দেশের রাজনীতি ইদানীং যে-ধরনের রং ও রূপ ধারণ করেছে, তাতে নির্বাচনী ইস্তাহারকে অলীক প্রতিশ্রুতি বলা যেতেই পারে। বিজেপি, কংগ্রেস বা অন্যান্য দল কেউ-ই এই নিয়মের বাইরে নয়। লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়।
কংগ্রেসের নির্বাচনী ইস্তাহার এবার প্রথম দিন থেকেই বিজেপির আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে উঠেছে। সেই আক্রমণ, অন্য কেউ নন, শানিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। কংগ্রেসের ইস্তাহার, যার নাম তারা দিয়েছে ‘ন্যায়পত্র’, তাতে ‘মুসলিম লিগ’-এর ভাবনাচিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে বলে মোদি অভিযোগ করেছেন। কারণ, ন্যায়পত্রে কংগ্রেস সবার (বিজেপির চোখে মুসলমান) সাংবিধানিক অধিকার, ধর্মীয় আচার পালনের অধিকার, কে, কী খাবে, কী পরবে তা ঠিক করার অধিকার রক্ষার উপর জোর দিয়েছে। মোদির আক্রমণের রাজনৈতিক ব্যাখ্যা কংগ্রেসকে মুসলমানদের পার্টি বলে দাগিয়ে হিন্দু ভোট এককাট্টা করা। অর্থাৎ, ধর্মীয় মেরুকরণ–যে-কাজটা তারা নিষ্ঠা ও দক্ষতার সঙ্গে করে আসছে।
বিজেপির প্রচারের সুরও মোদিই বেঁধে দিয়েছেন। তঁার প্রচারের ঢং একবার দেখুন। অযোধ্যার উল্লেখ করে বলেছেন, কংগ্রেস মন্দির নির্মাণে আসেনি। প্রাণপ্রতিষ্ঠাতেও যোগ দেয়নি। এমনকী, সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া নেতাদের দল থেকে বের করে দিয়েছে। এটা ভগবান রামচন্দ্রকে অস্বীকারের শামিল। সেই কংগ্রেসকে কি ভোট দেওয়া যায়? পরক্ষণেই তিনি টেনে এনেছেন আসন্ন রামনবমীর কথা। কংগ্রেসের উদ্দেশে জনতাকে সাক্ষী রেখে বলেছেন, দেখি, ওরা রামনবমীর কত বিরোধিতা করতে পারে!
লক্ষণীয়, এ পর্যন্ত যতগুলো জনসভা মোদি করেছেন, প্রতিটিতে হিন্দুত্ববাদী চেতনার বিকাশ ও ধর্মীয় মেরুকরণের চেষ্টাই বড় হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি অবশ্য ‘ইন্ডিয়া’ জোটকে কটাক্ষ করেছেন। কংগ্রেসকে তুলোধোনা করেছেন। পরিবারতন্ত্রকে আক্রমণ করেছেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তঁার ‘নিরলস লড়াই’-এর কথা শুনিয়েছেন। কিন্তু কী আশ্চর্য, তঁার সরকারের সাফল্যের খতিয়ানের ধারকাছ দিয়েও হঁাটছেন না! অর্থনীতির বহরে বিশ্বের পঞ্চম দেশ হওয়ার কথা গর্ব করে বললেও মাথাপিছু আয়ের তালিকায় ভারত কেন ১৩১ নম্বরে, তার কোনও উত্তর আগেও দেননি, এখনও দিচ্ছেন না। দরিদ্রদের খরচের ক্ষমতা কেন আরও কমে গিয়েছে, সে নিয়েও তিনি নিরুত্তর। হ্যাটট্রিকের পর বেকারত্বের জ্বালা মেটাতে কী করবেন জানাননি। চাকরিবাকরির বেহাল অবস্থার দাওয়াই কী, তা-ও বলেননি। ‘বিকশিত ভারত’-এর অর্থনীতি কীভাবে পল্লবিত হবে ভাষণে সে সবের উল্লেখ নেই। লাদাখে চিনের দাপাদাপির প্রসঙ্গও যথারীতি অনুচ্চারিত।
সবচেয়ে বড় কথা, এই মুহূর্তের রাজনীতির সবচেয়ে চনমনে বিষয়, যা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ‘ঘোটালা’, সেই ইলেক্টোরাল বন্ড নিয়ে একটি বাক্যও তঁার মুখে শোনা যাচ্ছে না! চালু বাংলায় যাকে বলে ‘হাওয়ায় খেলা’, নরেন্দ্র মোদি সেটাই করে যাচ্ছেন। অবশ্য এতেই যদি কাজ হয়, তাহলে বাড়তি কিছু করার দরকারই বা কী?
কংগ্রেস এখনও ছন্নছাড়া। ‘ইন্ডিয়া’ জোটের অন্য শরিকরাও তথৈবচ। তবু তারই মধ্যে কংগ্রেস তার ইস্তাহারে দেশ পরিচালনার একটা রূপরেখা স্পষ্টভাবে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। মোদি সরকারের বিরুদ্ধে তার সবচেয়ে আক্রমণ যে যে বিষয়ে, যেমন বেকারত্ব, কর্মসংস্থান, দরিদ্রদের অর্থায়ন, কৃষক সমস্যা, বিদেশনীতি, সেগুলির সমাধানের নির্দিষ্ট প্রস্তাব তারা দিয়েছে।
কেন্দ্রীয় সরকারের ৩০ লাখ পদ এই মুহূর্তে খালি। মোদি সরকার তা নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য না করলেও কংগ্রেস বলেছে, প্রতিটি শূন্য পদে নিযুক্তি দেবে। ওসব পদের অর্ধেক ভরানো হবে মহিলাদের দিয়ে। ন্যূনতম দৈনিক শ্রমের মূল্য ৪০০ টাকা করার কথা বলা হয়েছে। আর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ পালনের।
সেই সঙ্গে ‘এমএসপি’ (মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস)-র আইনি বৈধতা। দেশের রাজনীতি ইদানীং যে ধরনের রং ও রূপ ধারণ করেছে, তাতে নির্বাচনী ইস্তাহারকে অলীক প্রতিশ্রুতি বলা যেতেই পারে। হয়তো প্রতিশ্রুতি তৈরিই হয় উপেক্ষা ও অবহেলার জন্য। জেতার পর কে তার প্রতিশ্রুতি কতটা রূপায়ণ করেছে দেখলেই বোঝা যায়। ফলে ইস্তাহারগুলো প্রথম দিন থেকেই এলেবেলে হয়ে ওঠে। বিজেপি, কংগ্রেস বা অন্য দল কেউ-ই এই নিয়মের বাইরে নয়। যদিও প্রতিশ্রুতি পালনের একটা প্রবণতা ইদানীং রাজ্য স্তরে দেখা যাচ্ছে। আম আদমি পার্টি দিল্লি ও পাঞ্জাবে তা কিছুটা করে দেখিয়েছে। কংগ্রেস করেছে কর্নাটকে ও তেলেঙ্গানায়। তাতে অর্থনীতি আরও বেহাল হচ্ছে কি না, সে তর্ক ভিন্ন।
কংগ্রেসের ইস্তাহার মোদি সরকারকে যে-ক’টি তিক্ত সত্যের মুখে দঁাড় করিয়েছে, প্রতিবেশী নীতি তার একটি। মোদির ‘সাফল্যের সাতকাহন’-এর বিপ্রতীপে অবশ্যই যা চরম ব্যর্থতা। কংগ্রেস জানিয়েছে, সেই ব্যর্থতার মোকাবিলা তারা করবে জওহরলাল নেহরুর আদর্শ অঁাকড়ে, মোদি যঁাকে এ-দেশের সব সর্বনাশের মূল বলে কাঠগড়ায় তুলেছেন।
গত দশ বছরে প্রতিবেশীদের মধ্যে কে কতটা চিনের দিকে ঝুঁকেছে, কাদের উপর চিনের প্রভাব দ্রুত বাড়ছে, তা বোধ করি খুব একটা বিস্তারে বলার প্রয়োজন নেই। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকেছে নেপাল। দশ বছর ধরেই এই প্রবণতা লক্ষণীয়। ইদানীং ঝুঁকেছে মালদ্বীপ। এতটা খোলামেলা ভারত বিরোধিতা তারা আগে করেনি। ভুটানের মতো দেশও চিনের চাপে মাথা নোয়াচ্ছে। তাদের সঙ্গে এখনও চিনের কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই, কিন্তু ডোকলাম পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ দ্রুত অন্য দিকে বঁাক নিচ্ছে। অর্থনৈতিক সংকট কাটানোর পর শ্রীলঙ্কা থিতু হওয়ার চেষ্টা করছে। চিনের সঙ্গে সম্পর্কে কিছু পর্দা টানার চেষ্টাও তারা করছে। কিন্তু কচ্চতিভু দ্বীপ নিয়ে মোদি যা করলেন, তাতে তারাও বিস্মিত। ভারতের কোনও প্রধানমন্ত্রী এমন অবিমৃশ্যকারী আগে কখনও হননি। তাও স্রেফ তামিলনাড়ুর মতো এক অঙ্গরাজ্যের ভোটে প্রাসঙ্গিক হওয়ার চেষ্টায়।
পঁাচ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাত ধরে ‘অাব কি বার ট্রাম্প সরকার’ স্লোগান দিয়ে মোদি কূটনৈতিক হঠকারিতার অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলেন। এবার করলেন কচ্চতিভু দ্বীপটা কেন শ্রীলঙ্কাকে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল সেই প্রশ্ন তুলে। সরাসরি বললেন, নেহরু-গান্ধী পরিবারের কাছে দেশ কোনও কালে মর্যাদা পায়নি। অথচ, ৫০ বছর ধরে বিজেপি এই বিষয়ে প্রশ্ন তোলেনি। ১০ বছর ধরে মোদিও তার অবতারণা করেননি। কূটনীতিক হিসাবে জয়শঙ্করও ৪৫ বছর ওই নীতি সমর্থন করেছেন। রাজনীতিক হয়ে এখন মোদির সুরে তিনিও পোঁ ধরেছেন।
কচ্চতিভু দ্বীপটির অধিকার শ্রীলঙ্কাকে ভারত দিয়েছিল ১৯৭৪ সালে, সুপ্রতিবেশী-সুলভ আচরণের নিদর্শন রেখে। সুসম্পর্কের খাতিরে। সে সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী, শ্রীলঙ্কার সিরিমাভো বন্দরনায়েক। দুই বর্গ কিলোমিটারেরও কম আয়তন বিশিষ্ট ওই জনমানবহীন দ্বীপ ছেড়ে দেওয়ার বদলে ভারত পেয়েছিল কেপ কমোরিনের কাছে ‘ওয়াজ ব্যাঙ্ক’-এর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। চুক্তি অনুসারে, ওয়াজ ব্যাঙ্কের সমুদ্র সম্পদের মালিকও ভারত। সম্প্রতি ভারত সরকার সেখানে পেট্রোলিয়াম ও গ্যাস অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এই কাণ্ডটা মোদি কেন করলেন? করলেন কচ্চতিভু নিয়ে তামিল সেন্টিমেন্টে উসকানি দিয়ে তামিলনাড়ুতে দু’-চারটি আসন পাওয়ার লোভে। দাক্ষিণাত্য সঙ্গ না দিলে ‘আব কি বার চারশো পার’ হবে না সেই শঙ্কায়। কিন্তু তিনি ভুলে গেলেন, জমি হস্তান্তর করা না করা যদি দেশপ্রেমের সংজ্ঞা অথবা মানদণ্ড হয়, তাহলে ইন্দিরার চেয়ে তিনি আরও বড় দোষী। কেননা, বাংলাদেশকে ১১১টি ছিটমহল হস্তান্তর তিনিই করেছেন, বিনিময়ে পেয়েছেন মাত্র ৫৫টি। গালওয়ান সংঘর্ষের পর লাদাখে ২০০০ বর্গ কিলোমিটার জমি চিন দখল করে রেখেছে তঁার আমলেই। এসব সত্য স্বীকারের সাহসও তঁার নেই।
আরও সত্যি, ঘনিষ্ঠতম বন্ধু ও প্রতিবেশী বাংলাদেশে ভারত বিরোধিতার মাত্রা দিন-দিন বেড়ে চলেছে। মালদ্বীপের ঢঙে সেখানেও ‘আউট ইন্ডিয়া’ আন্দোলনের হঁাক উঠেছে। ভারতীয় পণ্য বর্জনের দাবি উঠছে। বিচলিত হওয়ার মতো তীব্রতা ওই আন্দোলন এখনও অর্জন করেনি। করবেও না। পারস্পরিক সম্পর্ক এত ঠুনকো নয়। কিন্তু এমন একটা ধুয়ো উঠবে কেন? কোন আচরণ বা নীতির কারণে?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে নরেন্দ্র মোদিকে নিজের দিকেই তাকাতে হবে। সে দায় কিন্তু নেহরু-ইন্দিরার উপর চাপানো যাবে না।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.