‘স্বৈরাচার থেকে গণতন্ত্রকে বাঁচাও’, অরবিন্দ কেজরিওয়ালের গ্রেপ্তারির বিরুদ্ধে এটাই এখন স্লোগান। এই পরিস্থিতি কি মেলে ১৯৭৭-এর সঙ্গে? ইন্দিরা গান্ধীর শাসনের সঙ্গে কি আদৌ মিল খায় নরেন্দ্র মোদির শাসনব্যবস্থা? গণতন্ত্র বাঁচানোর জেহাদই কি কেবল বিরোধীদের অক্সিজেন দিতে পারে এই মুহূর্তে? লিখছেন রাজদীপ সরদেশাই।
২০২৪ সালের নির্বাচনী প্রচারের অন্যতম হাতিয়ার হিসাবে ‘গণতন্ত্র বঁাচাও’ শিরোনামে একটি মিছিলের আয়োজন করেছিল কেন্দ্রের বিরোধীপক্ষ, দিল্লির রামলীলা ময়দানে। সেখানে ইয়াব্বড় একখান ব্যানারে লেখা ‘বিজেপি বনাম গণতন্ত্র’। বিরোধীপক্ষের বিভিন্ন দলের নেতা সেখানে একজোট হয়েছেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের (Arvind Kejriwal) গ্রেফতারির প্রতিবাদে। ‘স্বৈরাচার থেকে গণতন্ত্রকে বঁাচাও’, এটাই এখন গরমাগরম থিম। এহেন আখ্যানে শেষ জমায়েত ভারত সম্ভবত দেখেছিল, ১৯৭৭-এ, ‘জরুরি অবস্থা’-র বিরুদ্ধে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে (Indira Gandhi) একজোটে বিরোধী পক্ষ হারিয়ে ছেড়েছিল। কিন্তু, বাস্তবে, ২০২৪ আর ১৯৭৭ তো এক নয়। নরেন্দ্র মোদিকেও (PM Modi) ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে মেলানো যাবে না।
প্রথমত, কেবল পরিসংখ্যানের নিরিখেই, সাতের দশকের সেই ২১ মাস দীর্ঘ ‘জরুরি অবস্থা’-র সঙ্গে এখনকার তুলনা করা যায় না। সেবারে শ’য়ে-শ’য়ে রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক কর্মীকে জেলবন্দি করা হয়েছিল, উলটোদিকে এবারে কেবল গ্রেপ্তার করা হয়েছে দু’জন মাত্র মুখ্যমন্ত্রীকে, তুলনায় তুশ্চু। আবার, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলিকে ‘হাতিয়ার’ বানিয়ে বিরোধী নেতাদের দিকে লেলিয়ে দেওয়া ক্ষমতার অপপ্রয়োগের জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত, তার উলটোদিকে ‘জরুরি অবস্থা’-র তুলনা করাটাও বাগাড়ম্বর ব্যতীত কিছু নয়। তবে এটা স্পষ্ট, সমানে-সমানে লড়াইয়ের কোনও জায়গা বেঁচে নেই। আমরা প্রায় ‘বিরোধী-মুক্ত ভারত’ হয়ে ওঠার পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছি, যা যথেষ্ট চিন্তার বিষয়। মহারাষ্ট্রর মতো রাজ্যেই প্রত্যেকটা আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বহর দেখুন। বুঝতে পেরে যাবেন।
দ্বিতীয়ত, ১৯৭৭-এ, বিরোধীপক্ষ ছিল যথেষ্ট পোড় খাওয়া এবং জনমানসে তাদের প্রতি একটা সম্মানজনক অবস্থান তৈরি হয়েছিল। তুলনায় এই আধখেঁচড়া ‘ইন্ডিয়া’ জোটের কোনও ছিরি নেই। এই জোট কোনওভাবে একত্র, একনিষ্ঠ পক্ষ হিসাবে নিজেদের তুলে ধরতে পারছে না। সেই সময়, জনতা পার্টি রাতারাতি গড়ে উঠেছিল জনসংঘ এবং সোশালিস্টদের মিশেলে; আর তাদের লক্ষ্য ছিল একটাই: কঠোর কংগ্রেস-বিরোধিতা। জয়প্রকাশ নারায়ণের মতো অদমনীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতা ছিলেন সেই আন্দোলনের মুখ। তুলনায়, এখনকার রামলীলা ময়দানে এমন নেতৃত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি জয়প্রকাশের মতো নীতিকঠোর! মোদি-বিরোধী স্বর এই বিরোধী পক্ষের যোগসূত্র হতে পারে, কিন্তু স্থানীয় রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে ভুরভুর করছে স্ববিরোধ– পাঞ্জাবে আপ বনাম কংগ্রেস, পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস বনাম বাম-কংগ্রেস জোট, আবার কেরলে কংগ্রেস আর বাম একে-অপরের বিরোধী!
তৃতীয়ত, বিরোধী পক্ষের একাধিক নেতৃত্ব রয়েছেন, যঁারা একনায়কত্বে দুষ্ট, ফলে ‘গণতন্ত্র বিপন্ন’ স্লোগান তঁাদের জন্য খাটেনি। বিগত দশকে, বিরোধী পক্ষের একাধিক মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে স্বৈরী আচরণের অভিযোগ উঠে এসেছে– উদাহরণস্বরূপ পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু, কেরল, মহারাষ্ট্র (যখন রাজ্যটি ‘বিকাশ আঘাড়ি’ শাসনাধীন ছিল) সরকার-বিরোধী স্বরকে রীতিমতো দাবিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ইডি যদি কেন্দ্রীয় সরকারের হাতিয়ার হয়, তাহলে রাজ্য সরকারের কাছে ঢাল হয়ে উঠেছে রাজ্য পুলিশ।
চতুর্থত, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষার্থে যা কিছু দরকার এবং জনমানসের আচরণের মধে্য বিস্তর ব্যবধান তৈরি হয়েছে। ১৯৭৭-এর সময়, গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা হরণের বিরুদ্ধে জনগণের একটা বোধগম্য রোষ তৈরি হয়েছিল এবং প্রধানত উত্তর ভারতে এর চমৎকার প্রকাশ ঘটেছিল, যেখানে ইন্দিরা সরকারের বলপূর্বক ‘নির্বীজকরণ’ অভিযান জনসাধারণকে প্রভাবিত করে বাড়াবাড়ি দিকে ঠেলে দিয়েছিল। আবার মনে করে দেখুন, কীভাবে দক্ষিণ ভারতে জরুরি ব্যবস্থা সরাসরি ভোটারদের প্রভাবিত করেইনি। ১৯৭৭-এ কংগ্রেস সেখানে দৃঢ়ভাবে ঘঁাটি শক্ত রেখেছিল।
সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল, গণতন্ত্রের মূল্যবোধ ধরে রাখে মূলত সমাজের যে-শ্রেণি, সেই আর্বান মধ্যবিত্তদের চালচালন, আর্থ-সামাজিকভাবে বিঘত বদলে গিয়েছে, সেই সাতের দশকের তুলনায়। হালের দ্রুতগতিসম্পন্ন, প্রযুক্তি-নির্ভর অর্থনীতি, শহুরে অনাচারে ভরভরন্ত অহমধারী প্রজন্ম রাজনৈতিক সক্রিয়তা থেকে হয়ে উঠেছে ব্যাপকভাবে বিচ্ছিন্ন, যতক্ষণ না তাদের ব্যক্তিস্বার্থে আঘাত লাগছে। যেমন, বারবার পরীক্ষার প্রশ্ন ফঁাস হওয়ার বিরুদ্ধে যুবসমাজের বিক্ষোভ কিংবা কৃষক আইনের বিরুদ্ধে কৃষক শ্রেণির আন্দোলন। সবই ইতস্তত। কিন্তু, দেখা যাবে, ‘ক্লিক-বেট’ সোশাল মিডিয়া কেন্দ্রিক আন্দোলনে এই প্রজন্মের সক্রিয়তার শেষ নেই। এই ধরুন, ধ্রুব রাঠির ভাইরাল ভিডিও গণহারে শেয়ার হতে থাকে প্রোফাইলে-প্রোফাইলে, যখনই কোনওভাবে সাংবিধানিক স্বাধীনতার যুদ্ধ বাধে। গত শতকের ওই সাতের দশকে, ট্রেড ইউনিয়নের একটা অব্যাহত ধারা ছিল, জনসাধারণের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ রাজনৈতিক সক্রিয়তা ছিল, আর ছিল আদর্শবাদী রাজনীতি– যেখানে গণতান্ত্রিক পরিসরের জন্য লড়াই ছিল লক্ষ্য, গুরুত্বপূর্ণ চাহিদার অঙ্গ।
এখন সেসব হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ ও সমাজমাধ্যম বলয়ের মধে্যই অত্যধিক সচেতনতা ও দুশ্চিন্তার দেখনদারি হয়ে দঁাড়িয়েছে। তার বেশি কিছু ঘটে না। লক্ষণীয়, শেষবার শহুরে মধ্যবিত্তর ক্ষোভ রাজনৈতিক মহলকে আলোড়িত করেছিল, যখন অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও তঁার সতীর্থরা দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন শুরু করেছিলেন সেই ২০১১ সালে। রাজনীতিকে কলুষমুক্ত করার ধর্মযুদ্ধ হিসাবে তা চিহ্নিত হয়েছিল। সেই লড়াই ছিল এক অর্থে সামগ্রিকভাবে চালু রাজনীতির বিরুদ্ধেই। যারা শাসক পক্ষকে নিয়ে রীতিমতো তিতিবিরক্ত হয়ে উঠছিল, তাদের সমবেত চিৎকার হয়ে উঠেছিল– ‘সব নেতা চোর হ্যায়’। তখন কেজরিওয়াল ছিলেন প্রতিষ্ঠানবিরোধী ‘বহিরাগত’। তখন যাদের বিরুদ্ধে ছিল তঁার জেহাদ, এখন তারা-ই তঁার মিত্রপক্ষ। এভাবেই যেন বৃত্তটা সম্পূর্ণ হল। দুর্নীতি-বিরোধিতার মুখ হয়ে এককালে যাদের নিয়ে সরব হয়েছিলেন কেজরিওয়াল, এখন এই দিল্লি আবগারি দুর্নীতির অভিযোগের দাগ তিনি মুছতে তৎপর সেই তাদেরই সাহচর্যে। নিজেকে নিষ্কলুষ করার প্রকল্পই যে রাজনৈতিক যূথবদ্ধতার মূল কথা, তা আদৌ বিশ্বাসযোগ্য বা টেকসই হতে পারে কি?
নিয়তির এমনই পরিহাস, কেজরিওয়ালের ভারতকে দুর্নীতিমুক্ত করার এই প্রয়াসে, রাজনীতিবিদদের প্রতি যে চরমপন্থী বিদ্বেষ জন্ম নিয়েছিল, তার লাভের গুড়টা মূলত ভোগ করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। যুদ্ধবিধ্বস্ত মনমোহন সিং সরকারের ধ্বংসাবশেষের উপর দঁাড়িয়ে তিনি ক্ষমতায় আসীন হলেন। গোড়া থেকেই ইন্দিরা গান্ধীর মতো মূলধারার কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তিনি ছিলেন না, যিনি রাজনৈতিক ঔচিত্য-অনৌচিত্যর কোনও ধার ধারবেন। হঁ্যা, এ-কথা ঠিক যে, ইন্দিরা গান্ধীর শাসনশাস্ত্র থেকে কিছু বিষয় তিনি ধার করেছিলেনই। বিশেষত, রাজনৈতিক ক্ষমতায় একচ্ছত্র হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষী যে-বাসনা তিনি পোষণ করেন, তা চরিতার্থ হওয়ার পথে যাবতীয় যা প্রাতিষ্ঠানিক বাধা ছিল, সেসব সরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি কিছুটা ইন্দিরা-অনুসারী।
দ্বিধাহীন, জনপ্রিয় লৌহপুরুষ হিসাবে নরেন্দ্র মোদি প্রয়াত কংগ্রেসি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর চেয়ে রাজনৈতিকভাবে ঢের বেশি তীক্ষ্ণ এবং বেপরোয়া। ইন্দিরা গান্ধীর সংশয় বা ভীতির ঘিয়ে আগুন ঢেলেছিল পুত্র সঞ্জয় গান্ধীর আকাশচুম্বী আকাঙ্ক্ষা। তার দরুনই তড়িঘড়ি ‘জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা করতে কতকটা বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। নরেন্দ্র মোদি, অন্যদিকে, দাবি করেন, তিনি কাজ করেন সাংবিধানিক গণতন্ত্রর কাঠামোর ভিতরেই। যদিও, আদতে তিনি সুপরিকল্পিতভাবে সেই ব্যবস্থাকে সংসদীয় স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িক সংখ্যাগুরুবাদের দিকেই ঠেলছেন। ‘জরুরি অবস্থা’ ঘোষণার তো আর প্রয়োজনই নেই, কারণ ইতিমধে্য প্রবর্তিত আইনগুলোই তো যথেষ্ট বিরোধীদের কোণঠাসা করার জন্য। তাছাড়াও রয়েছে সহজেই বশ্যতা স্বীকার করা সংবাদমাধ্যম। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ‘প্রিভেনশন অফ মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট’-এর জামিন-সংক্রান্ত সংশোধনী সংসদে পাশ করানো হল ‘মানি বিল’-এর নাম করে, আর বিন্দুমাত্র ব্যাখ্যা ছাড়াই সুপ্রিম কোর্টের এক অবসরের দোরগোড়ায় থাকা বিচারপতি তাতে সম্মতিও দিয়ে দিলেন।
প্রসঙ্গত, সেই বিচারপতি এখন লোকপাল। দুর্নীতি-বিরোধিতার জনপ্রিয় মতাদর্শর আড়ালে রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য ব্যবহার করা হল এই ভয়ংকর আইনটিকে। জেল নয়, জামিন– এই ছিল মৌলিক ভাবধারাটি। এই প্রক্রিয়ায় পাশা উলটে গেল। প্রতিহিংসার রাজনীতি হয়ে উঠল স্বাভাবিক। এই কারণেই, স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের সবচেয়ে শক্তিশালী নির্বাচন যন্ত্রর পৃষ্ঠপোষকতায় সর্বশক্তিমান হয়ে ওঠা এক নেতাকে পরাস্ত করতে ‘গণতন্ত্র বঁাচাও’ জাতীয় স্লোগানের চেয়েও আরও বেশি কিছু প্রয়োজন বিরোধীদের।
পুনশ্চ: প্রায় গজদন্তমিনারে বসে করা একটি সমীক্ষা হয়েছে এই বছর ফেব্রুয়ারিতে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, ৬৭ শতাংশ ভারতীয় ভেবেছে, ‘সংসদ আর আদালতের বাধা ছাড়াই এক প্রবল-পরাক্রমী নেতা যে ব্যবস্থায় সব সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন, সেই ব্যবস্থাই দেশ শাসনের জন্য শ্রেয়।’ ২০১৭ সালে এমনটা ভেবেছিল ৫৫ শতাংশ। কী হবে গণতন্ত্রের?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.