যুগ পাল্টেছে, সমাজ পাল্টেছে, টাকাও পাল্টে গিয়েছে৷ পাল্টায়নি শুধু মানুষ৷ কারণ মানুষ সর্বভুক৷ জঠরকে রসেবশে রাখতে মানবিকতাকে পর্যন্ত বিক্রি করতে পারে৷ লিখছেন সুপর্ণা মজুমদার৷
Advertisement
কাক নাকি কাকের মাংস খায় না৷ কিন্তু মানুষ সর্বভুক৷ জঠরকে রসেবশে রাখতে মানবিকতাকে পর্যন্ত বিক্রি করতে পারে৷ বিকিকিনির এই বাজারে প্রাণ যত ছোট, তার মূল্য ততধিক৷ বর্ণবিদ্বেষ এখানে বহাল তবিয়তে বর্তমান৷ লিঙ্গভেদেও দাম ওঠানামা করে৷ শুধুমাত্র প্রাণের ভূমিষ্ঠ হওয়ার অপেক্ষা৷ সঙ্গে সঙ্গে নিলামে উঠে যায় কচি প্রাণগুলি৷ ছেলে হলে লক্ষের নিচে কোনও কথা নেই৷ মেয়ে হলে আশি হাজার থেকে দাম শুরু৷ তারপর রঙের চুলচেরা বিশ্লেষণ৷ গায়ের রং কালো হলে তাও একটু কমে ছাড়া যায়, ফর্সা সুন্দর শিশুকন্যার কিন্তু কদর বেশি৷
এই চল আজকের নয়৷ চলছে দশকের পর দশক ধরে৷ শহর থেকে শহরতলী সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে এই এই বিশাল জাল৷ সুতোয় টান পড়ছে বাদুড়িয়ায়৷ ছোট একটি বিস্কুটের প্যাকেটে ভরা ছিল দুই সদ্যোজাত৷ প্রসবের রক্ত তখনও লেগেছিল তাদের সারা শরীরে৷ মাত্র কয়েকঘণ্টার জীবনেই কচি প্রাণদুটি হয়ে উঠেছিল পণ্য৷ কানে টান পড়তেই পুলিশের হাতে চলে এল মাথা৷ এক নয় একাধিক৷ উল্লেখযোগ্য কলেজ স্ট্রিটের শ্রীকৃষ্ণ নার্সিংহোমের মালিক পার্থ চট্টোপাধ্যায়, তাঁরই পুত্রবধূ পারমিতা চট্টোপাধ্যায় ওরফে দেবযানী, বেহালার সত্যেন রায় রোডের সাউথ ভিউ নার্সিংহোমের মালকিন পুতুল বন্দ্যোপাধ্যায় ওরফে বড়দি, সেই নার্সিংহোমের দেখভালের দায়িত্বে থাকা প্রভা প্রামাণিক ওরফে মেজদি, পাচারচক্রের মূল মধ্যস্থতাকারী উৎপলা ব্যাপারী ওরফে পলি, চিকিৎসক সন্তোষকুমার সামন্ত এবং সাম্প্রতিক পুতুল ওরফে বড়দির কন্যা রিনা বন্দ্যোপাধ্যায়৷
মাথার সূত্র ধরেই মিলল দেহের হদিশ৷ ঠাকুরপুকুরের পূর্বাশার তিনতলার ঘরে ঢুকেই শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গিয়েছিল দুঁদে পুলিশ ও গোয়েন্দাদের৷ মাটিতে পাতা মাদুর আর ছোট্ট কাঁথার উপর পড়ে রয়েছে ১০টি শিশু কন্যা৷ প্রত্যেকেরই বয়স ১ থেকে ১০ মাসের মধ্যে৷ উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠাতে না পাঠাতেই আবার উড়ো ফোন৷ মছলন্দপুরের সুজিত দত্ত মেমোরিয়াল ট্রাস্টের পাশের জমিতে নাকি একাধিক শিশুর দেহ পোঁতা রয়েছে৷ ফের হাবড়ার দিকে ছুটলেন পুলিশ ও গোয়েন্দারা৷ দু’টি সদ্যোজাতর কঙ্কাল উদ্ধার হল৷
কেঁচোর গর্তে যে এত বড় কালসাপ ঘাপটি মেরে রয়েছে কে জানত! তা পুলিশ কেন, আশেপাশের মানুষেরও আন্দাজ করতে পারেননি৷ হ্যাঁ, রাতবিরেতে সিরিয়ালের বিজ্ঞাপনের ফাঁকে কয়েকটি গাড়ি আসতে যেতে দেখেছেন বটে, তবে মাকড়সার এই জালের আন্দাজ কোনওদিন কেউ করতে পারেননি৷
কিন্তু, কেন? গোয়েন্দাদের অনুমান, খুবই সন্তর্পণে করা হত এই কাজ৷ সমাজসেবার আড়ালে ছোট্ট প্রাণগুলিকে পণ্য হিসেবে দেওয়া হত এই বিশেষ পরিষেবা৷ দেশ-বিদেশের সীমা ছাড়িয়েছে লক্ষ লক্ষ টাকার এই লেনদেন৷ গোপনীয়তা বজায় রাখতে কখনও প্রসূতিকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কাজ সারা হত, কখনও তাঁর অজান্তেই ঘটে যেত পুরো ঘটনা৷ গুদামঘর হিসেবে ব্যবহার করা হত পূর্বাশার তিনতলার ঘরটিকে৷ মোটা দেওয়ালের মধ্যেই আটকে রয়ে যেত শিশুগুলির কান্না৷
তারপর চাহিদা অনুযায়ী জোগান৷ যেখানে প্রয়োজন সেখানে৷ আজ ধরা পড়েছে৷ সংবাদের শিরোনামেও এসেছে৷ পুলিশের টনক নড়েছে৷ তারপর? তারপর মানুষের ক্ষণস্থায়ী স্মৃতি থেকে লোপ পেয়ে যাবে সবকিছু৷ বর্তমানের চাঞ্চল্য ঠাঁই পাবে ইতিহাসের আর্কাইভে৷ সময় পাল্টাবে, সমাজ পাল্টাবে৷ পাল্টাবে না শুধু মানুষ৷ নতুন টাকায় নতুন করে শুরু হবে ব্যবসা৷ ফের মানুষের হাতে মানুষই হবে পণ্য৷
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.