জয়ন্ত ঘোষাল: জন স্টুয়ার্ট মিল একদা বলেছিলেন যে, আমরা রাষ্ট্র এবং সিস্টেমকে অনেক সময় খুব বেশি গুরুত্ব দিয়ে ফেলি। আসলে, ঘুরে-ফিরে কিন্তু ব্যক্তির ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। মার্কসবাদ আবার আমাদের শিখিয়েছিল যে, ব্যক্তির ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ যেমন সত্য, তেমনই ‘ব্যক্তি’ বিষয়টা সময়-পরিস্থিতি, বা প্রেক্ষাপট-ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন উল্লম্ব কোনও একটা ধারণা নয়। তাই বলশেভিক বিপ্লব লেনিন ছাড়া আমরা ভাবতেই পারি না। আবার একথাও বহু রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেছেন যে, লেনিন যদি সেদিন না জন্মাতেন, তাহলে তার বদলে ‘লেনিন ২’ বা ‘লেনিন ৩’- কারও না কারও নেতৃত্বে ওই পরিস্থিতি জন্ম নিতই।
তাত্ত্বিক আলোচনাকে নিয়ে আসি এবারের পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী কুরুক্ষেত্রে। গত
দু’-তিনমাস ধরে বিজেপির আক্রমণাত্মক নির্বাচনী প্রচার দেখতে দেখতে দেখতে এখন এই শেষ বেলায় একটা উপলব্ধি- মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে আক্রমণের মূল লক্ষ্য করে আসলে বিজেপি এবারের ভোটপর্বে তাঁকে একজন নেতা হিসাবেই সুপ্রতিষ্ঠিত করল। নেতা আকস্মিক জন্মায় না।
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। ’৮৭ সালে অভিষেকের জন্ম। সেই কোন যুগ থেকে ওঁকে দেখছি! দিল্লিতে থাকার দৌলতে অভিষেকের ছাত্রজীবনটাও আমি চোখের সামনে দেখেছি। ওঁর অন্যান্য তুতো ভাইবোনদের প্রত্যেককেই আমি প্রায় চিনি। যে কোনও পরিবারের মতো ওঁদের মধ্যেও নানাবিধ খুনসুটি আছে। আবার বিভিন্ন উৎসবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওঁদের একটা যৌথ পরিবারের চেহারা নিতেও বারবার দেখেছি। এহেন অভিষেক এখন আর সেদিনের ‘বাবু’ নন। দেশের প্রধানমন্ত্রী, দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, বিজেপি-র মতো একটা বড় দলের সর্বভারতীয় সভাপতি সবচেয়ে বেশিবার তাঁরই নাম করেন। তাই এবার একটা মস্ত বড় রাজনৈতিক ফেনোমেনন হল, নবকলেবরে নেতা হিসাবে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্থান।
দেখুন, ভোটের ফল নিয়ে আমি কখনওই আলোচনা করি না। ভোটের ফল যা-ই হোক না কেন, তৃণমূল জিতুক বা হারুক- মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর নবীন প্রজন্মের পরবর্তী নেতা হিসাবে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু সত্যি সত্যি দলের মধ্যে এবার আরও বেশি করে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছেন।
কর্পোরেট ব্র্যান্ড ম্যানেজমেন্ট ও বিজ্ঞাপন শিল্পেও বলা হয় যে, আপনি যদি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চান, তাহলে আপনার সবচেয়ে বেশি সুযোগ- যদি আপনি আক্রান্ত হন। ‘অনিডা’ টিভির বিজ্ঞাপনে একটা ভয়ংকর নেতিবাচক বার্তা ছিল- “Owner’s pride neighbour’s envy”। ওই ‘envy’ শব্দটাই কিন্তু মার্কেটিংয়ে একটা দীর্ঘ সময়ের জন্য সাফল্যের সবচেয়ে বড় মহামন্ত্র হয়ে উঠেছিল। যে-ছবিটি ছিল, তাতেও বড় বড় নখওয়ালা এক ব্যক্তিকে টিভির সঙ্গে দেখা যেত। সেটির মধে্যও খুব একটা দৃষ্টিনন্দন ব্যাপার ছিল না।
প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এসেই প্রকাশ্যে বলতে শুরু করছেন– অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তোলাবাজ ভাইপো’, ‘সিন্ডিকেট-সম্রাট’, ‘সিঙ্গল উইন্ডো’, ‘ভাতিজা সরকার’ ইত্যাদি ইত্যাদি। এই আক্রমণ অভিষেক বন্দে্যাপাধ্যায়ের রাজনৈতিক জীবনে আর্শীবাদ হয়েই এসেছে। আর এর মস্ত বড় একটা কারণ হচ্ছে- অভিষেক নিজে এই পরিস্থিতিটা খুব পরিণত নেতার মতো সামলাচ্ছেন।
সম্প্রতি অভিষেক একটি বাংলা চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। এখনও পর্যন্ত কোনও বাংলা চ্যানেলে এইভাবে মুখোমুখি তিনি প্রথম। এই সাক্ষাৎকারটিতে তিনি দশে এগারো পাবেন। সাক্ষাৎকারটিতে তিনি বিজেপির আক্রমণ শুধু প্রতিহত করেছেন, এমন নয়। তিনি প্রত্যেকটি প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট জবাব দিয়েছেন। আবেগতাড়িত হয়ে নয়, বুদ্ধি দিয়ে। অত্যন্ত বিশ্লেষণী পদ্ধতিতে। একবারও মাথা গরম করেননি। উত্তেজিত হননি। এমনকী, কপট উত্তেজনারও প্রদর্শন দেখা যায়নি।
দ্বিতীয়ত, খুব সৎ এবং আন্তরিকভাবে প্রতিটি প্রতিকূল, বিরূপ প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। কখনও বলেননি যে, আমি এই প্রশ্নের জবাব দেব না। আবার যেখানে কারও নাম তিনি উচ্চারণ করতে চান না, সেখানে নাম উচ্চারণ না-করেই জবাব দিয়েছেন। কিন্তু কখনওই কোনওভাবে তিনি সাক্ষাৎকার-প্রার্থীকে অপমান করেননি, রূঢ় বা অধৈর্য হয়ে ওঠেননি। বরং যে ধরনের পারসেপশন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে দীর্ঘদিন ধরে চলে এসেছে বা তৈরি হয়েছে, তা পালটে দিয়েছেন।
২০১১ সালে অভিষেকের বয়স ছিল ২৪। তখন তিনি রাজনীতিতে এসেছেন। এই দীর্ঘ সময় নিজেকে কীভাবে ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছেন, কীভাবে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে নিজেকে তৈরি করেছেন- তার প্রমাণ এই সাক্ষাৎকারে তিনি রাখতে পেরেছেন। শারীরিকভাবেও তিনি ছিপছিপে হয়েছেন। সে ব্যাপারে একটি প্রশ্নের জবাবে বলেছেন- ফিট থাকাটা রাজনীতিতে জরুরি। এক্ষেত্রেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দৃষ্টান্ত তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। সাধারণত আজকের দিনের রাজনৈতিক নেতারা, বিশেষত বিজেপি বা তৃণমূলের বহু নেতা যে ভাষায়, যে ভঙ্গিতে, যেভাবে কথা বলেন- অভিষেক কিন্তু সে-পথে যাননি। উলটে তাঁর সম্পর্কে তৈরি হওয়া পারসেপশনকে অনেকটাই ভ্রান্ত বলে প্রতিষ্ঠিত করার নজির তিনি রেখেছেন। যেমন, শিশির অধিকারী সম্পর্কে বারবার তিনি বলেছেন যে, উনি বয়সে প্রবীণ। অভিষেক অনেক কিছু তাঁর থেকেও শিখেছেন। সুতরাং, সাংসদ থেকেও বিজেপি-তে যাওয়া- সেটা শিশির অধিকারীর বিবেকবোধের পরিচয় না-ও হতে পারে। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে তিনি কোনওরকম আক্রমণ করবেন না।
শুভেন্দু অধিকারী সভা শুরুই করেছেন, ‘তোলাবাজ ভাইপো হঠাও’- এই ডাক দিয়ে। বারবার শুভেন্দু বলেছেন, এই ভাইপোর জন্যই নাকি তিনি দল ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। শুভেন্দু-অধ্যায়ের প্রতে্যকটি প্রশ্নের মাপা জবাব অভিষেক দিয়েছেন। বলেছেন- এতই যদি আমি খারাপ, তোলাবাজ এবং আমার জন্য শুভেন্দু যদি দল ছাড়তে বাধ্য হয়েই থাকেন, তাহলে দলে থেকে তিনি গর্জে উঠলেন না কেন? তিনি তো একজন বিশিষ্ট নেতা ছিলেন। দলের মধ্যে, দলের বৈঠকে, গোপনে, প্রকাশ্যে- কোথাও তোলাবাজির প্রমাণ তিনি দিলেন না কেন? আসলে এখন বিজেপি ওঁকে যা বলতে বলছেন, উনি তাই বলছেন। আর যদি অবজ্ঞার শিকার হন এবং আমার জন্য দল ছাড়তে বাধ্য হন, আমি ওঁকে হিংসা করেছি- একথা যদি সত্যি হয়- তাহলে আমি ওঁর সঙ্গে শেষবেলাতেও বৈঠকে বসব কেন বা বসতে যাব কেন? আমি তো বসতে না-ও রাজি হতে পারতাম। উলটে অভিষেক প্রশ্ন তুলেছেন, কোন কথাটা শুভেন্দু অধিকারীর সত্য? একবার তিনি বলছেন যে, তাঁর হাতে-পায়ে ধরা হয়েছে, আবার তিনি বলছেন, তাঁকে অবজ্ঞা করা হয়েছে। আগে উনি ঠিক করুন, যে, কোন কথাটা তিনি বলতে চাইছেন।
সাক্ষাৎকারে অভিযোগ ওঠে যে, অভিষেক এবং প্রশান্ত কিশোর প্রবীণদের মর্যাদা দিচ্ছেন না। সঙ্গে সোনালী গুহ-র সাতগাছিয়াতে নমিনেশন না পাওয়ার বিষয়টিও উত্থাপন করেন প্রশ্নকর্তা। সঙ্গে সঙ্গে অভিষেক বলেন যে, সাতগাছিয়াতে মনোনয়ন না-পাওয়ার জন্য সোনালী গুহ বিজেপি-তে চলে গিয়েছেন, মনোনয়ন পেলে যেতেন না। কিন্তু মনোনয়ন কাকে দেওয়া হবে– তা স্থির করার জন্য দলের একটা নিজস্ব পদ্ধতি আছে। সোনালী গুহর বদলে কাকে দেওয়া হয়েছে মনোনয়ন? মোহন নস্কর, যিনি ১৫ বছর ধরে পঞ্চায়েত-স্তরে ওখানে কাজ করেছেন। ওঁর থেকে যোগ্য প্রার্থী সাতগাছিয়ায় আর কে হতে পারে? ওখানে তো কোনও ভুঁইফোড় বা নবীন নেতাকে আচমকা প্রার্থী করে দেওয়া হয়নি!
এইভাবে একের পর এক প্রশ্নের শুধু জবাব দেওয়া নয়, তিনি রীতিমতো একটা প্রেক্ষাপট তৈরি করেন। তিনি বলেছেন যে, আমি তো কারও ভাইপো হতেই পারি। একজন ব্যক্তি যদি কারও বাবা হয়, কারও ছেলে হয়, কারও স্বামী হয়, তাঁর যদি একটা পারিবারিক সত্তা থাকে- তাতে সমস্যাটা কোথায়? কিন্তু ভাববাচ্যে কথা বলা হচ্ছে কেন? আমি বারবার বলছি, কেন প্রকাশ্যে, নাম করে আমার সম্পর্কে সমস্ত অভিযোগ এবং প্রমাণ দেওয়া হচ্ছে না? কয়লা, বালি, গরু পাচার এই সমস্ত দুর্নীতির টাকা নাকি ‘শান্তিনিকেতন’-এ, অর্থাৎ অভিষেকের বাড়িতে যায়- সেই প্রশ্নটি পর্যন্ত সাংবাদিক করেছেন। সেক্ষেত্রে অভিষেক বলেছেন যে, কয়লার যে অবৈধ খনন, সেটা ‘কোল ইন্ডিয়া’-র অধীনে। সেখানে নিরাপত্তা দেখভাল করে ‘ন্যাশনাল অ্যাসেটস’-এর সিআইএসএফ এবং এই সিআইএসএফের মন্ত্রী অমিত শাহ নিজে। গরুপাচারের নিরাপত্তার দায়িত্ব বিএসএফের। এই বিএসএফের মন্ত্রী অমিত শাহ নিজে। তাহলে যদি এই সমস্ত দুর্নীতি এত বছর ধরে হয়েই থাকে, এবং যদি তারা ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়- তাহলে তো সর্বপ্রথম ইস্তফা দেওয়া উচিত অমিত শাহর। অভিষেক চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন, একের পর এক গল্পগাছা এইভাবে উত্থাপন না করে, যাতে সমস্ত তথ্যের উচিত প্রমাণ দেওয়া হয়।
অভিষেক বারবার বলার চেষ্টা করেছেন, বাঙালি এবং পশ্চিমবঙ্গবাসীর কাছে তাঁর সমর্থনের জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভোট প্রার্থনা করছেন। কিন্তু আলাদা করে সংখ্যালঘু, আলাদা করে মতুয়া, আলাদা করে তফশিলি জাতি- এরকম করে স্বতন্ত্র সেগমেন্টে ভোট পাওয়ার চেষ্টা আমরা করি না। অভিষেক এ-ও বলছেন, হাথরস এবং উন্নাও-তে ভয়ংকর ‘দলিতবিরোধী’ এবং ‘নৃশংস’ কাণ্ড ঘটিয়ে, এখানে এসে দলিত পরিবারে মধ্যাহ্নভোজন সারার যে রাজনৈতিক কর্মসূচি বিজেপি নিয়েছে- তাকে এককথায় ‘জুমলা’ ছাড়া আর অন্যকিছুই বলা যেতে পারে না।
অভিষেকের এই সাক্ষাৎকারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে-বক্তব্য: তিনি ভোটে জিতলেও কোনওভাবে উপ-মুখ্যমন্ত্রী হবেন না, বা মন্ত্রিসভায় আসবেন না। দলকে মজবুত করার কাজে তিনি জেলায়-জেলায় আরও কাজ করবেন। যেখানে দল কাজ করতে বলবে, সেখানেই তিনি চলে যাবেন। উপ-মুখ্যমন্ত্রীর প্রসঙ্গ উঠতেই অভিষেক বলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একাই একশো। ওঁর কোনও উপ-মুখ্যমন্ত্রীর দরকার নেই। আর তাঁরও ওই পদ পাওয়ার কোনওরকম ইচ্ছা নেই। ভোটের ফলাফল বেরনোর আগেই প্রকাশে্য একথা বলা রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।
নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের ব্যাপারে অভিষেকের হোমওয়ার্ক যে খুব ভাল- সেটা বোঝা গেল। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, আপনি কী তাহলে সিএএ-র বিরোধিতা করছেন? উত্তরে অভিষেক বললেন যে, সিএএ-র একটা ইতিবাচক দিক রয়েছে, যেখানে নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু সিএএ-র চেয়েও ভয়ংকর এনআরসি। এনআরসি বাস্তবে প্রয়োগ করার পরিণতি পশ্চিমবঙ্গে ভয়ংকর হতে পারে। অভিষেক এ-ও বলেন, এনআরসি করা হবে কি হবে না, সে বিষয়েও নানা সময় নানারকমের মন্তব্য করে অমিত শাহ জট পাকাচ্ছেন। অভিষেকের কথায়, এই সমস্ত অবৈধ বসবাসকারী মানুষের ভোট নিয়েই তো তাঁরা দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছেন। তাহলে এখন সাউথ ব্লকে বসে তাঁরা রাজত্ব করছেন কোন যুক্তিতে?
পরিবর্তন একমাত্র জিনিস, যেটা কনস্ট্যান্ট। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন ভয়ংকর আন্দোলন করছিলেন, তখন অভিষেক ছেলেমানুষ ছিলেন। ’৯১ সালের ২১ জুলাইয়ের ঘটনা যখন ঘটে, তখন তাঁর বয়স চার বছর। সেই সময় তিনি দেখেছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কখনও লাঠিপেটা খাচ্ছেন, কখনও তাঁর মাথায় আঘাত লাগছে, কখনও তাঁর পা ভেঙে যাচ্ছে, কখনও নানারকমভাবে আক্রমণ হচ্ছে। তখন বয়স অল্প হলেও বাড়িতে এই আবহটা তাঁর মনের মধ্যে যে প্রভাব ফেলবে- এটা কোনও অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। অভিষেকের অন্য ভাইবোনরা রাজনীতিতে আসেননি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হয়তো মনে হয়েছিল, অভিষেকই পারবেন এই রাজনীতির প্রাঙ্গণে যোগ্যতার প্রমাণ দিতে।
অভিষেক যখন রাজনীতিটা শুরু করেছেন, তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী। এখন দীর্ঘ দশ বছর ধরে শাসক দল হিসাবে তৃণমূল কাজ করছে। কিন্তু রাজনীতির হালচাল অনেক বদলে গিয়েছে। অতীতে যেভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজনীতি করেছেন, সেভাবে আজ করছেন না। পৃথিবীজুড়ে মানুষ পোস্ট-ট্রুথ এবং মিডিয়াটাইজড গণতন্ত্রের মধ্যে বসবাস করছে। সেখানে স্বতঃস্ফূর্ততার বদলে অনেক বেশি ঘটনা ঘটানো হয় ম্যানুফ্যাকচারড পাবলিক ওপিনিয়নের উপর নির্ভর করে। তার জন্য সোশ্যাল মিডিয়া মস্ত বড় ভূমিকা নিচ্ছে। এই নতুন আঙ্গিকে রাহুল গান্ধী পর্যন্ত সম্পূর্ণ অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেননি। অভিষেক যে এই নতুন আঙ্গিকের রাজনীতিতে যোগ্য- এই সাক্ষাৎকারে তিনি তার প্রমাণ রেখেছেন।
প্রশান্ত কিশোরকে নিয়ে আসা প্রসঙ্গে বিতর্কের কথা যখন তোলা হয়, তখন তিনি পালটা বলেছেন, প্রশান্ত কিশোর একজন পেশাদার হিসাবে কাজ করেন। তিনি তো রাজনীতির সঙ্গে কোনওভাবে যুক্ত নন। প্রশান্ত কিশোরকে ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি কেন কাজে লাগিয়েছিলেন তাহলে? সেটা আপনারা কেন নরেন্দ্র মোদিকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেননি! এটা তো সত্য যে, প্রশান্ত কিশোর বিভিন্ন দলের হয়ে কাজ করেন। সুতরাং, তাঁর একটা গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু লিমিটেড রোল আছে। অনেক তথ্য পৌঁছে দেওয়া, নানাভাবে দলকে সাহায্য করা প্রশান্ত কিশোরের কাজ। কিন্তু সরাসরি রাজনৈতিক কার্যকলাপের জন্য দলের নীতি-নির্ধারক সমিতি আছে। তারা-ই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভবিষ্যৎ রাজনীতি কোন পথে এগবে, তা ভবিষ্যৎই বলবে। আপাতত বলা যায় যে, এই ভয়ংকর আক্রমণের মধ্যেও অভিষেক কিন্তু নিজেকে তৃণমূলের ‘দ্বিতীয় নেতা’ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। উল্টে অনেকে চলে যাওয়ার পর এখন যাঁরা তৃণমূল কংগ্রেসে আছেন, তাঁদের কাছে সর্বসম্মতভাবে অভিষেকই দ্বিতীয় ব্যক্তিত্ব। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ই দ্বিতীয় নেতা, যাঁর জনসভায় এবারে ভোট প্রচারের সময় সবচেয়ে বেশি ভিড় দেখা গিয়েছে। প্রতিটি জনসভায় তাঁর বক্তৃতা, কথা বলা অত্যন্ত সচেতন। এমনকী, কোনও বিষয় নিয়ে যদি ভুল বোঝাবুঝি হয়েও থাকে- সাক্ষাৎকারে তাঁর ব্যাখ্যা তিনি দিয়েছেন। বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, কখনওই তিনি কাউকে আঘাত করে, অপমান করে কথা বলতে চান না। বরং সেই সংস্কৃতি অমিত শাহ-র আছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পা ভেঙে যাওয়ার পরও তাঁরা একবারও খোঁজ নেননি। কিন্তু অমিত শাহ-র যখন করোনা হয়েছিল, তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খোঁজ নিয়েছিলেন, টুইট করেছিলেন। সুতরাং এই সৌজন্যের রাজনীতির উত্তরাধিকারী হিসাবেই তিনি এগতে চান। তিনি বলেছেন- আমাকে এদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উঠতে-বসতে এত আক্রমণ করছেন, আমি মনে করি, এটা আমার কাছে অভিশাপ নয়, আর্শীবাদ। আমাকে কেউ জিজ্ঞাসা করছিলেন, আপনার ডায়েট কী? আমি বললাম যে, এই যে কয়েক কিলো মোদির গালাগাল, আর কয়েক কিলো অমিত শাহ-র গালাগাল, মাঝে মাঝে অন্য রাজনেতাদেরও। এতেই তো আমার যথেষ্ট ভাল পেট ভরে যায়! রসিকতার ছলে বললেও উনি কিন্তু একটা জিনিস বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, এই প্রবল আক্রমণের মধ্যেও তিনি ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে রাজনীতির ময়দান ছেড়ে পালাবেন না। উলটে তিনি পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুড়েছেন বিজেপির দিকে। তাই অভিষেকের জীবনে বিজেপির আক্রমণ শাপে বর।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.