সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: কথায় বলে, গরিবের ঘরে সুখস্বস্তি নাকি চিরস্থায়ী হয় না! ভারতের দক্ষিণী প্রতিবেশীদের দিকে তাকালে এই কথাটা টোকা মেরে যাচ্ছে। এতদিন ধরে টালমাটাল থাকা মালদ্বীপকে মোটামুটি সামলে ভারত যখন স্বস্তির শ্বাস ফেলতে শুরু করেছে, ঠিক তখনই প্রায় বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো ধেয়ে এল নতুন সংকট শ্রীলঙ্কা থেকে। এর সামাল কবে কীভাবে দেওয়া যাবে, এখনও তার বিন্দুমাত্র ইঙ্গিত নেই। ভারতের নীতি আপাতত অপেক্ষা ও অবলোকনের।
আমার বলতে দ্বিধা নেই, এই শনিবার, ১৭ নভেম্বর, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যখন মালদ্বীপের নতুন ‘ভারতপ্রেমী’ প্রেসিডেন্ট ইবু সোলিহ-র শপথ গ্রহণের সাক্ষী হবেন, তাঁর মন তখন কিন্তু পড়ে থাকবে শ্রীলঙ্কায়। নিশ্চয়ই ভাববেন, মালদ্বীপকে চিনা প্রভাবমুক্ত করতে যে কালঘাম ছোটাতে হয়েছে, শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে তার দ্বিগুণ পরিশ্রম অপেক্ষায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও স্বস্তি পাওয়া যাবে কি না, বা পেলেও কতদিনে তা এখনও অজানা!
[শ্রীলঙ্কায় ডামাডোল অব্যাহত, সুপ্রিম রায়ে বড় ধাক্কা সিরিসেনার]
শ্রীলঙ্কার চমকটা নিতান্তই ‘অপ্রত্যাশিত’ এবং তুমুল নাটকীয়তায় ভরা। ক্ষমতা থেকে যাঁর বিদায়ের পর ভারত নিশ্চিন্ত বোধ করেছিল এবং সেই স্বস্তি যিনি দিয়েছিলেন, শ্রীলঙ্কার সেই দুই রাজনীতিক হাতে হাত মিলিয়ে ফেলেছেন। দু’জনে দেশের প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমসিংঘে-কে শুধু বেকায়দাতেই ফেলেননি, সৃষ্টি করেছেন ঘোর সাংবিধানিক সংকটেরও। সেই সংকট চওড়া করেছে ভারতের বলিরেখা। কারণ, মালদ্বীপের মতো এখানেও নেপথ্যে রয়েছে চিন।
মাহিন্দা রাজাপক্ষ এবং মৈথিরিপালা সিরিসেনা দু’জনেই ছিলেন শ্রীলঙ্কা ‘ফ্রিডম পার্টি’-র নেতা। রাজাপক্ষ প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন দ্বীপরাষ্ট্রে চিনের প্রভাব বাড়তে থাকে। বৈদেশিক ঋণে জর্জরিত দেশটিকে চিন চালাতে থাকে তার স্বার্থ অনুযায়ী। চিনের ‘হাতের পুতুল’ হয়ে যান প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষ। ভারতের বলিরেখা গভীরতর হওয়ার শুরুও সেই থেকে। ভারতকে স্বস্তি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন সিরিসেনা। দেশের প্রেসিডেন্ট হয়ে ‘ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি’-র (ইউএনপি) নেতা রনিল বিক্রমসিংঘে-কে প্রধানমন্ত্রী করে দেশকে চিনাপ্রভাব থেকে মুক্ত করার আশা জাগিয়ে তিনি ভারতকে আশ্বস্ত করেছিলেন। কিন্তু পাঁচ বছর কাটার ঢের আগে আমে-দুধে মিশে যাওয়ার মতো রাজাপক্ষকে কাছে টেনে বিক্রমসিংঘেকে আঁটির মতো তিনি ছুড়ে দেবেন, ভারত তা ভাবতে পারেনি। যখন বুঝল, ততদিনে জল অনেকটাই গড়িয়ে গিয়েছে। আপাতত চলছে প্রধানমন্ত্রীর কুরসি দখলের লড়াই, যে লড়াই গড়িয়েছে সে দেশের সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত।
শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টের মোট সদস্য সংখ্যা ২২৫। ২০১৫ সালের ভোটে রাজাপক্ষ-সিরিসেনার ‘ফ্রিডম পার্টি’ পেয়েছিল ৯৫ আসন, বিক্রমসিংঘের দল ‘ইউএনপি’ ১০৫। রাজাপক্ষকে সরিয়ে ‘ফ্রিডম পার্টি’-র ক্ষমতা দখল করে বিক্রমসিংঘে-কে প্রধানমন্ত্রী করে দেশ চালাতে শুরু করেন সিরিসেনা। কোণঠাসা রাজাপক্ষর অনুগামীরা ‘ফ্রিডম পার্টি’ থেকে বের হয়ে নতুন দল গড়েন। নাম: ‘শ্রীলঙ্কা পিপল্স পার্টি’। আঞ্চলিক নির্বাচনে শাসক গোষ্ঠীদের হারিয়ে ‘পিপল্স পার্টি’ তার জনপ্রিয়তার প্রমাণ দেওয়ার পর থেকে রাজাপক্ষ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার লক্ষ্যে আদা-জল খেয়ে নামেন। অতি দ্রুত ঘটে যায় কিছু ঘটনা। ২৬ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী বিক্রমসিংঘে-কে বরখাস্ত করেন সিরিসেনা, এবং নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন রাজাপক্ষকে। বিক্রমসিংঘে তা মানতে অস্বীকার করেন। পার্লামেন্টের স্পিকার কারু জয়সূর্য তাঁর পক্ষে দাঁড়ান। যদিও পরে বলেন, সরকারি গেজেট মেনে নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে রাজাপক্ষকে ৫ নভেম্বর আস্থা ভোট নিতে দেবেন। কিন্তু তার আগেই ঘটে যায় একের পর এক বিপত্তি। একদিকে ত্রিশঙ্কু অবস্থা, অন্যদিকে বরখাস্ত প্রধানমন্ত্রী সরতে নারাজ এবং নতুন প্রধানমন্ত্রী দল ভারী করতে ব্যর্থ। নতুন প্রধানমন্ত্রী গরিষ্ঠতা প্রমাণে ব্যর্থ হলে দায় বর্তাবে প্রেসিডেন্টের উপর। বিপদ দেখে সিরিসেনা পার্লামেন্ট ভেঙে দেন। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের দিন ঘোষণা করেন। তীব্রতর হয়ে ওঠে দ্বীপরাষ্ট্রের রাজনীতি। বিদায়ী প্রধানমন্ত্রীর সমর্থনে দাঁড়িয়ে পড়েন পার্লামেন্টের স্পিকার, প্রধান বিরোধী দল ‘তামিল ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স’ (টিএনএ), বামপন্থী ‘জনতা বিমুক্তি পেরামুনা’ বা ‘পিপল্স লিবারেশন ফ্রন্ট’ এবং নির্বাচন কমিশনের এক সদস্য। সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচনের ডাক দেওয়ার সিদ্ধান্তকে তাঁরা চ্যালেঞ্জ করেছেন সুপ্রিম কোর্টে। দাবি, সিরিসেনা সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। দেশে রক্ত ঝরতে শুরু করেছে। আপাতত সর্বত্র কী হয় কী হয় ভাব!
এসব যে ঘটতে চলেছে ভারতের কি তা জানা ছিল না? প্রশ্নটি উঠছে, কারণ, ঘটনাবলি বাঁক নিয়েছে অতি দ্রুত। ২৬ অক্টোবর বরখাস্ত হওয়ার মাত্র একসপ্তাহ আগে বিক্রমসিংঘে সরকারি সফরে ভারত ঘুরে যান। তারও একসপ্তাহ আগে ‘ব্যক্তিগত’ সফরে এসেছিলেন রাজাপক্ষ। প্রাক্তন প্রেসিডেন্টকে সময় দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। রাজাপক্ষ সেই সফরে দেখা করেছিলেন রাহুল গান্ধীর সঙ্গেও। সাউথ ব্লকে কানাকানি, অতীতের ‘ভুল’ শোধরানোর ঐকান্তিক ইচ্ছার কথাটি রাজাপক্ষ নাকি ভারতীয় নেতাদের জানিয়ে গিয়েছিলেন। সেই ‘ভুল’ যা সে দেশের তামিল জাত্যাভিমানকে আহত করেছিল এবং দেশটিকে চিনের মুঠোয় তুলে দিয়েছিল। একদা প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষ যে এবার দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে ইচ্ছুক, ততদিনে ভারতীয় নেতৃত্বের কাছে বিষয়টি গোপন ছিল না। প্রশ্ন হল, ভারত কি রাজাপক্ষকে ‘বিশ্বাস’ করছে? বিশেষ করে সেই রাজাপক্ষ, যাঁর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মারাত্মক অভিযোগ রয়েছে, দেশের তামিল জনতা এখনও যাঁকে ক্ষমা করেনি এবং যাঁর আচরণের দরুন ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের এক বিপুল জনগোষ্ঠী এখনও তাঁর প্রতি ক্ষিপ্ত?
এভাবে চোখ ওলটানোয় সিরিসেনার প্রতি ভারতের আস্থাতেও কি টোল পড়বে না? ইতিমধ্যেই ‘ফ্রিডম পার্টি’-র ৪৪ জন সদস্য নতুন দল ‘পিপলস পার্টি’-তে যোগ দিয়েছেন। রাজাপক্ষও আনুষ্ঠানিকভাবে নাম লিখিয়েছেন সেই দলে। ভারতের পক্ষে সুখের কথা, ৫ জন ছাড়া বিক্রমসিংঘের দল এখনও অটুট। তামিল জোটের ১৬টি আসনও রাজাপক্ষর বিরুদ্ধে। জেভিপির ছয় সাংসদও রাজাপক্ষর দিকে যাবেন না। এটাও মন্দের ভাল যে, এত কিছুর পরেও সিরিসেনা-রাজাপক্ষ জুটি তাঁদের পক্ষে ১০১ জনের বেশি সাংসদের সমর্থন আদায় করতে পারেননি। প্রয়োজন যেখানে ১১৩ জনের সমর্থন। ভারতকে আশা জোগাচ্ছে আন্তর্জাতিক দুনিয়াও। সিরিসেনা সরকারের বিদেশমন্ত্রী শরৎ অমুনুগম দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে বিদেশি কূটনীতিকদের এক বৈঠক ডেকেছিলেন। ব্রিটেন, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, কানাডা ও ইটালির রাষ্ট্রদূতরা সেই বৈঠক উপেক্ষা করেন। আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জার্মানির রাষ্ট্রদূতেরা নিজেরা না গিয়ে প্রতিনিধিদের পাঠিয়েছিলেন। ভারতও পাঠিয়েছিল একজন ‘জুনিয়র’ প্রতিনিধিকে। স্পষ্টতই, সিরিসেনা-রাজাপক্ষর যুগলবন্দির আন্তর্জাতিক অনুমোদনপ্রাপ্তি এখন আতশকাচের তলায়।
[ইজরায়েল ভূখণ্ডে রকেট হামলা হামাসের, পালটা সন্ত্রাসীদের ডেরায় হানা]
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার সবচেয়ে খারাপ। চার শতাংশেরও নিচে। দেনার ভার বছরে দেড় বিলিয়ন ডলার। দেনা মেটাতে অক্ষম দেশটা ২০১৬ সালে হামবানটোটা বন্দরের ৮০ শতাংশ ৯৯ বছরের জন্য লিজ দিয়ে দেয় ‘চায়না মার্চেন্টস পোর্টস হোল্ডিং কোম্পানি’-কে। ভারতকে তিনদিক দিয়ে ঘিরে ধরার চিনা ছক ‘স্ট্রিং অফ পার্লস’-এর অন্যতম এই হামবানটোটা বন্দর। যে মানুষটি ওই দেশে চিনা অনুপ্রবেশের মস্ত বড় কারিগর, সেই রাজাপক্ষর ফের মাথাচাড়া দেওয়ার মধ্য দিয়ে নতুন সুনামির সংকেত ভারত দেখতে পাচ্ছে। রাজাপক্ষ-সিরিসেনা নতুন সমীকরণের পালে বাতাস লাগলে বিক্রমসিংঘের উপর বাজি ধরা ছাড়া আর কোনও উপায় ভারতের থাকবে না। সেই বিক্রমসিংঘে, গত তিন বছর প্রধানমন্ত্রী থাকা সত্ত্বেও দেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলীয় তামিল অধ্যুষিত অঞ্চলের স্বশাসনের বিষয়টি যিনি সংবিধানে ঢোকাতে পারেননি। চিনকে দূরে রাখতে সিংহলিদের এই ক্ষমতার লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত বিক্রমসিংঘে যদি মিত্র হয়ে ওঠেন, ভারতকে তাহলে তাঁর জন্য তামিল সমর্থন জোগাড়ের বিষয়টি নতুন করে ভাবতে হবে।
চিনাপ্রভাব নেপালে ভারতকে পিছু হটিয়েছে। চিন নিয়ে ভুটানে নতুন ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে। মায়ানমারে চিনকে হটিয়ে ভারতের দাঁত ফোটানো এখনও অকল্পনীয়। শ্রীলঙ্কা ত্রিশঙ্কু হয়ে ঝুলে থাকছে। স্বস্তিদায়ক বলতে এপাশে আপাতত মালদ্বীপ, ওপাশে শেখ হাসিনার বাংলাদেশ। ক্ষমতার পঞ্চম বছরটি তাই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জন্য স্বস্তি ও সংশয়ের দোলনায় পেন্ডুলাম হয়ে থাকছে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.