বোরিয়া মজুমদার: শেষ টেস্টের বোলিং আক্রমণ গড়ে তুলবেন নভদীপ সাইনি (যিনি চোট পেয়ে মাঠের বাইরে), শার্দূল ঠাকুর, মহম্মদ সিরাজ, টি. নটরাজন এবং ওয়াশিংটন সুন্দর। একথা যদি কেউ ভারত-অস্ট্রেলিয়া টেস্ট সিরিজের শুরুতে একজন ভারতীয় সমর্থককে বলত, তাহলে তিনি সে-কথা শুধু হেসে উড়িয়েই দিতেন না, হয়তো ঠাট্টা করে দু’-চারটে বক্রোক্তি শুনিয়েও দিতেন। আপনি যদি বলেন, ‘জানেন, আকাশটা হলদে, আর কিছুক্ষণ এমনটাই থাকবে’– তাহলে তার যা মানে দাঁড়াবে, এক্ষেত্রেও তাই।
আসলে খেলাধুলো দাঁড়িয়েই আছে গল্পের উপর, নানা আখ্যানের উপর। মুহূর্তে বাঁচা এবং উপভোগ করাই আসল মন্ত্র। বিশ্বাস করুন, একথা বলা যত সহজ, বাস্তবে ততটা নয় কিন্তু। ধরা যাক, ব্রিসবেন ক্রিকেট গ্রাউন্ড বা গাব্বার পবিত্র দুর্গে অস্ট্রেলিয়ার মোকাবিলা করতে হবে, একটি বিধ্বস্ত দলকে সঙ্গে নিয়ে। মানসিকভাবে আপনি কী করে এই চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবেন?
অনেকেই বলেছেন, এটা ভারতের ‘বি টিম’, ভারতের প্রথম দল কখনওই নয়। হ্যাঁ, তাঁরা ঠিকই বলছেন। ভারতের প্রথম দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে সাত থেকে আটজন অনুপস্থিত। এই দল ভারতের শ্রেষ্ঠ একাদশের দূরদূরান্তেও নেই। তবে যাই হোক, এসবের নিরিখে এই দল ‘ইন্ডিয়া এ’ অথবা ‘ইন্ডিয়া বি’ হয়ে যায় না। যে-ছেলেরা কঠিনতম পরিশ্রম করে ভারতীয় দলে খেলার আহ্বান পেয়েছেন, তাঁদের প্রত্যেকের কাছে এটাই ‘ভারতীয় টিম’। তাঁরা প্রত্যেকেই বছরের পর বছর শ্রম দিয়ে গিয়েছেন এই অবস্থান অর্জনের জন্য, এবং এই মুহূর্তটা তাঁদের কাছে আকাশ ছোঁয়ার মতো আনন্দের। আমরা শুধু এইটুকুই করতে পারি, তাঁদের ‘ইন্ডিয়া বি’ না বলে ‘ভারতীয় খেলোয়াড়’ বলে ডাকতে পারি। যেসব মহারথী আন্তর্জাতিক স্তরে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন, এই খেলোয়াড়রাও তাঁদের সেই অভিজাত পরম্পরার অংশ।
হার-জিত সম্পূর্ণ অন্য বিষয়। শেষ টেস্টটা অস্ট্রেলিয়া তাদের ঘরের মাঠে জিতবে- সেই সম্ভাবনাটাই প্রবল। কিন্তু খেলায় জেতা-হারার ঊর্ধ্বেও আরও কিছু আছে। সম্মান আছে, মর্যাদা আছে, সাহস আছে এবং একাগ্রতা আছে। বাস্তবে কে জিতল আর কে হারল, তা যেমন জরুরি, ঠিক ততটাই জরুরি আদর্শ, নীতি। যদি অস্ট্রেলিয়া বাস্তবে জয়ী হয়ও, তাহলেও নৈতিক জয় এবং আস্ফালনের অধিকার অস্ট্রেলিয়া (Australia) সমর্পণ করে দিয়েছে ভারতকে (Team India)। ফলাফল যা-ই হোক, ভারত কিন্তু দেশে ফিরবে মাথা উঁচু করেই। ভারতীয় খেলোয়াড়রা অস্ট্রেলিয়ায় যা অর্জন করেছেন, তাতে এটাই স্বাভাবিক। ৩৬ অল আউট থেকে শুরু করে মেলবোর্নে খেলা ঘুরিয়ে দেওয়া বা সিডনিতে প্রতিরোধ গড়ে তোলা-এই সিরিজ পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ‘রূপকথা’ হয়ে থেকে গেল। এই কোভিড-কালে এরকমটাই তো আমরা সকলে চাই, তাই নয় কি? আমাদের সাহসের আখ্যান প্রয়োজন, যা আমাদের আকাঙ্খাকে উদ্ভাসিত করে, যে আখ্যানে আমরা নিজেদের খুঁজে পাই। মাঠের গণ্ডি ছাড়িয়েও যে আখ্যানের অন্যতর
তাৎপর্য থেকে যায়, যা বাস্তব জীবনে অনুসৃত হতে পারে।
এই সিরিজ ২০২১-এর উপযুক্ত সূচনা। এই বছর ভাঁড়ারে কী লুকিয়ে রেখেছে, তার প্রকৃত প্রতিবিম্ব হয়ে উঠতে পারে এই সিরিজ। ২০২১ আশাবাদের বছর, একই সঙ্গে এই বছরটাতে অনেক চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করে আছে। দেশের প্রতিটি কোণে টিকাকরণ শুরু হওয়ায় এখন প্রত্যেক দেশবাসীই বিশ্বাস করছে, কোভিডের বিরুদ্ধে আমাদের অস্ত্র মজুত আছে। আবার একথাও ভেবে দেখতে হবে যে, এই প্রক্রিয়া ব্যাপক এবং কঠিনও বটে। কোটি কোটি মানুষকে টিকা দেওয়া আমাদের কাছে এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু আটজনের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও একটা পুরোদস্তুর অস্ট্রেলীয় আক্রমণকে সামলানোর চ্যালেঞ্জও এর চেয়ে কম কিছু নয়। এর সঙ্গে যোগ করুন একদল দুর্বৃত্তের জাতিবিদ্বেষী খোঁচাখুঁচি। এতেই এই চ্যালেঞ্জের ঢক্কানিনাদ ১০০ গুণ হয়ে যায়।
সেজন্যই আমি বারবার বলার চেষ্টা করছি যে, এই সিরিজের সঙ্গে শুধুই ক্রিকেটীয় কৌশলের সম্পর্ক নেই। জীবন-বোধের পাঠও পাওয়া যায় এই সিরিজ থেকে। তাই এই সিরিজ আমাদের এই সময়ের নিরিখে এতটা প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। এটা এমন এক মানুষের গল্প, যিনি কোমরে চোট নিয়েও চার ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়ে থেকেছেন তাঁর দেশকে জেতানোর স্বার্থে। এমন এক মানুষের গল্প, যিনি গ্রেড-২ হ্যামস্ট্রিংয়ের চোটে কাহিল হয়েও নিজেকে বুঝিয়েছেন- না, হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। এই উসকে দেওয়া ফাস্ট বোলিংয়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। আসলে এটা এমন এক টিমের গল্প, যে টিমের খেলোয়াড়রা নাছোড়বান্দা, মরার আগে মরতে চান না। আমাদের ডাক্তার, নার্স, পুলিশ বা স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে কি এঁদের তুলনা চলে না? কোভিড কী, সে বিষয়ে তো তাঁদের কোনও ধারণাই ছিল না, তা-ও তাঁরা দৃঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন এই ঝড়ের মুখে। জীবন খোয়ালেন কতজন, কতজন হারালেন প্রিয়জনদের। তা-ও হার মানলেন না! সমাজ তো এঁদের নিয়েই তৈরি। খেলাধুলো এঁদের স্বীকৃতি দিতে শেখায়। এখন তাঁদের প্রত্যেকেরই টিকাকরণ চলছে, তাঁদের জয়ধ্বনি করছে সকলে। এর থেকেই প্রমাণ হয়, ভাল মানুষের জয় শেষমেশ হবেই, প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়তে লড়তেও তাঁরাই জিতবেন। আমাদের কাছে প্রমাণ হয়ে যায়, প্রচেষ্টা এবং সাহস এমনকী, ক্ষমতা এবং সামর্থ্যের থেকেও বড় অস্ত্র।
ভবিষ্যতে প্রতিবার যখন কোনও ভারতীয় দল অস্ট্রেলিয়ায় খেলতে যাবে, তাদের এই টিমটার কথা মনে পড়বেই। এ এমন এক দল, যারা হার মানতে চায়নি, হৃদয় জেতার জন্য সব বাধা অতিক্রম করেছে। অস্ট্রেলিয়া আর কোনও আতঙ্ক-উদ্রেককারী গন্তব্য হয়ে থাকবে না। বরং তা হয়ে উঠবে মহত্ত্ব অর্জনের মঞ্চ। ফাস্ট বোলাররা জীবন অতিষ্ঠ করে তুলছে– এসব এখন অতীত। বরং সেই বোলিংয়ের মুখোমুখি হওয়া, বীরগাথা রচনা করাই এখন চিত্রনাট্যের আসল আকর্ষণ। অস্ট্রেলিয়া শুধুই জাতিগতভাবে আক্রমণাত্মক সমর্থকদের ঠেক নয়। সেখানে এমন সমর্থকরাও আছেন, যাঁরা সত্যিকারের চ্যাম্পিয়নদের প্রশংসা করেন, দাঁড়িয়ে উঠে হাততালি দেন।
মোদ্দায়, এই অস্ট্রেলিয়া সফর ইতিহাসের প্রেক্ষাপট রচনা করল। ইংল্যান্ড সফর আসন্ন। ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের শেষতম জায়গাটাও বাকি। এই ভারতীয় টিম আমাদের পরবর্তী ১১ মাসে অনেক কিছু দেবে, এমনটা আশা করার সবরকম কারণ আছে। সবচেয়ে জরুরি যা, এই টিম আমাদের অনুপ্রাণিত করতেই থাকবে। আমাদের অতিমারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পারদ আরও চড়িয়ে দেবে। আর এখানেই খেলার আসল মূল্য– খেলাই জীবনের প্রকৃত রূপক।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.