অনাস্থা প্রস্তাবে পরাজিত হলেও এর মধ্য দিয়ে বিরোধী-ঐক্য সংসদে দৃঢ়ভাবে রোপণ করা সম্ভব হয়েছে। বিরোধীদের এককাট্টা হওয়ার এমন ছবি গত দশ বছরে দেখা যায়নি। তবে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে তা আসন বণ্টনে কতখানি প্রতিফলিত হয়, সেটাই দেখার। কলমে জয়ন্ত ঘোষাল
ভারতের সংসদে আর-একটি অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে বেশ কিছুদিন পর রাজনীতির উত্তাপ টের পাওয়া গেল। এদেশে অনাস্থা প্রস্তাবে সরকারের পতন যে একেবারেই হয়নি, তা কিন্তু নয়। মোরারজি দেশাই থেকে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ; এমনকী, অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকারেরও একবার পতন হয়েছিল অনাস্থা প্রস্তাবে। নরেন্দ্র মোদি জমানায় এটি দ্বিতীয় অনাস্থা প্রস্তাব। সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধেই অভিযোগ যে, তিনি কেন মণিপুর নিয়ে নীরব। কাজেই অনাস্থা প্রস্তাবের মূল লক্ষ্য যতটা না বিজেপি, তার চেয়েও বেশি নরেন্দ্র মোদি।
২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল কী হবে- সেই প্রসঙ্গে এখনই কোনও পূর্ব ঘোষণা করা যায় না, এবং করা উচিতও নয়। তবে এই অনাস্থা প্রস্তাবে বিরোধীরা যে নরেন্দ্র মোদিকে পরাস্ত করতে পারবে না, সংখ্যার জোরে যে বিজেপি বহাল তবিয়তে ক্ষমতায় থাকবে এবং ২০২৪ পর্যন্ত যে নরেন্দ্র মোদির সরকার-ই ক্ষমতাসীন- তা প্রমাণিত হল। শুধু বিজেপিরই আসন সংখ্যা এখন ৩০৩। বিজেপি নেতারা বুক ফুলিয়ে বলেন- এ হল ‘থ্রি নট থ্রি রাইফেলের শক্তি’।
আসলে অনাস্থা প্রস্তাবে নরেন্দ্র মোদি সরকার পরাস্ত হবে- এমনটা কেউ ভাবেনি। তাহলে বিরোধীরা অনাস্থা প্রস্তাব আনল কেন? এই অনাস্থা প্রস্তাবে হেরে গিয়ে তাদের গৌরব কি আরও বৃদ্ধি পেল? বিজেপি সংখ্যার জোর দেখিয়ে বিরোধীদের পরাস্ত করতে পেরেছে- এই উল্লাসে মণিপুরের গ্লানি কি মুছে গেল?
সংখ্যায় জয় যে সম্ভব নয়, সেটা জেনেও বিরোধীরা যে অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে এল, আর কংগ্রেস এই বিষয়ে যে এতটা উদ্যোগী হল, অন্যান্য বিরোধী দলও সমবেতভাবে হাত মেলাল- এর প্রধান কারণ- অনেক দিন পর বিজেপির বিরুদ্ধে বিরোধী ঐক্যর একটা সুস্পষ্ট ছবি তৈরি করা যাচ্ছে। দেশের মানুষের সামনে বিরোধী ঐক্যর এই প্রতিষ্ঠা বিগত দশ বছরেও দেখা যায়নি। কোনও একটা বিষয়ে তৃণমূল কংগ্রেস যদি সোচ্চার হয়, তবে কংগ্রেসের রাহুল গান্ধী তার সুরে সুর মেলাননি। অথবা, কংগ্রেসের বিরুদ্ধে যখন দুর্নীতির মামলা উঠেছে, ‘ন্যাশনাল হেরাল্ড’ অথবা আয়কর ফাঁকির- তখন কেজরিওয়াল অথবা অখিলেশ নিরুত্তর থেকেছেন। এখন কিন্তু বিরোধীরা হাতে হাত ধরেছে। কর্নাটকে বিজেপির পরাজয়ের পর উৎসাহিত কংগ্রেসও অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্যে হঠাৎ আলোর ঝলকানি দেখতে পেয়েছে। এখন সেই প্রাচীন প্রবাদটি অনেকের মনে এসেছে যে, একটা পাটকাঠি সহজে ভেঙে দেওয়া যায়। অনেকগুলি পাটকাঠি একত্র হলে তখন কিন্তু দড়ি দিয়ে বাঁধা পাটকাঠিকেও ভাঙতে হিমশিম খেতে হয়। সুতরাং, যে যেখানে আছ, জোট বাঁধো, তৈরি হও, হাতে হাত মেলাও। বিহারে বৈঠক হয়েছে, বেঙ্গালুরুতে বিরোধী বৈঠক হয়েছে, এবারে সংসদের অধিবেশনের পর মহারাষ্ট্রেও বিরোধী বৈঠক হচ্ছে- ‘ও আলোর পথযাত্রী, এখানে থেমো না।’
বিরোধীদের এই জোট বাঁধাকে অনাস্থা প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে সংসদের ভিতরে আরও দৃঢ়ভাবে রোপণ করা সম্ভব হয়েছে, একটা আবহাওয়া তৈরি করা সম্ভব হয়েছে।
অনাস্থা প্রস্তাবে মণিপুরকে ‘পাখির চোখ’ করে তুলতে চেয়েছিল কংগ্রেস তথা বিরোধীরা। এর কারণ, মণিপুরের সংকট এখন শুধু মণিপুরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এমনিতে মণিপুর নিয়ে যে আমাদের প্রচণ্ড মাথাব্যথা, এমন নয়। আমরা তো উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি বোন আর এক ভাইয়ের মুখ্যমন্ত্রী কে কোথায় আছেন, তাঁদের নামই বলতে পারি না! দিল্লিতে যে কোনও একজন পথচারীকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় যে, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আটটির রাজে্যর নাম কী কী, হয়তো বলতেই পারবে না। এহেন ভারতে, যেখানে মণিপুর এখনও নানাভাবে তথাকথিত জাতীয় মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন- সেখানে মণিপুরের তাণ্ডব নৃত্য এবং একটা ভিডিও ফুটেজ দেশজুড়ে আলোড়ন ফেলে দিয়েছে। এমনকী, সর্বভারতীয় মিডিয়ায় যেখানে মণিপুর কোনও দিন ঠাঁই পায় না, সেখানেও মণিপুরের জন্য যথেষ্ট পরিসর রাখা হচ্ছে।
আর মণিপুরের দৌলতেই রাহুল গান্ধী থেকে বিরোধী নেতৃবর্গ প্রচারের আলোয় এসেছেন। মণিপুর নিয়ে শহুরে অভিজাত কলমচিরা ‘পোস্ট এডিট’ লিখতে শুরু করেছেন। চেতন ভগতের মতো কলমচি থেকে সুপ্রিম কোর্ট- মণিপুর নিয়ে প্রত্যেকে মুখর।
তাই বিরোধীদের রণকৌশল ছিল- মণিপুরকে সামনে রেখে অনাস্থা প্রস্তাবে এগিয়ে যাওয়া। কেউ কেউ বলছেন, কেন শুধু মণিপুর? বিজেপি সরকারের দশ বছরের অপশাসন, গণতন্ত্রর হত্যা, মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি- এসব নিয়েও তো সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন ছিল! কংগ্রেস নেতারা তাঁদের বক্তব্যে মণিপুরকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন বটে, তবে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিনিধি-বক্তা সৌগত রায় সার্বিকভাবে মোদি সরকারের গত পাঁচ বছরের চূড়ান্ত ব্যর্থতার কথা তুলে ধরেছেন। আসলে, রাহুল গান্ধী যখন বলেছেন, ‘মণিপুরে ভারতমাতাকে হত্যা করা হয়েছে’, তখন এই উক্তির মাধ্যমে সারা দেশে একটা বার্তা বিরোধীরা দিতে চেয়েছে। তা হল, ‘তোমার ভারত’ আর ‘আমার ভারত’-এর বিতর্ক।
নরেন্দ্র মোদি টুকরো টুকরো খণ্ডে বিভক্ত বিরোধীদের নিয়ে ব্যঙ্গ করছেন। আর, বিজেপি ‘ইন্ডিয়া’ শব্দটা ব্যবহার না করে ‘আইএনডিআইএ’ বলে বিরোধী জোটকে আখ্যা দিচ্ছে। তার কারণ, ওই ‘ইন্ডিয়া’ শব্দটায় বিরোধীরা যে-বার্তা দিতে চেয়েছে, সেই বার্তার বিরোধিতা করা বিজেপির অবশ্যকর্তব্য। পাশাপাশি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘বিজেইন্ডিয়া’ বনাম ‘ইন্ডিয়া’। অর্থাৎ, বিজেপির ‘ইন্ডিয়া’ আর বিরোধীদের ‘ইন্ডিয়া’। এখানে মূল লড়াই, ‘তোমার ভারত’ অর্থাৎ ‘মোদির ভারত’-এর সঙ্গে। যা আদতে ভারতকেই টুকরো টুকরো করার প্রচেষ্টা।
সেই ভারত বহুত্ববাদের নয়, সেই ভারত ধর্মনিরপেক্ষ নয়, সেই ভারত সকলকে নিয়ে চলার নয়। সেই ভারত বীর সাভারকরের ভারত, ‘হিন্দুত্ববাদী সংকীর্ণতা’-র ভারত। পাশাপাশি রয়েছে বিরোধীদের ভারত, নেহরুর ভারত, গান্ধীর ভারত, বহুত্ববাদের ভারত, সহিষ্ণুতার ভারত, অহিংসার ভারত, উন্নয়নের ভারত। তাই একদিকে যেমন নরেন্দ্র মোদিরা একটা নতুন ভারত গঠনের কথা বলে হিন্দুত্ববাদী শক্তিশালী রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখিয়েছেন তাঁদের সমর্থকের কাছে, ঠিক একইভাবে তার পালটা আখ্যান বিরোধীরা দেওয়ার চেষ্টা করছে। এই ‘তোমার ভারত’ আর ‘আমার ভারত’-এর আবহাওয়া আরও সুস্পষ্ট হয়েছে অনাস্থা প্রস্তাবের আনয়নে। অনাস্থা প্রস্তাব চুকে যাওয়ার পর, সংসদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর, প্রধানমন্ত্রীর বিজেপি-বিরোধী ভাষণের জবাবি ভাষণের পর, সংসদের বাইরে দু’-পক্ষই যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে। ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের বাকি আর মাত্র কয়েক মাস। এটা ভাবার কোনও কারণ নেই যে, বিরোধীরা তাদের ঐক্যের যে আবহ তৈরি করতে পেরেছে- তাতেই তাদের জয় সুনিশ্চিত হয়ে গিয়েছে। এখনও বিজেপি তার চূড়ান্ত রণকৌশল স্পষ্ট করেনি।
সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়, যখনই ভোট আসে, তখনই বিজেপি ‘ব্যাক টু বেসিক’-এর আশ্রয় নেয়। আবার তারা হিন্দুত্বে ফিরে আসে। সুতরাং কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা, সুপ্রিম কোর্টের আসন্ন জ্ঞানবাপী মসজিদ থেকে শিবলিঙ্গ বের করে পুজো, মথুরা-বৃন্দাবনের করিডোর নির্মাণ, অভিন্ন দেওয়ানি বিধির জন্য জোর সওয়াল (ক্যাবিনেটে তা পাস হোক আর না হোক), সর্বোপরি পাকিস্তানের ইসলামিক মৌলবাদের বিরুদ্ধে হিন্দুত্বের আখ্যান তুলে সমগ্র দেশে, বিশেষ করে হিন্দি বলয়ে, রাজনৈতিক মেরুকরণের মরিয়া প্রয়াস- এসবই এখন আমাদের দেখা বাকি।
সম্ভবত, জানুয়ারি মাসের পর থেকে বিজেপির এই আক্রমণাত্মক খেলা শুরু হবে। কংগ্রেস বা বিরোধীদের পক্ষে হিন্দুত্বের আক্রমণাত্মক কৌশলের ফাঁদে পা দেওয়া বিপজ্জনক হতে পারে। অতীতে এমনটা হয়েছে। ‘হিন্দুত্ব’-র বিরোধিতা করতে গেলেও অনেক সময় বিপদ হয়। সুতরাং, বিজেপি হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক লাইন নিলে, অন্যদিকে বিরোধীরা ‘ট্রায়াল অ্যান্ড এরর’ করছে। মণিপুর অথবা মোদি সরকার আমলে দারিদ্র ও বেকারত্ব বেড়ে যাওয়ার মতো জ্বলন্ত ইস্যুকে তুলে ধরার চেষ্টা করছে।
শেষ পর্যন্ত ভারতীয় ভোটারদের রাজনৈতিক আবেগ কি হিন্দুত্বের দ্বারা আবার পরিচালিত হবে? না কি গতবারের ভোটে হিন্দুত্ব এত বেশি ব্যবহার হয়ে গিয়েছে, যে, এই ওভার-স্যাচুরেটেড পরিস্থিতিতে বিজেপির আসন বেশি হওয়া সম্ভব নয়? সেটাও আমাদের দেখা বাকি।
বিজেপি আর বিরোধী পক্ষর এই আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণের মধ্যে শেষ প্রশ্নটা অবশ্য থেকে যাবে যে, বিরোধীদের মধ্যে এই যে হ-য-ব-র-ল, নানা বিরোধী দলের ঐক্য- আসন সমঝোতায় তা কতটা বাস্তবায়িত হবে? পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস, কমিউনিস্ট এবং ‘ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট’-এর জোট যেমন আছে, ঠিক একইভাবে কেজরিওয়াল এবং কংগ্রেসের মধ্যে বোঝাপড়া আগের থেকে ভাল হলেও, আসন সমঝোতার ক্ষেত্রে এই ঐক্য কতটা দেখা যাবে, তা নিয়ে সংশয় আছে। যতটা সম্ভব ১:১ আসন সমঝোতা করা যদি লক্ষ্য হয়, বিরোধীরা যদি সেই লক্ষ্যে সফল হতে পারে, কংগ্রেসের যদি দেরিতে হলেও বোধোদয় হয়- তাহলে বিরোধীদের আসন সমঝোতা বিজেপিকে চাপের মুখে ফেলতে পারে বিভিন্ন রাজ্যে।
এক-একটা রাজ্যে এক-এক রকমের চালচিত্র। কিন্তু এখনও পর্যন্ত বিভিন্ন রাজ্যে আসন সমঝোতা নিয়ে সুস্পষ্ট বিরোধী বিক্ষোভ, এবং ঐক্য এখনও দৃশ্যমান নয়। মুম্বইয়ে বিরোধী বৈঠকের পর এই সমঝোতার সম্ভাবনা বাড়বে কি না, দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তাও আপাতত বলা যায় যে, বিরোধীদের এহেন ঐক্যবদ্ধ রূপ কিন্তু বিগত দশ বছরে কখনও দেখা যায়নি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.