ফাইল ছবি।
অরূপ কর: ‘মেরে মন মে রাম, তন মে রাম, রোম রোম মে রাম রে,/ রাম সুমীর মে ধ্যান লগা লে, ছোড় জগৎ কা কাম রে/ বোলো রাম, রাম রাম, বোলো রাম রাম রাম……….’ আটের দশকে প্রখ্যাত শিল্পী অনুপ জালোটার গাওয়া ভজনটি খুব হিট করেছিল। একেবারে নিখাদ রাম ভক্তিরসে চুবনো প্রতিটি কথা। মনে আবেশ আনে। গানের কথা-সুরে মন বিভোর হয়ে যায়। শুধু কাঁটা হয়ে খচখচ করে ওই শব্দগুলো ‘ছোড় জগৎ কা কাম রে!’
কী করে সম্ভব তা? প্রেম-ভালবাসা, বিবাদ, বিরহ, বিচ্ছেদ, লোভ, কাম, ক্রোধে ভরা ধুলোমাটি, দূষণে ভরা আকাশ-বাতাসে শ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকা আমরা সংসারী জীব কী করে জগতের কাম-কাজ ছেড়ে দিয়ে বসে থাকি? আমরা রক্তমাংসের মানুষ। পেটে খিদে আছে,যন্ত্রণা আছে। রোগ-অসুখ-মারী আছে। মা-বাবা-ভাই-বোন-বন্ধু আছে। স্বার্থপরতা, লোভ আছে। আবার নিঃস্বার্থ ভালবাসার বন্ধন আছে। স্নেহ-মায়া আছে। আপদ-বিপদ-সঙ্কট আছে। আলো আছে, অন্ধকার আছে। ভয়-ভক্তি আছে, সাহস, বীরত্ব আছে। সাদা আছে, কালো আছে। এই সব নিয়েই সংসার। সব নিয়েই আমাদের প্রতিদিনের লড়াই, সংগ্রাম, জীবনযাপন। ‘এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে মন যেতে নাহি চায়’-এর মতো গানের অমোঘ টান আছে! তাই কী করে জগতের সব কাজ ফেলে রামনামে সব সমর্পণ করে বসে থাকি?
উত্তর দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী (PM Modi)। সেদিন অযোধ্যায় রামলালার ‘প্রাণপ্রতিষ্ঠা’র পর দেওয়া ভাষণে বললেন, রাম আগুন নন, শক্তি। রাম আধার। রামের পথেই দেশের ভবিষ্যত্। পথপ্রদর্শক রামকে (Ram) সামনে রেখে উন্নয়ন, সমৃদ্ধি, বিকাশের হাত ধরাধরি করে চলবে অতীত ঐতিহ্য, প্রযুক্তি, বিজ্ঞান। হাজার বছর পরও তখনকার প্রজন্মের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবেন প্রভু রাম। অতএব রামই সব। আমরা সব বিশ্বাস করেছি।
না, আমরা জানতে চাইনি, অযোধ্যায় (Ayodhya) রামলালা পাকাপাকি ঘর পেলেন, কিন্তু ভারতবর্ষের শহর-গ্রামে পথের ধুলো মেখে বড় হওয়া, অপুষ্টির শিকার রক্তমাংসের রামলালাদের কী হবে। আমরা জানতে চাইনি, কেন দেশের কৃষকরা ফসলের ন্যায্য দাম না পেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করছেন। আমরা জানতে চাইনি, আলু-পিঁয়াজ, টম্যাটো, পিঁয়াজকলি, বেগুনের শীতের সময়ও কেন আগুন দাম। আমরা জানতে চাইনি, দেশে রামের অসংখ্য মন্দির থাকা সত্ত্বেও এত ধুমধাম করে এত বিপুল অর্থব্যয়ে আরও একটা মন্দির করতে হল কেন। আমরা রামনামের জোয়ারে ভেসে গিয়েছি। কারণ আমাদের ভারতবর্ষ বদলে যাচ্ছে। অযোধ্যার জমিতে আমজনতার চাহিদা মেটাতে রামের নামে একটা বড় হাসপাতাল বা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় হোক, অতীতে দাবি উঠত। কিন্তু আজ একথা আর শোনা যায় না। আমরা আত্মপরিচয় খুঁজে পেয়েছি রামে, যাকে বলা হচ্ছে, গোলামির মানসিকতার অবসান।
মনে পড়ে গেল বিলাস ভাবসারকে। মঙ্গলবার রামমন্দির হওয়ার আনন্দে গত ৩২ বছরে প্রথম জুতো পরলেন ৬০ বছর বয়সি জলগাঁওয়ের এই করসেবক। শপথ করেছিলেন, অযোধ্যায় মন্দির যতদিন না হচ্ছে, জুতো পরবেন না। পান দোকান চালান বিলাস। দেশের অগণিত বিলাসদের নিখাদ রামভক্তিকে পুঁজি করেই দেশের ভবিষ্যতের রূপরেখা ঠিক করে দিতে চাইছেন মোদী।
কিন্তু রামশক্তির জাদুতে দেশকে ঐক্য়বদ্ধ রাখা যাবে তো? কেননা ২২ তারিখ থেকেই দেশের নানা প্রান্তে ছুটছাট অশান্তি ছড়াচ্ছে। সর্বশেষ সংযোজন মহারাষ্ট্র। সেখানে পুণের ফিল্ম ইনস্টিটিউটে ঢুকে পড়ুয়াদের মারধর করেছে রামভক্তরা। জোর করে স্লোগান দেওয়ানোর মতো অভিযোগও উঠছে। হৃদয়ে রামের জন্য চিরস্থায়ী আসন পাতা থাকলে কেন এমন জোরজবরদস্তি! মুম্বইয়ের মীরা রোডের নয়া নগর এলাকায় অশান্তির পর কিছু কাঠামোকে বেআইনি তকমা দিয়ে বুলডোজারে গুঁড়িয়ে দিয়েছে পুরসভা। উত্তরপ্রদেশের ছবি দেখা গিয়েছে সেখানে।
পালটা প্রতিক্রিয়ার খবরও হচ্ছে। রাম জন্মভূমি-বাবরি মসজিদ মামলায় মুসলিম সম্প্রদায়ের তরফে মূল মামলাকারী ইকবাল আনসারিও যেখানে অতীত ভুলে এগিয়ে চলার কথা বলছেন, তাতে সাড়া দেওয়া উচিত সংখ্যালঘু সমাজেরও। কিন্তু মূল দায়িত্ব নিতে হবে শাসক দলকেই। ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থে অশান্তি বাড়তে দিলে তার ফল হয় বিষময়। হাতের কাছেই উদাহরণ মণিপুর। মেইতেই-কুকি বিবাদে রক্তাক্ত উত্তরপূর্বের সাত বোনের এক বোন। আগামী দিনে দেশের বাকি অংশে মণিপুরের পুনরাবৃত্তি রুখতে পারবে রামশক্তি? উত্তর দেবে সময়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.