Advertisement
Advertisement

Breaking News

BJP

ভোট বড় বালাই, খ্রিস্টানদের মন পেতে দ্বিচারিতা বিজেপির

দৃষ্টান্ত: মেঘালয়ে আসন্ন নির্বাচন, এবং বিজেপির ঘুঁটি সাজানোর বিবিধ প্রয়াস।

BJP wants to secure Christian votes | Sangbad Pratidin

ছবি: প্রতীকী

Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:February 24, 2023 6:01 pm
  • Updated:February 24, 2023 6:01 pm  

বিজেপি ভারতীয় খ্রিস্টধর্মীদের মন জয় করতে ও ভোট পেতে লিপ্সু। দৃষ্টান্ত: মেঘালয়ে আসন্ন নির্বাচন, এবং বিজেপির ঘুঁটি সাজানোর বিবিধ প্রয়াস। কিন্তু কাজটি তত সহজ নয়। ভুললে চলবে না, সমাজকর্মী ফাদার স্ট‌্যান স্বামীকে যখন গ্রেপ্তার করা হল এবং শেষ পর্যন্ত তিনি যথার্থ চিকিৎসার অভাবে মারা গেলেন, সেই সময়েও দেশের বিভিন্ন খ্রিস্টান সমিতি থেকে ক্ষোভের বিস্ফার ঘটেছিল। বিশ্লেষণে রাজদীপ সরদেশাই

দেশের সুদূর এক প্রান্তে, বিজেপি নবকলেবরে, তাদের পুরনো বাধা অতিক্রম করার চেষ্টা করছে। গত রবিবার, মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী শিলংয়ের অন‌্যতম প্রাচীন একটি চার্চের জমায়েতে বিশেষ অতিথি ছিলেন কেন্দ্রের সংখ‌্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রকের মন্ত্রী জন বার্লা। শিলং, তথা মেঘালয় ভারতের অন‌্যতম রাজ‌্য, যেখানে খ্রিস্টানদের সংখ‌্যা বেশি। আর সামনেই সেখানে নির্বাচন। ফলে, এমন এক জমায়েতে জন বার্লার উপস্থিতির মধ‌্য দিয়ে বিজেপি এটাই বোঝাতে চেষ্টা করছে যে, তারা ‘খ্রিস্টান-বিরোধী’ নয়। মেঘালয় এবং নাগাল‌্যান্ড জুড়ে বিজেপি তাদের ৮০ জন প্রার্থীর মধ্যে ৭৫ জনকে মনোনীত করেছে, যাঁরা খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের। এই ধর্ম নিয়ে সংঘ পরিবারের ঐতিহ‌্যগত অস্বস্তি রয়েছে, আর বিজেপি এহেন মনোনয়নের মাধ‌্যমে সেই অস্বস্তিটাই নাকি কাটাতে চাইছে! হয়তো-বা বোঝাতে চাইছে পরধর্মের প্রতি তারা কতটা সহিষ্ণু।

Advertisement

এমন বক্তব্যে বিজেপির কেউ হয়তো ঝাঁজিয়ে বলে উঠতে পারেন, কই, গোয়াও তো আর-এক খ্রিস্টান অধ্যুষিত রাজ‌্য এবং সেখানে তো আমরা প্রায় ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায়! এমনকী, মেঘালয় এবং নাগাল‌্যান্ডেও, বিজেপির সঙ্গে জোট সরকার ক্ষমতার আসনে রয়েছে গত ৫ বছর ধরে। মেঘালয় এবং নাগাল‌্যান্ডের স্থানীয় দলগুলির সঙ্গে বিজেপির গাঁটছড়া তো আছেই, তার উপর দু’রাজ্যেই খ্রিস্টান মুখ‌্যমন্ত্রী। ফলে, রাজনৈতিক ঐক্যের বার্তা আরও জোরালো। কিন্তু মশাই, ভোট-পরবর্তী সুযোগসন্ধানী চুক্তির মধ‌্য দিয়ে ক্ষমতার অংশীদারিত্ব আর হিন্দুত্বের রাজনীতির মধ্যে একটি সংখ‌্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষদের মন জয় করা যে এক জিনিস নয়!

গত মাসে, ছত্তিশগড়ে, যখন উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা চার্চ ভেঙে ফেলল, সেই সময় মেঘালয়ের খ্রিস্টান সমিতিগুলো লাল ঝান্ডা তুলে প্রতিবাদ তো জানিয়েছিলই, একইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে তাঁর নীরবতা ভঙ্গ করে এই দুষ্কর্মের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার দাবি জানিয়েছিল। বলেছিল, দেশ জুড়ে খ্রিস্টান সম্প্রদায়গুলোর উপর ক্রমশ আক্রমণ বাড়ছে। ‘ইউএপিএ’-র আওতায় অশীতিপর যাজক এবং সমাজকর্মী ফাদার স্ট‌্যান স্বামীকে যখন গ্রেপ্তার করা হল এবং শেষ পর্যন্ত তিনি যথার্থ চিকিৎসার অভাবে মারা গেলেন, সেই সময়েও দেশের বিভিন্ন খ্রিস্টান সমিতি থেকে ক্ষোভের বিস্ফার ঘটেছিল। কর্ণাটক বিধানসভায় যখন ধর্মান্তকরণ বিরোধী বিল পাস করা হল, সেসময়ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের নেতারা প্রতিবাদ করেছিলেন। বলা বাহুল‌্য, এই বিল পাসের মধ‌্য দিয়ে বিজেপি-শাসিত রাজ‌্যগুলিতে আদিবাসী এলাকায় খ্রিস্টান মিশনারির সক্রিয়তায় ইতি টানাই লক্ষ‌্য। এছাড়াও রয়েছে গোমাংস ‘নিষিদ্ধকরণ’-এর জিগির। এসব মিলিয়ে দেখলে, গেরুয়া ভ্রাতৃত্বের রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে বিজেপির তথাকথিত অনুন্নত অনগ্রসর এলাকায় পৌঁছে যাওয়ার উচ্চাশা কোনওভাবেই মেলে না, বলা ভাল সম্পূর্ণ বিপরীতে অবস্থান।

ফলে, বুঝতে দ্বিধা নেই, তাদের রাজনীতির ভাবধারা-ই হল তীব্র দ্বিচারিতার অভ‌্যাস ও চর্চা। একদিকে, গো-বলয় রাজ‌্যগুলিতে কট্টর হিন্দুত্বের তরজা। আর অন‌্যদিকে দেশের প্রান্তীয় এলাকাগুলো, যেখানে জনমানসের জীবনযাপন একরোখা ধর্মীয় চিন্তাভিত্তিক নয় কিংবা সেখানে খাদ‌্যাভ‌্যাসেও বিভিন্নতা রয়েছে, সেই জীবনচর্যার সঙ্গে মিলিঝুলি করে সেখানকার রাজনীতিতে ঢুকে পড়ার অভিপ্রায়ও কিছু কম নয় বিজেপির। ‘মিম’-এর সাংসদ আসাউদ্দিন ওয়াইসি যেমন বিজেপির এহেন ভণ্ডামির চোরাস্রোতটি খুব ভাল ধরেছেন তাঁর একটি কথায়- Beef is mummy for the BJP in UP but yummy in Goa and the north east. অর্থাৎ, উত্তরপ্রদেশ বা গোবলয় রাজ‌্যগুলিতে গরু বিজেপির পূজ‌্য, অথচ গোয়া বা উত্তর-পূর্ব তা ভোজ‌্য হয়ে ওঠা নিয়ে বিজেপির কোনও রোখ বা অসূয়া নেই। তবে, মানতে হবে- এই দ্বিচারিতার বাস্তবে প্রায়োগিক ক্ষেত্র রয়েছে। দেশের এমন বৈচিত্রময় সমাজে যেখানে খাদ‌্যাভ‌্যাসেও বৈচিত্র বিপুল, সেই পরিস্থিতির সঙ্গে সমঝে চলা একটা ব‌্যাপার বইকি। বিজেপির অতীত সংস্করণ যেমন এই বিষয়গুলোয়, মূলত তাদের নীতি-আদর্শে একরোখা ছিল, সেখানে ‘নব‌্য’ বিজেপি রাজনৈতিক ফায়দার খাতিরে সেই একরোখামি ঝেড়ে ফেলতে দ্বিতীয়বার ভাবে না।

আরএসএস-এর দীর্ঘকালীন সরসংঘচালক এম. এস. গোলওয়ালকর তাঁর প্রভাবশালী গ্রন্থ ‘বাঞ্চ অফ থট্‌স’-এ মুসলিম, খ্রিস্টান এবং কমিউনিস্টদের দেশের তিন প্রধান অভ‌্যন্তরীণ শত্রু বলে দাগিয়েছিলেন রীতিমতো। খ্রিস্টানদের সম্পর্কে গোলওয়ালকর এই বইয়ে লিখেছিলেন- এই দেশে খ্রিস্টানদের বর্তমান অবস্থানটাই এমন যে, দেশে আমাদের জীবনের ধর্মীয় ও সামাজিক রূপটি ধ্বংসায়িত করা ছাড়া এদের কোনও কাজ তো নেই বটেই, একইসঙ্গে এদের উদ্দেশ‌্য দেশে কোনায় কোনায় রাজনৈতিক পুরোধা হয়ে ওঠা, সম্ভব হলে পুরো দেশটাকেই গিলে নেওয়া। ‘নব‌্য’ বিজেপি যদিও গোলওয়ালকরের এই দৃষ্টিভঙ্গি জনসমক্ষে আনে না, বলা ভাল, চেপেই রাখে। আবার একইসঙ্গে, সংঘ পরিবারের নেতাদের বাড়িতে দেখা যাবে, গোলওয়ালকরের ছবিও টাঙানো! ফলে, বুঝতে অসুবিধা নেই, খ্রিস্টানদের কাছে পৌঁছনোর এই ভঙ্গিমা যথেষ্ট অঙ্ক কষে, ছক সাজিয়ে করা।

প্রথমত, বিজেপি খুব সুচারুভাবে মুসলিম ও খ্রিস্টানদের মধ্যে বৈশিষ্ট‌্যগত ফারাক তৈরি করতে চাইছে, তা সে যতই দেশের ‘সংখ‌্যালঘু’ হিসাবে তারা পরিচিত হোক। দেশে মুসলিমদের সংখ‌্যা খ্রিস্টানদের তুলনায় যথেষ্ট পরিমাণে বেশি, এবং মুসলিম কট্টরপন্থার ক্রমোর্ধ্ব উত্থানে দেশের মুসলিম নাগরিকদের ‘শত্রু’ ঠাওরানো সহজ এবং এর মধ‌্য দিয়ে হিন্দুত্ববাদী সংবিধান গড়ে তোলাও মজবুত উপায়। তুলনায়, খ্রিস্টানদের সংখ‌্যা কম। ২০১১-র আদমশুমার বলছে, দেশে মোটে ২ কোটি ৮০ লক্ষ খ্রিস্টান। অর্থাৎ, মোট জনসংখ‌্যার মাত্র ২.৩ শতাংশ। ফলে, আপেক্ষিকভাবে রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে তারা অপ্রাসঙ্গিক এবং সংখ‌্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে তেমন চাপের নয়।

দ্বিতীয়ত, খ্রিস্টান গোষ্ঠীগুলি মুসলিম গোষ্ঠীগুলির তুলনায় বিজেপি নেতৃত্বের সঙ্গে সংলাপে যেতে তুলনামূলকভাবে উদার। ভুললে চলবে না, মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে প্রধানমন্ত্রী মোদি এখনও চক্ষুশূল। ২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গা তারা যেমন ভুলতে পারেনি, তেমনই মোদি এখনও এই সম্প্রদায়ের কাছে অতীত দিয়েই সংজ্ঞায়িত হন।

উল্লেখযোগ্যভাবে, ২০২২ সালের গুজরাট বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি একজন খ্রিস্টান উপজাতির নেতাকে নির্বাচনের টিকিট দিয়েছিল, যিনি জিতেছিলেন কঠিন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে। এর তীব্র বিপরীতে, বিজেপি অটলভাবে ঠিক করেই নিয়েছে, গুজরাটে কোনও মুসলিম প্রার্থী দাঁড় করাবে না। যেন এই সম্প্রদায়টি তাদের কাছে রাজনৈতিকভাবে ‘অস্পৃশ্য’। কেরলে সিরীয় খ্রিস্টান বিশপদের সঙ্গে বিজেপির সম্পর্কও কিন্তু লক্ষণীয়: দু’জনেরই মোদ্দা উদ্দেশ‌্য হল ‘ইসলামোফোবিয়া’ এবং ‘লাভ জিহাদ’ নিয়ে উদ্বেগ তৈরি করার সাধারণ ভিত্তি খোঁজার চেষ্টা। ‘লাভ জিহাদ’- যা কিনা বিয়ের মাধ্যমে ধর্মান্তরিত হওয়ার ভয় তৈরি করার জন্য ব্যবহৃত একটি শব্দবন্ধ। গোয়াতেও, বিজেপি, বিশেষত প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী মনোহর পারিক্করের সময়ে, সচেতনভাবে ক্যাথলিক বিধায়কদের সামনে এনেছিল।

[আরও পড়ুন: ছোট্টবেলার প্রেম, আমার টেনিস মেম, কোথায় গেলে হারিয়ে…]

তৃতীয়ত, এখানে এই চিন্তাও নেপথ্যে রয়েছে, খ্রিস্টানদের উপর যে কোনও ধরনের ‘অবিচার’ বিশ্বব্যাপী আলোড়ন ঘটাবে। মনে করে দেখুন, ২০১৫ সালে, প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ভারতের ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা নিয়ে কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, ভারতের এখন যা অবস্থা, তাতে হয়তো মহাত্মা গান্ধীও হতভম্ব হয়ে উঠতেন। মনে করে দেখুন, মোদি ২০২১ সালে কীভাবে পোপ ফ্রান্সিসকে জড়িয়ে ধরেছিলেন, ভারতে তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ব‌্যাপারটা অনেকটা যেন, ক‌্যাথলিক চার্চের দিকে অর্জুনের লক্ষ‌্যভেদের মতো সঠিক জায়গায় তাক করা।

শেষে রয়েছে প্রধানমন্ত্রী মোদির একজন প্রকৃত ভারতজোড়া নেতা হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ার অত্যধিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা, যাঁর আবেদন শুধুমাত্র হিন্দি-বলয় বা হিন্দু ভোটারদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সুবিধাটা করে দিয়েছে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল। উদাহরণস্বরূপ, মেঘালয়ে যখন প্রধানমন্ত্রীকে খাসির লোকায়ত মুকুটে দেখা যায়, বোঝা যাচ্ছিল তিনি স্থানীয় রীতিনীতির সঙ্গে নিজেকে চিহ্নিত ও যুক্ত করতে চাইছিলেন। ওদিকে, বৈষম্যহীন উন্নয়ন প্রকল্প কাঠামোর ভিত্তিতে বিচার্য হওয়ার অভিপ্রায়ে নাগাল‌্যান্ডে ভোট চাইতে গিয়ে তিনি ‘সবকা সাথ’, ‘সবকা বিকাশ’-এর অাওয়াজ তুলেছিলেন।

এখন ধন্দ, বিজেপি খ্রিস্টান ভোটারদের প্ররোচিত করতে কতটা সফল হবে: জন বার্লা রবিবারের ওই জমায়েতে যোগদানের ঠিক আগের দিন, তৃণমূল কংগ্রেসের ডেরেক ও’ব্রায়েন গির্জার প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলেন। খ্রিস্টান ভোটারদের জন‌্য লড়াই সবে তো
শুরু মশাই!

পুনশ্চ: সংঘ পরিবার প্রায়শই খ্রিস্টান মিশনারি স্কুলগুলোকে লক্ষ‌্যবস্তু বানিয়ে এই অপবাদে অভিযুক্ত করে যে, শিক্ষার আড়ালে সেখানে ধর্মান্তরিত করা হয়। কিন্তু, তারা প্রায়শই ভুলে যায়, তাদের নেতারা, সে এক দীর্ঘ তালিকা- লালকৃষ্ণ আদবানি থেকে অরুণ জেটলি, পীযূষ গোয়েল থেকে জেপি নাড্ডা- প্রত্যেকেই মিশনারি প্রতিষ্ঠান থেকে পড়াশোনা করেছেন। ফলে, বিশিষ্ট প্রাক্তন ছাত্ররাই বিষাক্ত রাজনৈতিক প্রচারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে ভাল সাক্ষ্য প্রদান করে ফেললেন!

[আরও পড়ুন: দেশপ্রেমের ‘সুগার কোটিং’ই বিজেপির অস্ত্র, জনতা কি বুঝবে না দিন-রাতের তফাত!]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement