ভারতের অঙ্গরাজ্য অরুণাচল প্রদেশ চিনের চোখে ‘দক্ষিণ তিব্বত’। নিয়মিত ভারতকে তারা তা মনেও করিয়ে দেয়। এই অঞ্চল দখলের অসমাপ্ত কাজ তারা সারতে চায় ২০৩৫ থেকে ২০৪০ সালের মধ্যে। আপাতত চলছে তারই রিহার্সাল। ভারতের সামরিক প্রস্তুতির সিংহভাগ এখন তাই চিনকেন্দ্রিক। কাশ্মীরের পাশাপাশি চিন্তা বাড়াচ্ছে ‘এলএসি’ বরাবর চিনা উপস্থিতি। লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
বোঝার উপর শাকের আঁটির মতো ভারতের নিরাপত্তাব্যবস্থায় নতুন উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে গত অক্টোবরে। আফগানিস্তানের পালাবদল দেশের পশ্চিম সীমান্তকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করেছে আগেই। অক্টোবরে তা গভীর দুশ্চিন্তায় পরিণত হল উত্তরের প্রতিবেশীর সৌজন্যে। এমন তিনটি ঘটনা চিন (China) ঘটিয়েছে, যা ভারতকে আরও সতর্ক করে তুলেছে। উদ্বিগ্নও। পরপর সেই তিন ঘটনা বোঝায়, উত্তরের প্রতিবেশী একটা বিশেষ ছক অনুযায়ী এগিয়ে চলেছে। সেই ছকেই প্রবাহিত তাদের কূটনীতি ও সামরিক প্রস্তুতি।
প্রথম ঘটনাটি ১৪ অক্টোবরের। ভুটানের সঙ্গে তাদের দীর্ঘদিনের সীমান্ত-বিরোধ মেটাতে চিন সেদিন একটা বোঝাপড়ায় পৌঁছয়। সেই বোঝাপড়ার আনুষ্ঠানিক পরিচয় ‘থ্রি স্টেপ রোডম্যাপ’। বোঝাপড়ায় এল সেই ভুটান, যার সঙ্গে চিনের এখনও কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই এবং ভারত যার ‘রক্ষক’। রক্ষকের দায়িত্ব পালন করতে ২০১৭ সালের জুন মাসে ত্রিদেশীয় সীমান্ত অঞ্চল ডোকলামে চিনের আগ্রাসী ফৌজকে ভারত বাধা দিয়েছিল। সেই গ্রীষ্মে ৭৩ দিনের টানটান প্রতিরোধের পর চিন সরে গেলেও তক্কে তক্কে থেকেছে ভারতকে তফাতে রেখে ভুটানের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধের সরাসরি মীমাংসার লক্ষ্যে। কাজটা তারা সেরে ফেলল চার বছরের মধ্যেই, ভারতকে দর্শকের পর্যায়ে নামিয়ে এনে। বিস্মিত ভারতের বিদেশ মন্ত্রক শুধু বলেছে, ‘আমরা ঘটনাবলির দিকে নজর রেখেছি।’
এই গুরুত্বপূর্ণ সমঝোতার দশদিনের মধ্যে, ২৩ অক্টোবর, চিনের পার্লামেন্টের স্থায়ী কমিটির অনুমোদন পায় গুরুত্বপূর্ণ ও নতুন ‘স্থল সীমান্ত আইন’। সে-দেশের সরকারি সংবাদ সংস্থা ‘জিনহুয়া’ জানিয়েছে, দেশের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষার উদ্দেশ্যে আগামী বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ওই আইন কার্যকর হবে। এই আইনে কাশ্মীর, উত্তরাখণ্ড, হিমাচল প্রদেশ, সিকিম ও অরুণাচল প্রদেশজুড়ে ৪ হাজার ৫৬ কিলোমিটার প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা (এলএসি) বরাবর চিনা ফৌজ একগাদা আইনি অধিকার পাচ্ছে। তারা এখন সর্বত্র প্রতিরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো তৈরি করতে পারবে। বর্ডার টাউন বা সীমান্ত নগর স্থাপন করতে পারবে (তিব্বতে ইতিমধ্যেই ৬০০ নগর তৈরি হয়েছে)। সেখানকার অসামরিক বাসিন্দাদের প্রতিরক্ষা-প্রশিক্ষণ দিতে পারবে। স্থল সীমান্তে নিরাপত্তার পক্ষে ক্ষতিকর কিছুর আঁচ পেলে লাল ফৌজ সংঘাতের পথে হাঁটতেও পারবে। এই আইনের পর প্রতিবেশীদের সঙ্গে সীমান্ত বোঝাপড়ার মর্যাদা কতটা রক্ষিত হবে, ভারত তা নিয়ে সংশয়ী।
এই দুই ঘটনার মধ্যবর্তী কোনও এক সময়ে চিন এই প্রথম ‘হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র’ পরীক্ষাও করেছে বলে পশ্চিমি দুনিয়ার দাবি। এটাই অক্টোবরের ‘তৃতীয় ঘটনা’।
একটু রাখঢাক করে এই কথা বলতে হচ্ছে, কেননা চিন ‘হাইপারসনিক মিসাইল’ পরীক্ষার কথা স্বীকার করেনি। তারা বলেছে, ওটা নাকি ছিল এক মহাকাশযান। চিন যাই বলুক, আমেরিকা এই ঘটনায় হতবাক। পেন্টাগনের শীর্ষকর্তা মার্ক মিলি বলেছেন, ‘এটা আর-একটা স্পুটনিক মোমেন্ট।’ সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘স্পুটনিক ১’ ছিল পৃথিবীর প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ, যা ১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবর উৎক্ষেপণ করা হয়। সেটি ছিল মার্কিনিদের কাছে অবাক করার মতো এক ঘটনা। হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষাকেও মার্ক মিলি তেমনই গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে চেয়েছেন।
কেন এত গুরুত্ব? কারণ, আমেরিকা ও রাশিয়া (Russia) এখনও এমন পরীক্ষা করে উঠতে পারেনি। চিন যেটা করেছে বলে আমেরিকার দাবি, তা অন্য ক্ষেপণাস্ত্রের মতো টার্গেট হিট করে না। সেটা অত্যন্ত নিচু দিয়ে পৃথিবী পরিক্রমা সেরে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে। কোথায় হিট করবে, সে আন্দাজও গোপন রাখে। ক্ষেপণাস্ত্রটি রাডারের নজর এড়াতেও সক্ষম। আমেরিকার চোখে তাই এটা ‘স্পুটনিক মোমেন্ট’!
তিনটি ঘটনা পারস্পরিক সম্পর্কযুক্তই শুধু নয়, চিনের দীর্ঘমেয়াদি ছকেরও অঙ্গ। সেই ছক, যা নিয়ে আট বছর আগে, ২০১৩ সালে, ‘অস্ট্রেলিয়ান স্ট্র্যাটেজিক পলিসি ইনস্টিটিউট’-এর ‘দ্য স্ট্র্যাটেজিস্ট’ পত্রিকায় লিখেছিলেন চিন-বিশেষজ্ঞ ইতিহাসবিদ এবং ‘অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি’-র ভিজিটিং ফেলো জিওফ ওয়েড। চিনা ভাষার সংবাদ সংস্থা ‘ঝংগুও শিনওয়েং শি’-তে প্রকাশিত সেই ছকের উল্লেখ করে জিওফ ওয়েড তাঁর নিবন্ধে (“চায়না’জ সিক্স ওয়ারর্স ইন দ্য নেক্সট ফিফটি ইয়ার্স”) লিখেছিলেন, আগামী ৫০ বছরের মধ্যে চিন ছ’টি যুদ্ধ লড়তে প্রস্তুত হচ্ছে, যা বিশ্বে তাদের কর্তৃত্ব কায়েমের পাশাপাশি ‘হাইপার ন্যাশনালিস্ট’ চরিত্রও প্রতিষ্ঠা করবে। সেই ছকের নমুনাগুলো এখন ধীরে ধীরে উন্মোচিতও। চিনকে রুখতে প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার চতুর্দেশীয় জোট ‘কোয়াড’-এর তাই এত তৎপরতা। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলকে চিনের আগ্রাসন থেকে মুক্ত রাখতে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও ব্রিটেনের ত্রিদেশীয় ‘অকাস’ চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। বিশ্বশক্তির নজরও এখন পুরোপুরিই চিনকেন্দ্রিক।
চিনের সেই ছয় যুদ্ধের প্রথমটি তাইওয়ান দখল। ‘ঝংগুও শিনওয়েং শি’-র ছক অনুযায়ী ২০২০ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে চিন ওই লক্ষ্যপূরণে আগ্রহী। দ্বিতীয়ত, দক্ষিণ-চিন সাগরের যে-দ্বীপগুলোয় নিজেদের কর্তৃত্ব কায়েমের জন্য চিন বদ্ধপরিকর, পরের পাঁচ বছরে, অর্থাৎ ২০৩০-এর মধ্যে তা তারা হাসিল করতে চায়। তৃতীয় লক্ষ্য নিয়ে কথা বলার আগে বরং চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ লক্ষ্য স্পষ্ট করা যাক। চতুর্থ লক্ষ্য হল, ২০৪০-’৪৫-এর মধ্যে পূর্ব চিন সাগরে ডিয়াওইউডাও (Dioyudao) ও রিউকিউ (Ryukyu) অর্থাৎ, সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জ ‘পুনরুদ্ধার’। পঞ্চম যুদ্ধের লক্ষ্য, ২০৫০-এর মধ্যে বহির্মঙ্গোলিয়া দখল এবং ষষ্ঠ যুদ্ধ রাশিয়ার কব্জা থেকে তাদের ‘জমি’ উদ্ধার। শেষের এই কাজটি তারা সারতে চায় ২০৫৫-’৬০ সালের মধ্যে।
চিনের তৃতীয় যুদ্ধ, অরুণাচল প্রদেশ দখলের লক্ষ্যে। ভারতের এই অঙ্গরাজ্য তাদের চোখে ‘দক্ষিণ তিব্বত’। নিয়মিত ভারতকে তারা তা মনেও করিয়ে দেয়। এই অসমাপ্ত কাজ তারা সারতে চায় ২০৩৫ থেকে ২০৪০ সালের মধ্যে। আপাতত চলছে তারই রিহার্সাল।
চিনের এই রোডম্যাপ ‘হাইপার ন্যাশনালিস্টিক’ বা অতি-জাতীয়তাবাদী অভিপ্রায় বলে উপেক্ষা করা যেতেই পারে। কিন্তু শি জিনপিংয়ের জমানায় তা করা হারাকিরির সমতুল্য। সাম্প্রতিক ঘটনাবলির গতিপ্রকৃতি বোঝায়, চিনা অভিপ্রায় নিছক আকাশকুসুম কল্পনাবিলাস নয়। ডোকলাম পর্বের অনেক আগে থেকেই অরুণাচল প্রদেশ নিয়ে তারা সরব। ইদানীং, তীব্রতা আরও বেড়েছে। বারবার ঘটছে লাল ফৌজের অনুপ্রবেশ। চিত্রনাট্য মেনে। বিষয়টিকে তারা জিইয়ে রাখতে চায়। বারবার মনে করিয়ে দিতে চায়, ওই ভূখণ্ড অরুণাচল প্রদেশ নয়, তাদের হকের ‘দক্ষিণ তিব্বত’!
ভারতের সামরিক প্রস্তুতির সিংহভাগ এখন তাই চিনকেন্দ্রিক। তালিবান প্রত্যাবর্তনের পর কাশ্মীরে নিয়ন্ত্রণরেখা নিয়ে ভারত অবশ্যই চিন্তিত। কিন্তু তার চেয়েও বেশি চিন্তা ‘এলএসি’ বরাবর চিনা উপস্থিতি। রাফালের ঘাঁটি তাই হরিয়ানার আম্বালা ও পশ্চিমবঙ্গের কলাইকুন্ডা, হাসিমারা। অরুণাচল প্রদেশ সীমান্তে মোতায়েন হয়েছে আমেরিকার চৈনিক যুদ্ধ-হেলিকপ্টার, অত্যাধুনিক হাউইৎজার, এল-৭০ এয়ার ডিফেন্স ব্যবস্থা ও সুপারসনিক ক্রুজ মিসাইল। পাহাড়ি যুদ্ধে পারদর্শী নতুন ‘মাউন্টেন স্ট্রাইক ফোর্স’ (৯০ হাজার জওয়ান)-এর সদর হয়েছে পানাগড়। ‘এলএসি’ বরাবর যুদ্ধকালীন তৎপরতায় গড়া হচ্ছে রাস্তা, সেতু, হাসপাতাল, এয়ার স্ট্রিপ-সহ সামরিক পরিকাঠামো। চিনা তৎপরতার জবাবে ‘অগ্নি ৫’-এর সফল উৎক্ষেপণ জানান দিয়েছে, গোটা চিন এখন পরমাণু-শক্তিধর ‘অগ্নি ৫’-এর আওতায়।
খচখচানি কাশ্মীর নিয়ে। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সেনানীর বড় ভরসা স্থানীয় মানুষের সাহচর্য ও সমর্থন। সংঘাতের আবহে পাকিস্তান ও চিনের দ্বিমুখী মোকাবিলায় উপত্যকার ভারতীয় বাহিনী সেই সাহচর্য ও সহায়তা কতটা পাবে- ভাবনার বিষয়। ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপ-পর্বে রাজ্যসভায় গুলাম নবি আজাদ এই কথাটাই মনে করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, কাশ্মীরি জনগণের এত দশকের ‘বাফার জোন’ নষ্ট করে সরকার যেন হাত না কামড়ায়। শিয়রে সংঘাত। উপত্যকায় আস্থা, ভরসা ও বিশ্বাসের ঘাটতি অথচ বেড়েই চলেছে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.