রিজার্ভ ব্যাংকের সুদ বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত কি মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সক্ষম? অতিমারীর পর বিশ্বজুড়ে মূল্যবৃদ্ধির যে প্রবণতা, তা নিয়ন্ত্রণে ইতিমধ্যে ৪৫টি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হারে পরিবর্তন এনেছে। ফলে ভারতের রিজার্ভ ব্যাংকর উপরও চাপ বেড়েছে সুদের হারে পরিবর্তনের। শুধু রিজার্ভ ব্যাংকের মাধ্যমে সুদের হার বাড়িয়েই কি ভারতে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব? লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী
মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কি রিজার্ভ ব্যাংক আরও একবার সুদের হার বাড়াবে? জুন মাসের নির্ধারিত মনিটরি পলিসি কমিটির বৈঠক শুরু হওয়ার পর ফের এই প্রশ্নটি সামনে এসেছে। অর্থনীতিবিদ ও শেয়ার বাজার বিশেষজ্ঞদের একটি মহলের ধারণা, রিজার্ভ ব্যাংক রেপো রেট আরও ৩৫ থেকে ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়াতে চলেছে। সদ্য মে মাসেই রিজার্ভ ব্যাংক রেপো রেট ৪০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়েছিল। যার জেরে বণিজ্যিক ব্যাংকগুলি কিছুটা করে ঋণের ক্ষেত্রে সুদের হার বাড়ায়। যার ধাক্কা ইতিমধ্যেই মধ্যবিত্তের ঘাড়ে এসে পড়েছে। সামান্য হলেও গৃহঋণ ও গাড়ির ঋণের ইএমআইয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এবারও কি একই ঘটনা ঘটবে?
কিন্তু তার চেয়েও বড় প্রশ্ন হল, রিজার্ভ ব্যাংকের সুদ বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত কি মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হচ্ছে? অতিমারীর পর বিশ্বজুড়ে মূল্যবৃদ্ধির যে-প্রবণতা, তা নিয়ন্ত্রণে ইতিমধ্যে ৪৫টি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হারে পরিবর্তন এনেছে। ফলে ভারতের রিজার্ভ ব্যাংকের উপরও চাপ বেড়েছে সুদের হারে পরিবর্তনের। অন্যান্য দেশকে অনুসরণ করে শুধু রিজার্ভ ব্যাংকের মাধ্যমে সুদের হার বাড়িয়েই কি ভারতে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা কিন্তু এখনও পর্যন্ত সরকারি মহলে কম। তবে এই প্রশ্নের উত্তরটাই আমজনতার কাছে সবচেয়ে বেশি জরুরি। দেশের সাধারণ মানুষ ভোজ্য তেল থেকে চাল, ডাল, আলু, চিনির অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে অতিষ্ঠ। তাদের কাছে এটা গুরুত্বপূর্ণ নয় যে, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় সরকার আর্থিক নীতির পরিবর্তন করবে না কি কোষাগার নীতির বদল ঘটাবে? যখনই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক নীতি সংক্রান্ত কমিটির বৈঠক হয়, তখনই সংবাদমাধ্যমে বড় বড় করে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের স্বপ্ন দেখানো হয়। আদতে মধ্যবিত্তের গাড়ি, বাড়ি ঋণের সুদ বৃদ্ধি ছাড়া কিছুই ঘটে না।
ভারতে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কী করা জরুরি, সেটা আগে সঠিকভাবে নির্ণয় কেন করব না? এটা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক নীতির একটা ভূমিকা রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন রেপো রেট বৃদ্ধি করে, তখন বাজারে টাকার জোগান কিছুটা হলেও কমে। টাকার জোগান কমলে স্বাভাবিকভাবেই পণ্যেরর চাহিদা কমবে। লোকের হাতে যদি টাকা কমে যায়, তাহলে তারা বাজারে এসে জিনিস কিনবে কীভাবে? কিন্তু শুধু মানুষের পকেটে টান দিয়েই কি মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়? লকডাউনের সময় অর্থনীতির অভূতপূর্ব সংকোচন ঘটেছিল। অর্থনীতির সংকোচন মানেই লোকের আয় কমে যাওয়া। আয়ে কমার বাস্তবতা দেশের অধিকাংশ পরিবার লকডাউনে প্রত্যক্ষ করেছে। আবার সেই লকডাউনের সময়ই আমরা দেখেছি, কী অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে বাজারে। খেয়াল রাখতে হবে যে, লকডাউনের সময় আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম প্রায় শূন্যে নেমে গিয়েছিল। ছিল না কোনও যুদ্ধও। লকডাউনের সময় মুদ্রাস্ফীতির কারণ খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। সাধারণ ভারতবাসী তার সিংহভাগ আয় খরচ করে খাদ্যপণ্য কিনতে। খুচরো মূল্যবৃদ্ধি যখন আমরা হিসাব করি, তখন তাতে ৪৮ শতাংশ অবদান থাকে খাদ্যপণ্যের মূল্যের। লোকের আয় যেমনই হোক, তাকে খাদ্যপণ্যে ব্যয় করতেই হবে। লকডাউনের সময় আয় কমলেও খাদ্যপণ্যের উপর ব্যয় কমেনি। ফলে আয় কমলেই যে খাদ্যপণ্যের চাহিদা কমে যাবে, তেমনটা নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে সুদের হারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলিকে ঋণ দেয়, তা বাড়িয়ে বাজারে টাকার জোগান কমাতে পারে, মানুষের পকেট ফাঁকা করতে পারে, কিন্তু চাইলেই খাদ্যপণ্যের চাহিদা কমিয়ে দিতে পারে না। বড় আকারে খাদ্যপণ্যে চাহিদা না কমলে চটজলদি তার মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে আনাও সম্ভব নয়।
খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে আনার সবচেয়ে বড় উপায় হল, তার জোগান বৃদ্ধি করা। বাজারে চাল, ডালের জোগান বাড়াতে পারলেই দাম কমবে। এই মুহূর্তে বাজারে সব ধরনের ভোজ্য তেলের মূল্য অত্যধিক। এই মূল্যবৃদ্ধির কারণ বাজারে ভোজ্য তেলের জোগান কমে যাওয়া। ভোজ্য তেলের জন্য আমাদের অনেকাংশেই নির্ভর করতে হয় বিদেশ থেকে আমদানির উপর। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ইত্যাদি দেশ থেকে ভারতে প্রচুর পরিমাণে সাদা তেল আমদানি হয়। এই দেশগুলিতেও বেশ কিছুদিন ধরে সাদা তেল উৎপাদনে সংকট চলছে। যার জের এসে পড়েছে ভারতে। ইউক্রেন থেকেও ভারতে প্রচুর পরিমাণে সাদা তেল আমদানি হয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ লাগার পর ভারতে ইউক্রেনের তেলের ঘাটতি হয়েছে। গোটা বিশ্ব সাম্প্রতিক মুদ্রাস্ফীতির জন্য রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করছে। এই যুদ্ধ একদিকে যেমন খাদ্যপণে্যর জোগান শৃঙ্খলাকে ভেঙে দিয়েছে, তেমনই আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব অবশ্যই ভারতে রয়েছে। কিন্তু এটাও বিচার্য যে যুদ্ধ শুরুর আগেও ভারতে পেট্রোল ও ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি চরমে উঠেছিল। আবার পেট্রোল ও ডিজেলের দাম কমলেই যে দেশের বাজারে আমরা চাল, ডাল-সহ বিভিন্ন পণ্যের দাম হু হু করে নামতে দেখি, তেমনটা নয়। সুতরাং, খাদ্যপণ্যের দামের সঙ্গে খাদ্যপণ্যের জোগানের সম্পর্কটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। খাদ্যপণ্যের জোগান বাড়তে পারে খাদ্যপণ্যের উৎপাদনের বৃদ্ধির মধ্য দিয়েই।
অতএব, শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক নীতির পরিবর্তন ঘটিয়েই চাল, ডাল, আলুর দাম বাজারে কমানো সম্ভব নয়। স্থায়ী মূল্যবৃদ্ধির নিয়ন্ত্রণে দেশে খাদ্যপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি অনেক বেশি দরকারি। সরকারকে এই সংক্রান্ত নীতি গ্রহণ করতে হবে। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসার পর দেশের আর্থিক নীতির ক্ষেত্রে বড়সড় কোনও পরিবর্তন আসতে দেখা যায়নি। দেশে কলকারখানায় লগ্নি আনার বিষয়ে মোদি সরকারকে উদ্যোগী হতেও দেখা যায়নি। গত আট বছরে বলার মতো কোনও লগ্নি দেশে ঘটেনি। দেশের কোনও প্রান্তেই বড় কোনও কারখানা গড়ে ওঠেনি। একইভাবে খাদ্যপণ্যে লাগাতার মূল্যবৃদ্ধি সত্ত্বেও মোদি সরকারকে কৃষি উৎপাদন বাড়াতেও কোনও নীতি গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। কৃষিপণ্য বিপণনের ক্ষেত্রে কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে দরজা খুলে দিতে মোদি সরকার তিনটি কৃষি আইন সংস্কার করেছিল। যা পরে ফিরিয়ে নিতে হয়। কিন্তু দেশে সামগ্রিক কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কী কী করা দরকার, সে ব্যাপারে সরকারি ভাবনাচিন্তার কোনও দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে নেই। বরং দেখা গেল, আচমকা গমের রপ্তানি বাড়িয়ে দেশে একটা খাদ্যসংকটের পরিস্থিতি তৈরি করে ফেলল কেন্দ্রীয় সরকার। হইচই শুরু হওয়ায় সেই রপ্তানি নীতিও হঠাৎ পরিবর্তিত হল।
ডাল, তৈলবীজ ইত্যাদির মতো খাদ্যশস্যের ক্ষেত্রে আমরা বরাবরই আমদানির উপর নির্ভরশীল। দেশে এগুলির উৎপাদন কীভাবে বাড়ানো যেতে পারে গত আট বছরে, তা নিয়ে মোদি সরকার ভাবতে পারত। এই সরকারের আমলে বারবার সারের দাম বেড়েছে। সারের দাম বাড়লে কৃষি উৎপাদনে তার ব্যাপক প্রভাব পড়ে। সরকার তা নিয়ে ভাবতে পারত। কৃষকদের বছরে কিছু টাকা আর্থিক সাহায্য করলেই দেশে কৃষি উৎপাদন বাড়ে না। কৃষি উৎপাদন বাড়াতে সরকারের সামগ্রিক নীতির প্রয়োজন। সেচের ব্যবস্থা, সারের জোগান, উচ্চফলনশীল বীজ উদ্ভাবন, ট্রাক্টরের মতো প্রযুক্তির ব্যবহার ইত্যাদি সামগ্রিক নীতি গ্রহণের মধ্য দিয়েই ছয়ের দশকে দেশে সবুজ বিপ্লব ঘটেছিল। সবুজ বিপ্লব আমাদের প্রথম চাল, গমের ক্ষেত্রে ‘স্বনির্ভর’ করে। লাগাতার মূল্যবৃদ্ধি কমাতে এই ধরনের সামগ্রিক নীতির প্রয়োজন। ফলে যারা মনে করছেন, রিজার্ভ ব্যাংকের তিনদিনের বৈঠকে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কোনও সূত্র সামনে চলে আসবে, তারা ফের আশাহত হবেন। মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে সরকারের কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিরও প্রয়োজন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.