কত বছর হয়ে গেল, মনে করে দেখুন তো! বাংলা ছবি মানেই যেন এক গোয়েন্দার দেখা পাওয়া! গোয়েন্দা গল্প ছাড়া বাংলা ছবি ব্যবসাই করতে পারছে না। এই ট্রেন্ড কি বাংলা ছবির ঘরানায় লুকিয়েই ছিল? গোয়েন্দাগিরিতে নামলেন অনির্বাণ চৌধুরী
কিছু খুঁজে পাওয়ার একটা অদ্ভুত আনন্দ আছে দেখবেন! সেটা যেমন এলোমেলো মনে অপ্রত্যাশিত ভাবে কিছু আবিষ্কার করে ফেললে হয়, তার অনেক গুণ বেশি হয় মাথা খাটিয়ে পরিশ্রম দিয়ে কিছু খুঁজে বের করতে পারলে! যাকে বলাই যায় গোয়েন্দাগিরি। তার মধ্যে কোথাও একটা গিয়ে নিজেরই পিঠ চাপড়ে দেওয়ার মতো আনন্দ হয়। অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ যে বিলক্ষণ হয়, তা আর না বললেও চলে! সেই পাওয়াটা ছবির পর্দায় উঠে আসে বলেই কি গোয়েন্দা-ছবি এই বাংলায় এখন সবচেয়ে বেশি ব্যবসা দিচ্ছে? এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে যে গোয়েন্দা-ছবি ছাড়া পরিচালকদের পক্ষে বক্স অফিসের বৈতরণী পার হওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছে?
প্রশ্নটা হালকা নেওয়া যাচ্ছে না। গত সাত-আট বছর ধরে বাংলা ছবির দিকে একটু তাকালেই তার কারণটা টের পাওয়া যাবে। এই সময়টায় পরিচালক-প্রযোজককে তুমুল ব্যবসা দিচ্ছে, এমন ছবি কী কী পাওয়া যাচ্ছে হিসেবের খাতায়? ঘুরেফিরে সে-ই গোয়েন্দাগিরির গল্প। ফেলুদা, ব্যোমকেশের কীর্তি। তার সঙ্গে কুড়িয়ে পাওয়ার মতো করে আরও কিছু গোয়েন্দাদেরও দেখা মিলছে। এই ট্রেন্ড কি বাংলা ছবির ধারায় লুকিয়েই ছিল?
সম্ভবত ছিল। কেন না, বেশ অনেকগুলো বছর পিছিয়ে গিয়ে যদি বাংলা ছবির দিকে তাকাই, দেখব, গোয়েন্দা-কাহিনি সব সময়েই রুপোলি পর্দায় জনপ্রিয়। ‘ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিসট্যান্ট’, ‘থানা থেকে আসছি’- এরকম আরও অনেক নাম, অনেক চরিত্র, অনেক ছবি। কখনই তা পরিচালক, প্রযোজককে হতাশ করছে না। এমনকী, সত্যজিৎ রায়ের মতো পরিচালকও একটা সময়ে গিয়ে গোয়েন্দা-কাহিনিকে তুলে আনছেন ছবির পর্দায়। সে নিজের লেখা ব্যোমকেশকে যেমন, তেমনই শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফেলুদাকেও। এক দিকে যার সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জনপ্রিয়তা, অন্য দিকে নতুন করে উত্তম কুমারকে আবিষ্কার করার পালা। সত্যজিৎ কি এভাবেই উত্তম বনাম সৌমিত্র বিতর্ক নিয়ে খেলতে চেয়েছিলেন?
বলা মুশকিল! তবে একটা ব্যাপার নিজের অজান্তেই বুনে দিয়ে গিয়েছিলেন সত্যজিৎ বাংলার বুকে, বাংলা ছবির পর্দায়। ফেলুদা বনাম ব্যোমকেশের যে প্রতিযোগিতা তাঁর হাত দিয়ে শুরু হয়েছিল, তা অনেকগুলো বছর পরে এখন বাংলা ছবির জগৎকে শাসন করছে। নিজেই ভেবে দেখুন না, বাংলায় তো গোয়েন্দা-কাহিনির অভাব নেই, তার পরেও বক্স অফিসে শুধু ফেলু মিত্তির আর ব্যোমকেশ বক্সীর জয়জয়কার কেন? সে কি এই দুই চরিত্র সবচেয়ে বেশি বাঙালির পড়া বলে?
হয়তো! কেন না, পরিচালক যখন ছবি বানাবেন বলে ঠিক করছেন, প্রযোজক যখন তার পিছনে পয়সা ঢালবেন বলে মনস্থ করছেন, তখন একটা বাণিজ্যিক হিসেব-নিকেশ চলেই আসে। পরিচালকের দায়বদ্ধতা থাকে দু’রকমের। এক, নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করা। দুই, প্রযোজকের পয়সা তুলে দেওয়া। দুটোই হবে একমাত্র ছবি ভাল চললে! ফলে, চেনা গোয়েন্দাকে নিয়েই টানাটানি। দর্শক তাঁদের বইয়ের পাতায় চেনে, তাই রুপোলি পর্দাতেও দেখতে পছন্দ করবে। বা, এও বলা যায়, রুপোলি পর্দায় দেখার জন্য আকুল হয়ে থাকবে। বইয়ের ছবি চলে আসবে চোখের সামনে, চলবে মিলিয়ে নেওয়ার গোয়েন্দাগিরি।
ফলে, সন্দীপ রায়ের মতো ডাকসাইটে পরিচালকেরও ফেলুদাই হয়ে থাকে তুরুপের তাস। তাঁর অন্য কোনও ছবিই যে চলে না, একথা বলার মতো দুঃসাহস আমার নেই! কিন্তু, ফেলুদাকে নিয়ে ছবি করলেই যে তা হিট- এ সত্য অস্বীকার করার মতো বুকের পাটাও নেই! চোখের সামনেই তো দেখছি, তিন-চারটে ছোটগল্পের ছবি বানিয়ে ক্লান্ত হয়ে ফের তিনি হাত দিয়েছেন ফেলুদার গল্পেই। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পরে ফেলুদা কে হবেন- এই দুরূহ প্রশ্নের পথ পেরিয়েও। সব্যসাচী চক্রবর্তীর ফেলুদা, আবির চট্টোপাধ্যায়ের ফেলুদা এবং ফের সব্যসাচী চক্রবর্তীর ফেলুদা- সামান্য হলেও কি এ মানিয়ে নেওয়ার গ্রাফ?
অনেকটা তাই! রয়েছে আরও কিছু ব্যাপার-স্যাপারও। যেমন, আবির চট্টোপাধ্যায় ইদানীং ভীষণভাবে ব্যস্ত। একের পর এক ব্যোমকেশ ছবি করতে। তিনি যদি গোয়েন্দা, তাহলে ব্যোমকেশই- এরকম একটা ধারণা ঢুকে গিয়েছে দর্শকের মাথায়। উত্তম কুমারও ব্যোমকেশের মুখ হয়ে উঠতে পারেননি, কিন্তু আবির পেরেছেন। সেই জায়গা থেকে যাতে ফেলুদার গুরুত্ব মার না খায়, তাই হয়তো আবার সব্যসাচী চক্রবর্তীর ফেলুদার জুতোয় পা গলানো!
সন্দীপ রায় যে এভাবে ফেলুদাকে এক্সক্লুসিভ করে তুলতে চাইছেন, তাও কিন্তু বাংলা ছবির ঘরানায় গোয়েন্দা-কাহিনির জনপ্রিয়তাকেই প্রমাণিত করছে। শুধু তো ছবি বানালেই হবে না। গোয়েন্দার চেহারাটিও রাখতে হবে অবিকল। যাতে ভাবমূর্তি হোঁচট না খায়! সেই জন্যই ব্যোমকেশ হিসেবে আবির চট্টোপাধ্যায়ের জনপ্রিয়তা বেশি। সেই জন্যই আবির চট্টোপাধ্যায় অঞ্জন দত্তকে ছেড়ে অরিন্দম শীলের ব্যোমকেশ করলে তা নিয়ে বিতর্ক হয়। চলে সূক্ষ্ম মন-কষাকষি। এবং, অঞ্জন দত্ত মোটেই থেমে যান না। যিশু সেনগুপ্তকে তুলে আনেন নতুন ব্যোমকেশ হিসেবে। কারণ, তাঁর থেমে গেলে চলবে না। পরিচালক হিসেবে তাঁকেও ব্যবসা দিতে হবে। তাঁর ছবির ব্যবসার গ্রাফও বলছে- ব্যোমকেশ ছাড়া গতি নেই! অরিন্দম শীলও খেলছেন সেই তাস হাতে নিয়েই! অন্য ছবি নিশ্চয়ই হবে, কিন্তু গোয়েন্দা-কাহিনি ছেড়ে দিলে চলবে না। ফলে, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের গোয়েন্দা শবরও তাঁর হাত ধরে উঠে আসে রুপোলি পর্দায়। গোয়েন্দা ছবির ঘরানায় শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়েরও একটা জায়গা তৈরি হয়।
এবং, বাংলা ছবির পরিচালক-প্রযোজকরা হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকেন নতুন নতুন গোয়েন্দা। মূলত, কপিরাইট-সংক্রান্ত সমস্যার জন্যই। কে-ই বা চাইবেন তাঁর দেখানো পথে অন্য কেউ করে-কম্মে খাক? তাই জনপ্রিয় গোয়েন্দা কাহিনির সব সত্ত্ব সংরক্ষিত করে রাখেন কেউ কেউ। সন্দীপ রায় কাউকে ফেলুদা বানাবার অনুমতি দেন না। অঞ্জন দত্ত আর অরিন্দম শীল সেই পথেই ভাগাভাগি করে নেন ব্যোমকেশের কাহিনিগুলো। শবরেও অনেকটা অরিন্দম শীলের একচ্ছত্র আধিপত্য। ও দিকে, ঋতুপর্ণ ঘোষের মতো পরিচালকও জীবনের প্রান্তবেলায় এসে সম্পর্কের সমীকরণ ছেড়ে গোয়েন্দা-কাহিনিতে মন দেন। তাঁরও তো ‘সত্যান্বেষী’র আগে কোনও ছবিই তেমন ভাল ব্যবসা দিচ্ছিল না! ঋতুপর্ণ তো বলেছিলেনই, তিনি অনেকগুলো ব্যোমকেশের ছবি বানাতে চান। সময় তাঁকে সময় দিল না- এই যা!
তাহলে বাংলা গোয়েন্দাদের মধ্যে পড়ে থাকে কে? কাদের নিয়ে ছবি বানাবার কথা ভাবতে পারেন বাকিরা? সেই তালিকায় সবার আগে উঠে আসবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাকাবাবুর নাম। সৃজিত মুখোপাধ্যায় ইতিমধ্যেই প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়কে কাকাবাবু বানিয়ে ফেলেছেন ‘মিশর রহস্য’। আরও অনেকগুলো কাকাবাবু-কাহিনির স্বত্ত্বও তাঁর কেনা! এক এক করে বানাবেন নিশ্চয়ই! পাশাপাশি, বাকি কাকাবাবু-কাহিনি নিয়েও কাজ চলছে। খবর এসেছিল তো, চিরঞ্জিৎ চক্রবর্তীও কাকাবাবুর ভূমিকায় অভিনয় করছেন। সেই ছবি এখনও রয়েছে নির্মীয়মাণ পর্যায়েই। অবশ্য এই ফাঁকে বলে না দিলে অন্যায় হবে, বাংলা গোয়েন্দা-ছবির ঘরানায় কাকাবাবুর একট জনপ্রিয়তা ছিলই! ‘সবুজ দ্বীপের রাজা’, ‘কাকাবাবু হেরে গেলেন’- অনেক ছবিই তৈরি হয়েছে। তপন সিংহের ছবিতে কাকাবাবু হয়েছেন শমিত ভঞ্জ, পিণাকি চৌধুরির ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। আরও কাকাবাবু আসছেন বলেই মনে হয়!
এবং এসে গিয়েছেন নীহাররঞ্জন রায়ের গোয়েন্দা কিরীটি। সেই ছবি তুমুল জনপ্রিয় না হলেও ব্যবসা মন্দ করেনি। হেমেন্দ্রকুমার রায়ের বিমল-কুমার, জয়ন্ত-মাণিককে নিয়ে অনেক দিন ছবি হয়নি। সেই ‘যখের ধন’, ‘আবার যখের ধন’-এই ইতি পড়েছে। এক এক করে এই অন্য গোয়েন্দা খোঁজার খেলায় বাংলা ছবির পর্দায় এসেছে সমরেশ মজুমদারের অর্জুন, সমরেশ বসুর খুদে গোয়েন্দা গোগোল। সুব্রত সেন শেষ ছবি করেছেন ‘মিস্টার ভাদুড়ি’, সেই গোয়েন্দা গল্প। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের কর্নেলকে নিয়েও ছবি হচ্ছে। এখনও শুধু বিমল করের কিকিরায় হাত পড়েনি। তিনি বোধহয় ততটাও জনপ্রিয় নন বলেই!
শুধু একটা ব্যাপার বড় মন খুঁতখুঁত করা! বাংলায় তো মেয়ে গোয়েন্দার অভাব নেই! নলিনী দাশের গন্ডালু রয়েছে, সুচিত্রা ভট্টাচার্যর মিতিন মাসিও ফেলনা নয়! এঁদের নিয়ে গোয়েন্দা-ছবি করার কথা কেউ কেন ভাবছেন না? মেয়ে গোয়েন্দাও যে ডাকসাইটে হতে পারে, তা তো একটু চোখ ফেরালেই দেখা যায়। বিদেশের গোয়েন্দা কাহিনির ধারায় যেমন শার্লক হোমসকে সমানে সমানে টক্কর দেন মিস মার্পল। শার্লকের মতো দৌড়াদৌড়িও তাঁকে করতে হয় না! স্রেফ ঘরে বসেই মাথা খাটিয়ে তিনি রহস্য সমাধান করে ফেলেন। এছাড়া অনেক পরে হলেও রয়েছে লেডিজ ডিটেটিভ এজেন্সি সিরিজ। আফ্রিকার এক মোটাসোটা কালো মেয়ে কেমন দিব্যি সুন্দর ভাবে নিজের এবং অন্যের জীবনের জট ছাড়িয়ে ফেলে। বাংলায় কি এরা পুরুষতন্ত্রের চাপে কোণঠাসা হয়ে থাকে?
সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না! যদিও ঋতুপর্ণ ঘোষ প্রমাণ করে দিয়েছিলেন, মুন্সিয়ানা থাকলেই মেয়ে গোয়েন্দাকে ছবির পর্দায় জনপ্রিয় করে তোলা যায়। তাঁর হাতেই তো বাঙালি পেয়েছিল মিস মার্পলকে। ‘শুভ মহরৎ’ তো মিস মার্পলেরই এক গল্পের বঙ্গীকরণ! তার অনেক বছর পরে এখন ছোটপর্দাতেও ‘গোয়েন্দা গিন্নি’র টিআরপি বেশ ভাল! তাহলে অসুবিধাটা আর কোথায়?
কে জানে! বরং, ছেলে গোয়েন্দারা এগিয়ে চলেছে তুখোড় থেকে তুখোড়তর হওয়ার দিকে। ব্যোমকেশ রীতিমতো অ্যাকশন স্টান্ট দিচ্ছে, এক দল লোকজনকে শুইয়ে দিচ্ছে মুষ্ট্যাঘাতে। ল্যাসো ছুড়ে ধরে ফেলছে অপরাধী! গুলি চালাবার কথা বাদ দেওয়া যাক! গোয়েন্দা গুলি চালাবে না- তাও কি হয়? সঙ্গে তার কাহিনিতে জুড়ছে লাস্যময়ী বাঈজির আনাগোনা! কিছুই না, প্যাকেজটা যতটা সম্ভব আকর্ষণীয় করার চেষ্টা! সে প্রয়োজন থাক বা না থাক!
কেন না, বাংলা ছবি সম্পর্কের গল্প বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন দর্শকও! তাই অনেক কিছু জুড়ে শেষ ভরসা গোয়েন্দারাই! অপরাধের মধ্যেও তো একটা সম্পর্কের গল্প থাকে। আততায়ী আর লক্ষ্যবস্তুর সম্পর্ক, অপরাধী আর অপরাধের সম্পর্ক, সবচেয়ে বেশি করে গোয়েন্দা আর অপরাধীর সম্পর্ক! একের জীবনে যে অন্যে জুড়ে যায়!
বাংলা ছবির পর্দাও তাই জুড়ে থাকছে এখন গোয়েন্দারাই! এই গতির যুগে রোমাঞ্চের অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ ছাড়া আর কিছুই বিকোচ্ছে না। পাশাপাশি, গোয়েন্দা কাহিনির আবেদনও সার্বজনীন। তাই এভাবেই চলছে! আরও অনেকগুলো বছরও চলবে বলেই তো মনে হয়!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.