কর্নাটক ব্যতিরেকে, ২০১৯-এ দক্ষিণে আর একটা রাজ্যেও দাঁত ফোটাতে পারেনি বিজেপি। কাট টু ২০২৪। দক্ষিণের প্রতিটি রাজ্যের জন্য স্বতন্ত্র কৌশল নিয়ে তারা মাঠে নেমেছে এবার। কোথাও আসন জেতার স্পৃহা, কোথাও ভোটের ভাগ বাড়ানোর মরিয়া প্রয়াস, ভবিষ্যতের জন্য জমি তৈরি করা। কিন্তু যেখানে বিজেপির আসল চ্যালেঞ্জ– দাক্ষিণাত্যে আন্তঃবিশ্বাসের সুদৃঢ় সম্প্রীতি, যা বিজেপি হজম করতে পারে না। লিখলেন রাজদীপ সরদেশাই
গত দু’-মাস ধরে, লাক্ষাদ্বীপের রৌদ্রকরোজ্জ্বল সমুদ্রতট থেকে দাক্ষিণাত্যের কেরল, তামিলনাড়ু এবং অন্ধ্রপ্রদেশ-জুড়ে বিভিন্ন মন্দির দর্শন করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি (PM Modi)– তা কি নেহাতই কাকতালীয়? উত্তর ও পশ্চিম ভারতে মোটামুটি জায়গা পাকা করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সম্ভবত এবার ভোটের অঙ্কটা আরও ঘুরিয়ে দিতে দৃঢ়প্রত্যয়ী হয়েছেন। দাক্ষিণাত্যে শাসন কায়েম তাঁর লক্ষ্য। কিন্তু, এ কি কেবলই নিপুণ সাজানো ঘটনা, নাকি ২০২৪-এর সাধারণ নির্বাচনে আমরা উত্তর-দক্ষিণ রাজনৈতিক বিভেদে উত্তরোত্তর ফাটলে শেষমেশ রাশ টানতে দেখব?
২০১৯-এর সাধারণ নির্বাচনের আগে একটি ‘মাই ইন্ডিয়া’ ওপিনিয়ন পোলের সমীক্ষা বলেছিল, নরেন্দ্র মোদি দাক্ষিণাত্য বাদে দেশের সমস্ত অংশে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জনপ্রিয় পছন্দ হিসাবে রাহুল গান্ধীর চেয়ে ঢের গুণে এগিয়ে। সমীক্ষাটি আরও বলেছিল, দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে রাহুল গান্ধী ৪০ শতাংশ এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ৩৭ শতাংশ সমর্থন পেয়েছেন, দেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, এই প্রশ্নে। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল কর্নাটক, যেখানে নরেন্দ্র মোদি রাহুল গান্ধীর চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। এই পরিসংখ্যান অনেকটাই মিলে গিয়েছিল প্রকৃত ফলাফলের সঙ্গে। একমাত্র কর্নাটকেই বিজেপি ২৮টি আসনের মধ্যে ২৫টি জিতেছিল এবং তেলেঙ্গানায় চারটি। কিন্তু এই ব্যতিরেকে, দক্ষিণে অন্য একটা রাজ্যেও দঁাত ফোটাতে পারেনি বিজেপি।
কাট টু ২০২৪। দক্ষিণের প্রতিটি রাজ্যের জন্য স্বতন্ত্র কৌশল নিয়ে বিজেপি মাঠে নেমেছে এবার। কর্নাটকে, বিজেপি দেবেগৌড়ার জেডি(এস)-এর সঙ্গে গঁাটছড়া বেঁধেছে, যে-দলকে উদ্দেশ্য করে গত বছর বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি ‘পিতা-পুত্র’ পরিবার-চালিত উদ্যোগ হিসাবে বিদ্রুপ করেছিল। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বি. এস. ইয়েদুরাপ্পা এবং তঁার ছেলেদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে, লিঙ্গায়ত-কেন্দ্রিক পদ্ধতিতে ফিরে আসা স্পষ্ট: ইয়েদুরাপ্পা মশাই বর্তমানে ৮১ বছর বয়সি। তাই মার্গদর্শক মণ্ডল অবসরের নিয়মগুলি স্পষ্টতই রাজ্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য থাকল না।
কেরলে দেখা যাচ্ছে, বিজেপি কখনও লোকসভা আসন জেতেনি। যদিও ২০১৯-এ উল্লেখযোগ্যভাবে ১২.৯ শতাংশ ভোট পায় তারা। প্রধানমন্ত্রী সেখানে যতই দাবি করুন, বিজেপি কেরলে দুই অঙ্কের আসন জিতবে, আদপে এ নিঃসন্দেহে নির্বাচনী প্রচারাভিযানের স্টান্ট। কিন্তু, এহেন দাবির মধ্য দিয়ে, এই রাজে্য বাম-কংগ্রেস দ্বিমুখী লড়াইয়ের বাইরে একটি বিরোধী স্থান দখল করে ভোটের ভাগ বাড়ানোর স্পষ্ট প্রয়াস বিজেপির রয়েছে। যেহেতু এই উভয় দলই, কেন্দ্রে বিজেপির বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ জোটের মিত্রশক্তি, তাই দিল্লিতে জোটবদ্ধ হওয়া এবং তিরুবনন্তপুরমে ক্ষমতার জন্য তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার অসংগতির বাস্তবতা হয়ে উঠেছে বিজেপির রাজনৈতিক বিরোধিতার আখ্যান।অন্ধ্রপ্রদেশে বিজেপি এখনও প্রান্তিক খেলুড়ে। তার কারণ সম্ভবত, দেশের একমাত্র এই রাজে্যই প্রকৃত দুই আঞ্চলিক দলের লড়াই সবচেয়ে জাগ্রত। জগন রেড্ডি বনাম চন্দ্রবাবু নাইডুর লড়াইয়ে, যে-দলই জিতুক না কেন, বিজেপি সম্ভবত জয়ী পক্ষের সঙ্গেই জোট বঁাধবে। তেলেঙ্গানায় বিজেপির দাপট তুলনামূলক বেশি। ২০১৯-এ এখানে চারটি আসন তারা জিতেছিল তো বটেই। তার চেয়ে বড় কথা, প্রায় ২০ শতাংশ ভোট জিতেছিল তারা। গত বছরের বিধানসভা নির্বাচনে
দলটি তৃতীয় স্থানে শেষ করেছিল। যা স্পষ্টতই বিজেপির উচ্চাকাঙ্ক্ষায় ধাক্কা। তবে লোকসভা নির্বাচনে সুযোগ অনেক বেশি, নতুন নতুন চেষ্টারও পরিসর অনেক। বিশেষত, ভারত রাষ্ট্র সমিতি কংগ্রেসের কাছে বিধানসভা পরাজয় থেকে এখনও নিজেদের গুছিয়ে উঠতে পারেনি যেহেতু।
যা আমাদের তামিলনাড়ুতে টেনে আনে, তর্কাতীতভাবে বিজেপির জন্য যে-রাজ্য সুচ হয়ে ঢুকে ফালা হয়ে বেরনোর সবচেয়ে আকর্ষণীয় অঞ্চল। ঐতিহাসিকভাবে, বিজেপি এমন একটি রাজ্যে নিজেদের দাগ রাখতে সংগ্রাম করছে, যেখানকার স্বতন্ত্র রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিজেপির বিশ্বদর্শনকে লক্ষণীয় আদর্শিক চ্যালেঞ্জ করে। উদাহরণস্বরূপ, যখন ডিএমকে মুখ্যমন্ত্রী এম. কে. স্টালিনের ছেলে এবং মন্ত্রী উদয়নিধি স্টালিন ‘সনাতন ধর্ম’ নির্মূল করার আহ্বান জানিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত করেছিলেন, তখন তিনি কেবলই নিজের ভোটের ভিত্তিকে সুসংহত করতে চাইছিলেন না, বরং একটি অ-ব্রাহ্মণ্যবাদী দ্রাবিড় পরিচয়কেও খাড়া করাতে চেয়েছিলেন, বিজেপির হিন্দুত্ববাদী আবেদনের পাল্টা হিসাবে। দ্রাবিড় রাজনৈতিক সমীকরণে, বিজেপির রাজনীতির ব্র্যান্ড উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্বের প্রতিনিধিত্ব করে,যেখানে সামাজিক ন্যায়বিচার এবং সমতার ধারণাগুলি কঠোরভাবে শ্রেণিবদ্ধ বর্ণ বিভাজনের কাছে হারিয়ে যায়।
দ্রাবিড় আন্দোলনের এই উগ্র হিন্দুত্ব-বিরোধী, ব্রাহ্মণ্যবাদ-বিরোধী মতাদর্শগত অবস্থান সময়ের পরীক্ষায় দঁাড়িয়ে থাকতে পারে, তবে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক এবং প্রজন্মগত পরিবর্তনও ঘটছে। তামিলনাড়ুতে ‘দুর্নীতি ও পারিবারিক রাজের বিরুদ্ধে রক্ষাকর্তা’ হিসাবে ৩৯ বছর বয়সি, আইপিএস অফিসার থেকে রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠা কে. আন্নামালাইয়ের আবির্ভাব সেই পরিবর্তনের প্রতিফলন। তঁার ১০০ দিনের যাত্রা হয়তো খেলা ঘোরাবে না, তবে স্পষ্টতই সেখানে বিজেপির জনপ্রিয়তা বেড়েছে। যেখানে কিনা প্রধান বিরোধী দল, ‘এআইএডিএমকে’ জয়ললিতা-পরবর্তী সময়ের ক্ষতবিক্ষত দলাদলি থেকে এখনও নিজেদের পুনরুদ্ধার করতেই পারেনি। আশ্চর্যের লাগে না, সাম্প্রতিক একটি জনমতে আসন সংখ্যা নগণ্য হলেও বিজেপি ২০ শতাংশ ভোট কায়েমের আভাস উঠে এসেছে।
এক অর্থে, বিজেপির এই দক্ষিণি দমক মোদি-যুগে তার ভারতব্যাপী হয়ে ওঠার উচ্চাকাঙ্ক্ষারই প্রতিফলন। ঠিক যেমনটা কংগ্রেস তার শ্রেষ্ঠ সময়ে হতে চেয়েছিল বা হয়েছিল অনেকাংশে। এর জন্য বিজেপি তার সংঘ পরিবারকে রাজনৈতিক ও আদর্শিকভাবে আরও নমনীয় করতে পিছপা হবে না। ‘এক জাতি এক নেতা এক ধর্ম’ নীতি থেকেও দূরে সরতে বাধ্য করতেও পারে। লোকসভায় পরপর দু’বার সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও, গেরুয়া শক্তির শিকড় কিন্তু সেই হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের রাজনীতিতে নিহিত, যার ঘঁাটি গোবলয়। শুধু কর্নাটকের বাইরে দাক্ষিণাতে্য আধিপত্য বিস্তার করতে হলে আরও অন্তর্ভুক্ত আদর্শের প্রয়োজন, যা ভারতীয় বহুত্ববাদী সংস্কৃতির উদ্যাপন করে।
তাহলে, হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদ কি তামিল উপ-জাতীয়তাবাদকে স্থান দিতে পারবে? শুধু নতুন সংসদে সেঙ্গল (রাজদণ্ড) স্থাপন করে প্রতীকী উদারতার পরিচয়ে নয়, হিন্দি ভাষা কোনওরূপে চাপিয়ে না দিয়ে ভাষাগত বৈচিত্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রেও তারা উদ্যমী হবে কি? উত্তর ভারতের রাজ্যগুলিতে ধর্মান্তর বিরোধী কঠোর আইনের মাধ্যমে খ্রিস্টান মিশনারিদের যেভাবে লক্ষ্যবস্তু করা হয়, তা থেকে কেরলের খ্রিস্টান সম্প্রদায়কে আকৃষ্ট করার চেষ্টা কি পৃথক করা যাবে আদৌ? উত্তরপ্রদেশে মুসলিমদের বাড়িতে বুলডোজার চালিয়ে তাণ্ডব চালানো কি দাক্ষিণাতে্য আন্তঃবিশ্বাসের সম্প্রীতির থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে, যা দক্ষিণ ভারতের বেশিরভাগ অঞ্চলে বিরাজ করে?
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ– দক্ষিণ ভারতজুড়ে বিজেপিকে যদি রাজনৈতিক বিস্তার পেতেই হয়, তার জন্য দিল্লির সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতাকে ছেঁটে যুক্তরাষ্ট্রীয় চেতনার প্রতি আন্তরিক প্রতিশ্রুতি প্রয়োজন। ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের স্পৃহা থেকে তাদের বিরত হতে হবে। আর্থিক সংস্থান বণ্টন নিয়ে দক্ষিণের মুখ্যমন্ত্রীরা যে-উদ্বেগ প্রকাশ করে চলেছেন, তা নির্বাচনী তরজা হিসাবে উড়িয়ে দিলে বিজেপি পার পাবে না। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য ভবিষ্যতের কোনও সীমাবদ্ধতা অনুশীলনে দক্ষিণের রাজ্যগুলিকে শাস্তি দেওয়াও যাবে না। সত্যি হল, অধিক শিক্ষিত, অর্থনৈতিকভাবে উন্নত, সামাজিকভাবে প্রগতিশীল দক্ষিণের রাজ্যগুলি ইতিমধ্যেই ‘বিকশিত’ এবং আরও বিকশিত হওয়ার দিকে এগচ্ছে। ফলে, বাকি ভারতকে তারই পদানুসরণ করতে হবে।
পুনশ্চ: কয়েক হপ্তা আগের কথা। ‘মুড অফ দ্য নেশন’ জনমত দেখে, ‘ইন্ডিয়া’ জোটের একজন নেতা বেশ ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘দক্ষিণেও যদি সাধারণ নির্বাচনের ভোট উত্তর ও পশ্চিমের মতোই গণনা করা হয়, তাহলে আমাদের ক্ষমতায় আসার কিন্তু ভালোই সম্ভাবনা রয়েছে!’
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.