বাঙালি জীবনে রামচন্দ্রর ভূমিকা যে ছিল না, তা নয়। বিজেপি বাংলায় যে-পথে রামনবমী আর রামপুজো করছে তা রাজনৈতিক বুমেরাং হতে পারে। রামনবমীর দিন হিন্দি বলয়ের প্রথা ও রাজনীতি অনুকরণ করে বিজেপি এ-রাজ্যে যে-সংস্কৃতি চাপিয়ে দিতে চাইছে, তা বাঙালি এখনও গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল
হাওড়ার শিবপুর বিই কলেজের গায়েই ‘বার্জার পেন্টস’-এর কারখানা। তার পাশে এক বিস্তৃত বস্তি। হিন্দু-মুসলমান মিলেমিশেই থাকে সেখানে। আমাদের আবাসন থেকে রোজ সকালে হাঁটতে হাঁটতে গঙ্গার ধার দিয়ে এই বস্তির পাশে এক ছোট্ট চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে আমি চা খাই, আর শুনি স্থানীয় মানুষের কথোপকথন।
চা-ওয়ালি শোভাদেবী বিহারের ছাপড়ার মানুষ। তবে জন্ম-বড় হওয়া মধ্য হাওড়ার সন্ধ্যাবাজার এলাকায়। ওরা ব্রাহ্মণ, পাণ্ডে। বৃদ্ধ স্বামী সকালে নিমডাল দিয়ে দাঁত মাজে, গামছাকে হাফ-লুঙ্গির মতো করে পাকিয়ে পরে। শোভাদেবীর একাধিক মেয়ে, আর সবেধন নীলমণি ২২-২৩ বছরের একটি ছেলে। রোগাসোগা। গায়ের রং তামাটে। লাল রঙের স্যান্ডো গেঞ্জি পরে। অনেকটা ‘মৃগয়া’-র মিঠুন চক্রবর্তীর মতো। রুক্ষ মুখে অনেক ব্রণ। শোভাদেবীকে ছেলে বললে, ‘মা আজ আমি ইডেনে খেলা দেখতে যাচ্ছি। ফিরতে রাত হবে।’ বাবা সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘আজ কোনও খেলা নেই ইডেনে। ঝুট মত্ বোলো। মুঝে সব পাতা হ্যায়। তুম রামনবমী কি জুলুস মে যাওগে।’ ছেলেটা বাপের মতোই ট্রাক-লরি চালায়। পুরনো একটা মোটরসাইকেল চালিয়ে ছেলেটা হুস করে চলে গেল।
সেদিন ছিল রামনবমী। পরে জানলাম, ‘বিশ্ব হিন্দু পরিষদ’ নানা প্রান্ত থেকে রামনবমীর মিছিল, প্রসেশন বের করছে। বিই কলেজ থেকে কাজিপাড়া-মোল্লাপাড়া- সেখান থেকে মল্লিকফটক হয়ে হাওড়া ময়দান। উত্তর হাওড়াতেও একইরকম আয়োজন। আর, রাতে বাড়ি ফিরতেই শুনলাম, রামনবমীর মিছিলকে কেন্দ্র করে বহু জায়গায় গোষ্ঠী সংঘর্ষ, কারফিউ, বোমাবাজি, এমনকী, গুলি পর্যন্ত চলেছে। না, মানুষ মরেনি। কিন্তু ব্যাপারটা কী?পরদিন শোভাদেবীর চায়ের আড্ডায় আবার। “ওরা ছেলেকে টাকা দিয়েছিল। দু’বেলার খাবারও পেয়েছিল। খুব ভয়ে ভয়ে ছিলাম, যদি কিছু হয়ে যায়! তা, ও বলল, ‘আজ তো ছুটির দিন, একটু রোজগার হবে, মা।”
বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কী সংগঠন আছে হাওড়ায়? বিজেপি-আরএসএস আসলে নেপথ্যে আছে। হাওড়ার এক হিন্দিভাষী রাজ্যনেতা দায়িত্বে ছিলেন। আইডিয়াটা জলের মতো পরিষ্কার। হাওড়ায় হিন্দিভাষী মানুষ প্রচুর। গরিব শ্রমিক, অসংগঠিত কর্মী যেমন আছে, আবার আপাত-কম বড়লোক ও উচ্চবিত্ত মাড়োয়ারি-বিহারিও কম নেই- যারা সে-অর্থে ‘আলিপুর ক্লাস’ নয়, কিন্তু বড়বাজারের মতো এক্সটেন্ডেড জনসমাজ।
অন্যদিকে রামরাজাতলা। রামতলায় এক রবিবার রাম-সীতা, লক্ষ্মণ বিরাজমান হলেন। স্থির হয়- চারমাস খোলা থাকবে দর্শনের জন্য, তারপর কোনও এক রবিবার ভাসান হবে। আনুমানিক প্রায় ৩০০ বছর আগে সম্ভ্রান্ত সান্যাল পরিবার ছিল স্থানীয় জমিদার। ‘চৌধুরী’ উপাধি পায় তারা। এই পরিবারের বংশধর অযোধ্যা রাম চৌধুরী স্বপ্নাদেশ পান রামের মূর্তি স্থাপনার। তখন থেকেই পুজো হয়ে আসছে রামচন্দ্রর। সবচেয়ে মজার ব্যাপার, এই রামঠাকুরের ছিল মস্ত বড় গোঁফ। রামের নামেই এলাকার নাম ‘রামরাজাতলা’। ‘রামরাজা’ শব্দটির মধ্যেও আছে বাঙালি-ব্যঞ্জনা। রামরাজার গোঁফ থাকার মধ্যেও বাঙালিপনা ছিল, যেমনটা আমরা শিবঠাকুরের ভুঁড়ি তৈরি করে মানবায়ন করেছি।
তবে অনেকে বলেন, রামের গোঁফ বহু জায়গায় ছিল কারণ সেটি ক্ষত্রিয় রূপ। হাওড়ায় রামঠাকুর থাকতেন চারমাস- বৈশাখ থেকে শ্রাবণ। কিন্তু কী করে রামঠাকুরের গোঁফ অবলুপ্ত হল? আর কী করেই-বা বন্ধ হয়ে যাওয়া মন্দিরের পাশে সারা বছর পুজো পাওয়ার জন্য অযোধ্যার রাম-সীতা-লক্ষ্মণের পরিচিতিতে আধুনিক মন্দির স্থাপিত হল? তা নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে। চৌধুরী পরিবারের প্রতিষ্ঠিত রামতলার বৈশিষ্ট্য ছিল লোকায়ত মেলা, চারমাস ধরে তা চলত। দারুণ লাগত সুউচ্চ সেই রামঠাকুরের মূর্তির চরণে অর্ঘ্য দিতে।
যা হোক, ফিরে আসি রামনবমী নিয়ে রাজনীতির কাহিনিতে। বাঙালির মিছিল আর হিন্দিভাষীদের মিছিল বেরল। হাওড়া জুটমিল এলাকায়, ফজির বাজার এলাকায়, মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মিছিল। তার মধে্য মোটরবাইক বাহিনী। আরোহীদের হাতে তরবারি-ত্রিশূল আর লম্বা হলুদ-গেরুয়া পতাকা লাগানো লাঠি। সঙ্গে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান। অন্যপক্ষ থেকে পাথরবৃষ্টি শুরু। শেষ পর্যন্ত রাজনীতির লড়াই। পুলিশ কারফিউ জারি করল। প্রশ্ন, রামনবমীর আগেই বিশ্ব হিন্দু পরিষদের এসব এলাকায় মিছিল করতে পুলিশ আগাম নিষেধাজ্ঞা জারি করল না কেন?
হাওড়া পুরনির্বাচন আসন্ন। সেটা করলে কি তৃণমূলের বিরুদ্ধে ‘হিন্দু-বিরোধী’ তকমা লাগিয়ে বিজেপি মুসলমান তোষণের অভিযোগ তোলার সুযোগ পেত? রামতলায় বসবাসকারী আমার এক পরিচিত বন্ধু বলছিলেন, স্কুটারে যারা ‘জয় শ্রীরাম’ বলে চিৎকার করে দাপাদাপি করছিল, তারা বাঙালি সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা হল, সে ‘জুলুস’-এ অনেক যুবকই ছিল ‘ড্রাঙ্ক’। এখন বিজেপিও এই রাজ্যে শিখে ফেলেছে দুঃসাধ্য জিনিসকে পাওয়ার সুখসাধ্য পথ! এবং তাই মনে হচ্ছে, বিজেপি বাংলায় যে-পথে রামনবমী আর রামপুজো করছে তা রাজনৈতিক বুমেরাং হতে পারে।
শ্রীরামকৃষ্ণর কুলদেবতা ছিলেন রঘুবীর। তাঁর পিতা ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় জমিদারের অত্যাচারে সব হারিয়ে শুধু রঘুবীর বিগ্রহ নিয়ে নিঃস্ব অবস্থায় চলে আসেন কামারপুকুরে। স্বপ্নে ক্ষুদিরাম আদেশ পেয়ে খেত থেকে রঘুবীর-শিলা এনে বাড়িতে পুজো শুরু করেন। গয়াতে তিনি স্বপ্নে দেখেন যে, ভগবান এবার পুত্ররূপে তাঁর ঘরে জন্ম নেবেন।
শৈশব থেকে শ্রীরামকৃষ্ণও অত্যন্ত শ্রদ্ধা-ভক্তির সঙ্গে রঘুবীরের পুজো করেন। ১৮৬৪-’৬৫ সালের কোনও একটা সময় ‘জটাধারী’ নামে এক পরম রামভক্ত বৈষ্ণব দক্ষিণেশ্বরে আসেন। ঠাকুরকে উনি শ্রীরামচন্দ্রর অষ্টধাতু নির্মিত এক বালমূর্তি দেন। ঠাকুর তাঁকে ভোগ দিতেন। পুজো করতেন। চলে যাওয়ার সময় ঠাকুরের কাছেই তিনি রামলালাকে রেখে যান।
কথামৃতে ঠাকুর বলেছেন, আমি সীতামূর্তি দর্শন করেছিলাম। দেখলাম, সব মনটা রামেতেই রয়েছে। যেন জীবনটা রামময়। রাম না থাকলে, রামকে না পেলে প্রাণে বাঁচবে না। আমি ‘রাম রাম’ করে পাগল হয়েছিলাম। ঠাকুর নরেন্দ্রকেও রামমন্ত্রে দীক্ষিত করেন। সেই মন্ত্র পেয়ে নরেন্দ্র উন্মাদের মতো সন্ধ্যা থেকে ‘রাম রাম’ বলতে বলতে ঘুরতে থাকেন। কিছু পরে নরেন্দ্র প্রকৃতিস্থ হন। (‘যুগনায়ক বিবেকানন্দ’, প্রথম ভাগ) এসব ঘটনা থেকে বোঝা যায়, বাঙালি জীবনে রামচন্দ্রর ভূমিকা যে ছিল না, তা নয়। কিন্তু রামনবমীর দিন হিন্দি বলয়ের প্রথা ও রাজনীতি অনুকরণ করে বিজেপি এ-রাজ্যে যে-সংস্কৃতি চাপিয়ে দিতে চাইছে তা বাঙালি গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়। রাম ও রামায়ণ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ কী বলছেন? তাঁর ভাষায়, ভারত যা চায় রামায়ণে তা পাওয়া যায়। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের রামনবমীর জুলুসে বাঙালির সেই ভারত-চেতনা পেলাম কই?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.