চিন সীমান্তে উত্তেজনা বাড়লেই বুঝতে হবে, চিনের তরফে কোনও জটিল রাজনৈতিক বার্তা ভারতকে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। তাওয়াংয়ের সাম্প্রতিক সংঘর্ষে ভারতীয় সেনারা তাদের শৌর্য প্রদর্শন করেছে। কিন্তু সামরিক পদক্ষেপের পাশাপাশি সমস্যার রাজনৈতিক প্রেক্ষিতও খেয়াল রাখতে হবে। আর্থিক ব্যয়ও। কলমে সুতীর্থ চক্রবর্তী
তাওয়াং নিয়ে উত্তপ্ত সংসদের শীতকালীন অধিবেশন। চিনা সেনাদের সঙ্গে সংঘর্ষের ছবি প্রকাশ্যে চলে এসেছে। ঘটনা পূর্ব-লাদাখের গালওয়ানের মতো অতটা ভয়ংকর ও ভয়াবহ না হলেও উদ্বেগজনক। পূর্ব-লাদাখে যেমন ভারতীয় জমি দখল করতে করতে ধীরে ধীরে এগনোর চেষ্টা করেছিল চিন, তেমন ঘটনা তাওয়াংয়ের ক্ষেত্রেও। তবে তাওয়াংয়ের সংঘর্ষে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু, একাধিক ভারতীয় সেনা আহত হয়ে হাসপাতালে। এক্ষেত্রে ভারতীয় সেনাদের সাহসী লড়াই চিনকে নতুন করে কোনও এলাকা দখল করতে দেয়নি বলেই বিভিন্ন সূত্রের খবর।
তাওয়াংয়ে যে উঁচু-উঁচু পাহাড় চূড়া ভারতীয় সেনাদের দখলে, সেগুলিকেই নিশানা বানিয়ে আক্রমণ করতে চাইছে চিন। এসব পাহাড় চূড়া থেকে ভারত চিনের দখলিকৃত অঞ্চলে নজর রাখে। চিন তাদের দখলিকৃত এলাকায় ‘শাওকাং’ নামে এক ধরনের গ্রাম তৈরি করেছে। রাষ্ট্রীয় ব্যয়ে অপেক্ষাকৃত সচ্ছল এই গ্রামে তারা দু’-ধরনের বসতি তৈরি করছে। লাল ফৌজের কিছু প্রাক্তন সেনা সেখানে পরিবার নিয়ে থাকছে, আবার কিছু কর্মরত সেনাকেও গ্রামগুলিতে রাখা হয়েছে। এই ‘শাওকাং’ তৈরির উদ্দেশ্যও দ্বিবিধ। একদিকে ভারতের জমি ধীরে ধীরে নিজেদের দখলে আনা এবং অন্যদিকে অরুণাচলের নিয়ন্ত্রণরেখা সংলগ্ন এলাকার গ্রামবাসীদের বার্তা দেওয়া। কী বার্তা- দেখো, ‘শাওকাং’ গ্রামগুলিতে বাসিন্দারা কত ভাল আছে!
২০২০ সালের মে মাসে গালওয়ানে সংঘর্ষের (Galwan Clash) সময় থেকে ভারত-চিন সীমান্ত ও ‘প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা’ ধরে যে-উত্তেজনা তৈরি হয়েছে, তা কমার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। গত বছরের সেপ্টেম্বরেও তাওয়াংয়ে সংঘর্ষ হয়। যদিও এই ছোট ছোট সংঘর্ষ থেকে যুদ্ধ লাগার মতো পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার শঙ্কা কোনও পক্ষই করছে না। গালওয়ানে উত্তেজনা কমানোর জন্য এখন স্থানীয় স্তরে দুই দেশের সেনাকর্তাদের মধ্যে নিয়মিত আলোচনা চলছে। অরুণাচলের ক্ষেত্রেও একই কৌশল গ্রহণ করেছে দুই দেশ। ৯ ডিসেম্বরের সংঘর্ষের পরই স্থানীয় স্তরে শান্তি বৈঠক হয়েছে। কিন্তু সীমান্ত বা নিয়ন্ত্রণরেখায় যুদ্ধের দামামা বাজা মানেই তার একটা প্রভাব ভারতের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামগ্রিক সমাজ-জীবনে অনিবার্য।
অরুণাচলের সংঘর্ষের পরেও যথারীতি দেশের রাজনীতিতে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। বিরোধীদের সম্মিলিত আক্রমণের ফলে কিছুটা হলেও কেন্দ্রের শাসক দলকে ব্যাকফুটে যেতে হয়েছে। বিরোধীদের দাবি সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় সরকার এখনও পর্যন্ত অরুণাচল নিয়ে সংসদে আলোচনায় যেতে রাজি নয়। পাল্টা হিসাবে বিজেপি জাতীয়তাবাদের হুজুগ তৈরির যে কোনও চেষ্টা চালাবে না, তা বলা যায় না। উত্তর-পূর্বের চার রাজে্য যে ফেব্রুয়ারিতেই বিধানসভা ভোট, সেটা মাথায় রাখতে হবে।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সীমান্তে উত্তেজনা সবসময়ই ক্ষতিকর। সীমান্ত বা নিয়ন্ত্রণরেখায় উত্তেজনা বাড়লে দেশের সরকারকে সামরিক খাতে ব্যয়বৃদ্ধি করতে হয়। সামরিক খাতে ব্যয়বৃদ্ধি মানেই জনকল্যাণের বরাদ্দ কিছুটা হলেও ছাঁটাই হওয়া। ভারতের (India) মতো দরিদ্র দেশে রাষ্ট্র জনকল্যাণে ও সম্পদ নির্মাণে যত বেশি অর্থ বরাদ্দ করতে পারবে, তত মঙ্গল। যুদ্ধ বা প্রতিবেশী কোনও দেশের সঙ্গে সংঘর্ষের পরিস্থিতি হলে তা সম্ভব নয়। বিশেষত, চিনের সঙ্গে যেসব এলাকায় সীমান্ত বা নিয়ন্ত্রণরেখা ঘিরে বিরোধ, সেগুলি সবই অত্যন্ত দুর্গম অঞ্চলে। পশ্চিমদিকে বিরোধের ক্ষেত্র লাদাখ, পূর্বে অরুণাচল প্রদেশ। আপাতত সিকিম সীমান্তে শান্তি রয়েছে। দুর্গম পাহাড়ি এলাকাগুলিতে সেনাবাহিনীর প্রহরা দিতে ও সামরিক জোগান পৌঁছতে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়। উত্তেজনা তৈরি হলে এসব এলাকায় সেনার সংখ্যা বাড়াতে হয়। তাতে খরচও বাড়ে গুণোত্তর প্রগতিতে। সীমান্তে স্থায়ী শান্তি একমাত্র দেশের অহেতুক এই অর্থব্যয়কে রোধ করতে পারে।
এই শতকের গোড়া থেকেই দেখা যাচ্ছে, চিনের সরকার ভারতের সঙ্গে সীমান্ত ও নিয়ন্ত্রণরেখা ধরে একটা উত্তেজনার পরিবেশ জিইয়ে রাখতে তৎপর। চৌ. এন. লাইয়ের জমানায় চিনের অবস্থান ছিল, যে-জমি তাদের দখলে আছে সেটা তাদের। যেটা ভারতের দখলে আছে, সেটা ভারতের। যদিও এই অবস্থান ভারত কখনও মেনে নেয়নি। পরে দেং জিয়াও পিং-ও ভারতের সঙ্গে চৌ. এন. লাইয়ের নীতিতেই সমঝোতায় আগ্রহী ছিলেন। আকসাই চিনের দাবি ছেড়ে দিয়ে ভারতের পক্ষে এই ধরনের সমঝোতায় যাওয়া কখনওই সম্ভব ছিল না। তাছাড়া ভারত চিনের অরুণাচলের দাবি কিছুতেই মানতে পারে না। দেং-উত্তর জমানায় চিনের অবস্থান অনেকটাই বদলায়। চিনের নয়া অবস্থান- ভারতের যে-জমি তাদের দখলে রয়েছে, সেটা তো তাদেরই। উপরন্তু ভারতের অধীনে থাকা কিছু এলাকাও তাদের। শি জিনপিংয়ের আমলে চিন আরও আগ্রাসী ভূমিকা নিতে শুরু করেছে। এখন তারা বলছে, তাদের দখলে থাকা আকসাই চিন তো তাদেরই, পূর্ব-লাদাখ ও অরুণাচলও তাদের।
এই শতকের গোড়ায় সামরিক ক্ষেত্রে ভারত আমেরিকার কৌশলগত সহযোগী হওয়ার পর থেকেই স্পষ্টত চিনের অবস্থানের এই বদল। আর্থিক উদারীকরণের পর এশিয়ার এই প্রান্তে ভারত আর্থিক শক্তি হিসাবেও বিকাশলাভ করছে। চিনের কাছে এটাও সবসময় উদ্বেগের। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাজার দখলে রাখা চিনের অর্থনীতির স্বার্থে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে তারা ভারতকেই একমাত্র চ্যালেঞ্জার মনে করে। ফলে দু’টি ঘটনা চিনের অবস্থান বদলের ক্ষেত্রে মূল অনুঘটক।
যখনই চিন সীমান্ত বা নিয়ন্ত্রণরেখায় উত্তেজনা বাড়ে, তখনই বুঝতে হবে যে, চিনের তরফে কোনও জটিল রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বার্তা ভারতকে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। ভারতকে চিনের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রয়োজনমতো সামরিক পদক্ষেপ করতেই হবে। তাওয়াংয়ের সাম্প্রতিক সংঘর্ষে ভারতীয় সেনারা তাদের শৌর্য প্রদর্শন করেছে। বস্তুত, প্রকাশিত ছবিতেই দেখা গিয়েছে, ভারতীয় সেনাদের তাড়া খেয়ে চিনা সেনারা কার্যত পালাচ্ছে। কিন্তু সামরিক পদক্ষেপের পাশাপাশি সমস্যার রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রেক্ষিতও খেয়াল রাখতে হবে। এক্ষেত্রে কি মোদি সরকারের ভূমিকায় কোনও গাফিলতি হচ্ছে? বিরোধীদের অভিযোগ সেরকমই। কেন সংসদে তাওয়াং নিয়ে আলোচনায় মোদি সরকার সম্মত হচ্ছে না, সেই প্রশ্নের সদুত্তর নেই। সংসদে এই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হলে সরকারের তরফে ব্যর্থতার দিকগুলি স্পষ্ট হতে পারত। বিরোধীদের তরফে প্রয়োজনীয় পরামর্শও উঠে আসত।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.