২০২৪। ভোটের দামামা বেজে গিয়েছে। তারই মাঝে আত্মবিশ্বাসী বিজেপি দেশজুড়ে জারি করল বিতর্কিত ‘সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট’। তবে এহেন প্রতিকূল পরিস্থিতিকে কীভাবে অনুকূল আনতে হয়, তা মমতা-অভিষেক জানেন। ‘ক্যা’ এই রাজ্যে সংখ্যালঘু ভোটকে আরও এককাট্টা করে দেবে বলেই ধারণা। লিখলেন জয়ন্ত ঘোষাল।
এথেন্স শহরের প্রাচীন রাজনৈতিক-প্রশাসনিক কেন্দ্রে এখনও রাখা আছে একটি বড় পাথরের চাঁই। এই পাথরের শরীরে আছে অজস্র ছিদ্র। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে তৈরি এক নির্বাচনী যন্ত্র। হালের ঐতিহাসিকরা এই যন্ত্রটির নাম দিয়েছেন ‘লটারি-বল মেশিন’। এথেন্সে এই যন্ত্রটির নাম ছিল ‘ক্লিরোটেরিয়ন’। সেই সময়ে প্রশাসনিক পদে নিয়োগে ইচ্ছুক প্রার্থীরা তাদের নাম এই যন্ত্রের ছিদ্রগুলোতে গুঁজে দিয়ে যেত। তারপর লটারির মাধ্যমে প্রশাসক মনোনীতরা নির্বাচিত হত। কে এই যন্ত্রের উদ্ভাবক, তা কারও জানা নেই। প্রদর্শনশালায় সাদা মার্বেল পাথরের উপর রাখা ঝকঝকে কাচের শোকেসের ভিতর রক্ষিত এখনও। সেদিন এটাই ছিল নির্বাচনী গণতন্ত্র।
২০২৪। ভারতেও ভোটের দামামা বেজে গিয়েছে। সারা দেশ, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গ, যেন রণাঙ্গন– কুরুক্ষেত্র। কে জিতবে, কে হারবে তা নিয়ে শুরু হয়ে গিয়েছে কথার আদানপ্রদান। তবে যেই জিতুক, গণতন্ত্র যে ক্রমশ মৃতু্যপথযাত্রী– এ বিষয়ে একমত পৃথিবীর বিপুল বিদ্বৎসমাজ।
গণতন্ত্রের বয়সও তো অনেক হয়ে গেল! খ্রিস্টপূর্ব ৬৩২-এ এথেনিয়ান ইতিহাসে প্রথম নথিভুক্ত শব্দ ‘ডেমোক্রাটিয়া’। ‘ক্রাটিয়া’– মানে ক্ষমতা, ‘ডেমোস’ অর্থাৎ মানুষ। আর এই বৃদ্ধ গণতন্ত্রের ‘অ্যান্টিডোট’– নির্বাচনের নামে ব্যক্তির শাসন। সতি্য-সতি্যই গণতন্ত্র বিপন্ন– She is in deep crisis।
গ্রিক দার্শনিক থুকিডিসিস বলেছিলেন, গণতন্ত্রকে যদি সতি্য সতি্যই বঁাচাতে হয় তবে প্রয়োজন এমন এক মানুষের শাসন, যিনি নীতি ও ন্যায্যতাকে শ্রদ্ধা করবেন। ‘What was in name a democracy was infact the rule of the principal man.’ এখন, এত বছর পর আধুনিক সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, ‘নীতিবান কে?’ নীতির কথা শুধু বললে হবে না। কাজে তা করে দেখাতে হবে। যারা শুধু গলা ফাটাচ্ছে মানুষের স্বার্থরক্ষার কথা বলে যাচ্ছে তারা নয়, যারা সত্যি-সত্যি করছে মানুষের জন্য, তাদের খুঁজে বের করতে হবে। ‘ডেমাগগ’ মানে যারা বকবক-রত্ন, সেসব বক্তিয়ার খিলজির বিরোধিতা করা প্রয়োজন। দেশজুড়ে নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপির দশ বছরের সাফল্য-কাহিনি অাকাশে-বাতাসে ধ্বনিত। বিজ্ঞাপনের অপার মহিমা। মুখ ঢেকে তো যাবেই!
রাজধানী দিল্লিতে আছি প্রায় চল্লিশ বছর। প্রত্যেকটি নির্বাচনের সময় শিকড়ের টানে এই বাংলায় আসি। এখানে মানুষের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল, রাজনীতি-চর্চা। ভোটের সময় রাজনীতি নিয়ে আড্ডা হল সেরা বিনোদন। আপাতত চ্যানেলে-চ্যানেলে, ডিজিট্যাল প্ল্যাটফর্মে, সোশ্যাল মিডিয়ায় সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার ভোট। সকালে হাওড়ার বোটানিক্যাল গার্ডেনে হেঁটে শিবপুর বিই কলেজের প্রথম গেটের সামনে সনৎদার চায়ের দোকানে ভঁাড়ের চা নিয়ে বেঞ্চিতে বসি। তখন রোজ শুনি বিপুল বিতর্ক। কী হবে ভোটের ফল? অর্জুন সিং থেকে মুখ্যমন্ত্রীর ভাই বাবুন– সবই আলোচনার বিষয়। সন্দেশখালি থেকে ‘ক্যা’ (CAA)– সব রয়েছে। আবার হরিয়ানায় হঠাৎ মুখ্যমন্ত্রী বদল হয়ে গেলে সর্বভারতীয় চ্যানেলগুলোতে দু’-একদিন দাপাদাপি। কিন্তু বাঙালি হরিয়ানা নিয়ে উদ্বিগ্ন নয়। ডেল কার্নেগি তাই বোধহয় বলেছিলেন, চিনের দুর্ভিক্ষে শত শত মানুষের মৃতু্য যন্ত্রণার চেয়ে আমার দঁাতের যন্ত্রণার কষ্ট অনেক বেশি।
দিল্লির পোলস্টারগণ বলছেন, ২০২৪-এ পশ্চিমবঙ্গ হল এখন ‘মাদার অফ অল ইলেকশনস’। সেদিন এক রসিক অধ্যাপক জিজ্ঞেস করেছিলেন, রাজে্য এসেছেন। বিজেপি (BJP) বনাম তৃণমূল (TMC) কী বুঝছেন? আমি বললাম, এথেন্সের সেই গণতন্ত্র এখন এ-দেশেও এক চরম অগ্নিপরীক্ষার মুখোমুখি। তবু এই ভয়াবহ গণতন্ত্রর পটভূমিতে আপাতত আমার কিছু সুনির্দিষ্ট অবজারভেশন আছে। দর্শনের পরিভাষায় কিছু ‘প্রেমাইসেস’ বা ‘বচন’। প্রথম বচন, ২০১৯ সালে ১৮টা আসন পেয়ে বিজেপি রক্তের স্বাদ পায়।
২০২১-এ মমতা ম্যাজিক বিজেপির উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে পপাত ধরণীতলে করে দিল। কিন্তু বিজেপির উৎসাহে ঘাটতি নেই। দ্বিতীয় বচন, ২০২৪-এ লোকসভা ভোটের মুখেও বিজেপি ২০১৯-এর ‘জয় শ্রীরাম’ তথা হিন্দুত্বের রাজনীতিতে কোনও বদল আনল না। অমিত শাহ ও তঁার টিম এখনও মনে করেন, দু’বার ভাগ হওয়া বাংলার বাঙালি হিন্দুদের মধে্য হিন্দি বলয়ের ‘হিন্দুত্ব’ দর্শনকে জাগরিত করা এখনও সম্ভব। অতীতে বাঙালির আখ্যানে ভদ্রলোকদের মধে্যও হিন্দুয়ানা ছিল, ছিল প্রচ্ছন্ন মুসলিম বিরোধিতাও, তাকে পুনরায় উসকে দেওয়া সম্ভব। তাই ‘মিশন বেঙ্গল’-এর অমিত শাহ-র লাইন অপরিবর্তিত। তবে প্যাকেজে আছে মোদিত্বও। অতএব হিন্দুত্ব+মোদিত্ব। তৃতীয় বচন, তৃণমূল দু’-দশকের অধিক শাসক দল। জেলায় জেলায় দুর্নীতি দাদাগিরি– প্রকৃতির সূত্র। আর মন্ত্রী ও নেতাদের বিরুদ্ধে এনফোর্সমেন্ট ও সিবিআইয়ের তদন্ত এবং তার প্রচার। সন্দেশখালি ও শাহজাহান হল বিজেপির এই প্রচারের ব্র্যান্ড ইকুইটি। চতুর্থ বচন, সবশেষে এল ‘ক্যা’। বাঙালি উদ্বাস্তু-হিন্দু একদা ছিল সিপিএমের ভোট ব্যাঙ্ক। হালে মমতার অন্যতম শক্তিস্থল। তার ভিতর আবার আছে নমশূদ্র-মতুয়া। বাংলা দখলের জন্য বাঙালিকেই বিভাজনের রণকৌশল। এ হল বিজেপির সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়রিং।
সবশেষে, আমার নিজের বক্তব্য জানাই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সমগ্র দেশে একমাত্র নেতা যিনি বিজেপির এই কৌশলের মোকাবিলা করতে পারেন। উত্তর ভারতে অখিলেশ বা রাহুল গান্ধী, এমনকী, কেজরিওয়ালও পারছেন না। মমতার মস্ত বড় সম্পদ– তঁার সেকেন্ড ইন কম্যান্ড অভিষেক বন্দে্যাপাধ্যায়। মমতার শক্তি: শত্রুকে ভাল করে বোঝার কাজটা আগে করতে হয়। ছাত্রজীবনে মাস্টারমশাইরা বলতেন, প্রশ্নপত্রের প্রশ্নগুলো মন দিয়ে পড়বি। প্রশ্ন না বুঝে উত্তর লিখিস না। প্রতিকূল পরিস্থিতিকে তাই কীভাবে অনুকূলে আনতে হয় সেই জাদু মমতা-অভিষেক জানেন। ‘ক্যা’ (CAA) এই রাজ্যের সংখ্যালঘু ভোটকে আরও এককাট্টা করে দিয়েছে। নিরাপত্তা ও ভোট ব্যাঙ্কও দুই-ই বাড়ল। ইটের বদলে পাটকেলের রাজনীতি মমতা যে কীভাবে সম্ভব করতে পারেন তা এখনও দিল্লি বুঝে উঠতে পারল না।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.