরিকপঞ্জিতে নাম না থাকা মুসলমান সম্প্রদায়ের বাঙালিদের ‘রাষ্ট্রহীন’ হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে তফসিলভুক্ত স্বায়ত্বশাসিত পরিষদ এলাকা, যেমন–কারবি আংলং ও বোড়োল্যান্ডে থাকা হিন্দু বাঙালিদের নাগরিকত্ব পাওয়া নিয়েও সমস্যা তৈরি হবে। ওই এলাকাগুলি ক্যাবের আওতায় না আসায় সেখানকার বাঙালিরা নাগরিকত্ব পাওয়ার আবেদন জানতে পারবেন না।
এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে অসমের বিজেপি বিধায়ক শিলাদিত্য দেব বলেন, ‘ক্যাব পাশ হলে ভূমিপুত্রদের কোনও সমস্যা হবে না। তবে ওই এলাকায় বাঙালি ও গোর্খাদের মতো অন্য সম্প্রদায়ের অনেক মানুষ রয়েছেন, তাঁদের ক্যাবের আওতায় আসতে একটু অসুবিধা হতে পারে। সেই সমস্যা পর্যায়ক্রমে মিটিয়ে নেওয়া হবে।’ তবে উলটো সুর শোনা গিয়েছে অসমের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈয়ের গলায়। তাঁর মতে, ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব প্রদান করা সংবিধান বিরোধী। এতে সংবিধানের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। অসন্তোষের সুর শোনা যাচ্ছে খোদ বাঙালিদের একাংশের গলায়ও। ‘সারা অসম বাঙালি যুব ছাত্র ফেডারেশন’ এর সভাপতি দীপক দে বলেন, “আমরা বাঙালিদের জন্য শর্তহীনভাবে নাগরিকত্ব চাই। এই নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ত্রুটিপূর্ণ। অখণ্ড ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন, আজ তাঁদেরই বংশধরদের নাগরিকত্ব চাইতে হচ্ছে। অসম চুক্তির ছয় নম্বর দফা রূপায়নের জন্য কেন্দ্র কমিটি বানিয়েছে। এর ভিত্তিবর্ষ ১৯৫১ করে ‘খিলঞ্জিয়া’দের (ভূমিপুত্র) জন্য চাকরি বা শিক্ষার ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। এর ফলে অসমের বাঙালিরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হবে। অথচ ‘খিলঞ্জিয়া’ শব্দের সংজ্ঞাই আজ পর্যন্ত ঠিক করা যায়নি। ফলে ক্যাব পাশ হলেও আমাদের কী লাভ হবে বুঝতে পারছি না।”
এদিকে, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাশ হলে জ্বলবে অসম বলে ইতিমধ্যেই হুঙ্কার দিয়েছে ‘অল অসম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন’-সহ একাধিক সংগঠন। প্রতিবাদে সরব হয়েছেন সাহিত্যিক হীরেন গোহাই থেকে শুরু করে বিখ্যাত গায়ক জুবিন গর্গ। ১৯৭১-এর পর ভগবান এলেও অসমে জায়গা দেওয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন জুবিন। সব মিলিয়ে এই বিতর্কিত বিলটি ঘিরে ফের কি আটের দশকের রক্তাক্ত দিনগুলি ফিরবে উত্তর-পূর্বে? তা সময়ই বলবে।
[আরও পড়ুন: ৫ বছর ভারতে থাকলেই নাগরিকত্ব! অমুসলিম শরণার্থীদের জন্য দরাজ মোদি সরকার]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.