উৎপাদন শুল্ক সামান্য কমিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার পেট্রোল-ডিজেলের দামবৃদ্ধির তিরটি বিরোধী শাসিত রাজ্য সরকারগুলির দিকে ঘোরাতে চাইছে। কেন্দ্র বরং ভাবুক কীভাবে তৈল উৎপাদনকারী দেশগুলির উপর চাপ তৈরি করে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম কমানো যায়! লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী
দলের জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকে নরেন্দ্র মোদি (Narendra Modi) বার্তা দেওয়ার পর ২৪ ঘণ্টা কাটতে না কাটতে যেভাবে দিলীপ ঘোষ, সুকান্ত মজুমদাররা জ্বালানিতে ভ্যাট কমানোর দাবিতে রাস্তায় নেমে পড়লেন, তা বেশ বিসদৃশ।
কর্মসমিতিতে কী বার্তা দিলেন মোদি?
দলের নেতা ও কর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, মানুষ ও দলের মধ্যে বিশ্বাসের সেতু হিসাবে তাঁদের কাজ করতে হবে। দলের কর্মী ও নেতাদের তিনি স্মরণ করিয়েছেন, বিজেপিকে লোকে শাসকদল হিসাবেই দেখে। শাসক দলের কাজ হল, মানুষকে সেবা দেওয়া। ‘হচ্ছে না, হবে না’ বলে আন্দোলন করা নয়। মোদির কথায়- ‘সেবা, সংকল্প ও দায়বদ্ধতার মূল্যবোধকে ভিত্তি করে বিজেপি চলে।’ পেট্রোল ও ডিজেলের দাম কেন এত বেশি, তা নিয়ে যখন দেশের মানুষ মোদি সরকারের দিকে আঙুল তুলছে, তখন দিলীপ-সুকান্তরা জ্বালানিতে ভ্যাট কমানোর দাবিতে রাস্তায় নেমে কী বার্তা দিতে চাইলেন? দেখে তো মনে হল, প্রধানমন্ত্রীর বার্তাই তাঁরা অমান্য করলেন।
জ্বালানির দাম নিয়ে গত কয়েক দিন ধরেই দেশে একটি ‘ব্লেম গেম’-এর আবহ। উৎপাদন শুল্ক সামান্য কমিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার বস্তুত পেট্রোল-ডিজেলের দামবৃদ্ধির তিরটি বিরোধী-শাসিত রাজ্য সরকারগুলির দিকে ঘুরিয়ে দিতে চাইছে। বিরোধী দলগুলি বলতে শুরু করেছে, ‘লুঠ করল একজন, আর ক্ষতিপূরণ দেবে অন্যজন, এটা কীভাবে সম্ভব?’ ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর মোদি সরকার পেট্রোল ও ডিজেলের উপর শুল্ক থেকে আয় করেছে ২৩ লক্ষ কোটি টাকা। অথচ এখন তারা বলছে, রাজ্যগুলি ভ্যাট কমিয়ে মানুষকে সুবিধা দিক। রাজ্যগুলি এই প্রস্তাব মানবে কীভাবে?
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও মন্তব্য করেছেন, কোভিড পরিস্থিতির মধ্যেও যারা পেট্রোল ও ডিজেলের উপর শুল্ক থেকে চার লক্ষ কোটি টাকার বেশি আয় করেছে, তারা কীভাবে ভ্যাট কমানোর কথা বলে? রাজ্যের খরচ কোথা থেকে আসবে? তৃণমূল কংগ্রেস আগেই ঘোষণা করেছে, কেন্দ্র ও রাজ্যের কর কাঠামোয় সমতা না আসা পর্যন্ত ভ্যাট কমানোর প্রশ্ন নেই। কেন্দ্র ও রাজ্যের কর কাঠামোয় যে বিস্তর ফারাক, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। রাজ্যের মূল আয়ের সূত্র ছিল ভ্যাট তথা বিক্রয় কর। সংবিধান পরিবর্তন করে সেই বিক্রয় কর চাপানোর ক্ষমতা রাজ্যের হাত থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
জিএসটি জমানায় রাজ্য আর নিজের ইচ্ছামতো বিক্রয় কর বাড়িয়ে-কমিয়ে আয় বাড়াতে পারে না। যদিও দেশের সংবিধান অনুসারেই, সরকারি খরচের সিংহভাগ রাজ্যকেই করতে হয়। রাজ্যের হাতে একমাত্র আয়ের সূত্র পেট্রোল-ডিজেলের উপর ভ্যাট। এই ভ্যাট বসানোর ক্ষমতা একমাত্র রাজ্যের হাতে রয়েছে। রাজনৈতিক চাপ তৈরি করে কেন্দ্রীয় সরকার যে প্রকারন্তরে সেই ক্ষমতাটাই কেড়ে নিচ্ছে, বিরোধীদের এই বক্তব্য একেবারে অযৌক্তিক বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি যখন ক্ষমতায় এসেছিলেন তখন পেট্রোল-ডিজেলের উপর কেন্দ্রীয় করের পরিমাণ ন’টাকা ছিল। যেটা বাড়তে বাড়তে ৩২-৩৩ টাকায় পৌঁছেছিল। এখন সেই উৎপাদন শুল্ক থেকে পাঁচ-দশ টাকা ছাড় দেওয়া হয়েছে। এটুকু ছাড় দিয়ে এখনও কেন্দ্রীয় শুল্কের পরিমাণ পেট্রোল-ডিজেলে যথেষ্ট। শুধু যথেষ্টই নয়, রাজ্যগুলি যে ভ্যাট পেট্রোল-ডিজেলের উপর থেকে আদায় করে, কেন্দ্রীয় করের হার এখনও তার চেয়ে অনেকটা বেশি। কেন্দ্রীয় সরকারের জ্বালানির খাতে কর চাপিয়ে যে আয়, তার সঙ্গে রাজ্যগুলির ভ্যাট থেকে আয়ের কোনও তুলনাই হয় না। ফলে রাজ্যগুলি যদি ভ্যাট কমানোর আগে কর কাঠামোয় সমতা দাবি করে, তাহলে অন্যায়টা কোথায়?
বাজারে আমরা যে-দামে জ্বালানি তেল কিনি, তার চারটি অংশ। একটি অংশ হল তেলের দাম, যা আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দামের উপর নির্ভরশীল। দ্বিতীয় অংশ কেন্দ্রীয় কর। তৃতীয় অংশ রাজ্যের বসানো ভ্যাট। চতুর্থ অংশটি হল ডিলারদের কমিশন। এই চার অংশের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দামের বিষয়টি প্রধান। তেলের দামের সঙ্গে এক্ষেত্রে বিদেশি মুদ্রার বিনিময় হারটিও প্রাসঙ্গিক। যেহেতু দেশের জ্বালানির চাহিদা ৮০ শতাংশ মেটাতে হয় বিদেশ থেকে আমদানি করে, তাই বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার কী থাকে, তার উপর নির্ভরশীল দেশের বাজারের জ্বালানির দাম। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বলতে প্রধানত টাকার বিনিময়ে ডলারের হারকেই আমরা বুঝি। মোদি সরকার যখন ক্ষমতায় এসেছিল, তখন আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেল তথা ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ১০৫ ডলার ব্যারেল প্রতি ছিল। ওই সময় দেশের বাজারে পেট্রোল ছিল ৭১ টাকা লিটার। এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম ৮৩ টাকা ব্যারেল। ২০১৪ সালে ডলারের মূল্য আজকের তুলনায় সস্তা ছিল। কিন্তু অপরিশোধিত তেলের দামের যে তফাত ছিল, সেটা অনেক অনেক বেশি। ১০৫ ডলার ব্যারেলে যদি দেশের বাজারে পেট্রোলের দাম ৭১ টাকা লিটার হতে পারে, তাহলে কোন যুক্তিতে ৮৩ ডলার ব্যারেলের যুগে দেশে পেট্রোল লিটারে ১০০ টাকার বেশি হবে? এই তফাতটা যে মাত্র একবছরে কেন্দ্রীয় শুল্ক লিটারে ২৮ টাকা বেড়ে যাওয়ার কারণেই, তা নিয়ে সংশয় নেই। ফলে বিরোধীরা যখন বলছে, ‘লুঠ করল একজন, আর ক্ষতিপূরণ দিতে বলা হচ্ছে অন্যজনকে’- তখন অন্যায় কিছু বলছে না।
পরিবহণ ব্যয় বৃদ্ধির মাধ্যমে পেট্রোল ও ডিজেলের দামের প্রভাব যে সমগ্র অর্থনীতির উপর, সেটা বোঝে না এমন কাউকে হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। ডিজেলের দামবৃদ্ধির কারণে কৃষির খরচ বেড়েছে। চাষের খরচ বাড়তে বাড়তে একরে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে। চাষের খরচ বাড়া মানে, খাদ্যপণ্যের দামের উপর তার বিশাল প্রভাব। জ্বালানির উৎপাদন শুল্ক থেকে নিজেদের আয় বাড়াতে গিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতি তৈরি করেছে দেশে। সাম্প্রতিক উপনির্বাচনে এর প্রভাব পড়েছে। উপনির্বাচনের ফলের ধাক্কাতেই নড়েচড়ে বসেছেন মোদিরা। রাতারাতি পেট্রোল ও ডিজেলের শুল্ক কমানো হয়েছে। দু’বছর বাদে বসেছে বিজেপির জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠক। যেখানে মোদি দলের নেতাদের উদ্দেশে বলতে বাধ্য হচ্ছেন, মানুষ ও দলের মধ্যে বিশ্বাসের সেতু নির্মাণ করুন।
মানুষের জীবন-জীবিকার সমস্যা লাঘব না করে কীভাবে এই সেতু নির্মাণ সম্ভব? আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম কমার আশু কোনও সম্ভাবনা নেই। আশঙ্কা করা হচ্ছে ব্যারেল প্রতি দাম ১০০ ডলার ছাড়াবে। যদি সেটা হয়, তাহলে কি পেট্রোল-ডিজেলের দাম আবার ফের ঊর্ধ্বমুখী হবে? রাজ্যগুলির উপর ভ্যাট কমানোর চাপ না দিয়ে বরং মোদি সরকার ভাবুক কীভাবে তৈল উৎপাদনকারী দেশগুলির উপর চাপ তৈরি করে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম কমানো যায়!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.