‘ইন্ডিয়া’ জোট যেখানে ছন্নছাড়া, সেখানে রাজ্য ধরে ধরে বিজেপি কিন্তু এগিয়ে চলেছে। বিহার থেকে ঝাড়খণ্ড, জাট-অধ্যুষিত পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ থেকে দাক্ষিণাত্য– ৪০০ আসন লাভে যেখানেই সামান্য খুঁত পাচ্ছে, ঝাঁপাচ্ছে সুচতুর উপায়ে। সঙ্গে জুড়েছে দেশের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মানকে ভোট জয়ের হাতিয়ার করা। ‘কুল নার্ভড’ নরেন্দ্র মোদির কৌশলী রণনীতি বিরোধী-মনে সুচারুভাবে চাপ তৈরিতে সফল। লিখেছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
বিরোধীদের উপর ক্রমাগত একটা মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি (PM Modi)। সংসদের ভিতর জোর গলায় বলেছেন, এবার তঁারা ৪০০ আসন পাবেন। বাইরেও ক্রমাগত একই কথা বলে চলেছেন। এই মনস্তাত্ত্বিক চাপ তিনি ও তঁার দল কৌশলে দেশের মানুষের মধ্যেও সঞ্চারিত করছেন, যাতে দেশবাসী নিশ্চিত হয়, বিজেপির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে এখন কারও বিন্দুমাত্র কোনও অস্তিত্ব নেই।
এই চাপ সৃষ্টি সহজতর হয়েছে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের ভঙ্গুর চরিত্রের কারণে। এত দিন এত ‘ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়া’ করার পর, জোটের নেতৃত্ব গ্রহণ ও আহ্বায়ক পদে যিনি চর্চিত ছিলেন, সলতে পাকানোর কাজ যিনি শুরু করেছিলেন, সেই নীতীশ কুমারের বিজেপির ঘর করতে চলে যাওয়া বজ্রপাতেরই শামিল। অবাক লাগে, যে-মানুষটির রাজনৈতিক চরিত্র এতটাই অনুমানযোগ্য, সেই নীতীশকে সবাই এমন অন্ধের মতো বিশ্বাস করলেন-ই বা কী করে! মূর্খ ও আহাম্মকদের ফল তো ভুগতেই হত।
চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ার মতো এখন যে সমস্ত রাজনৈতিক নেতার টনক নড়েছে, তঁারা বলছেন, নীতীশ এমন করবেন, তা তো জানাই ছিল! এই বোধোদয়ে এখন অবশ্য কোনও লাভ নেই, নীতীশের ভাবমূর্তিতে আরও কয়েক পোঁচ কালি লেপা ছাড়া। তাতে নীতীশের ক্ষতি, বিরোধীদের ছিটেফোঁটা লাভও নেই। খেলা শুরুর আগেই বিরোধীরা হেরে বসে।
নরেন্দ্র মোদির বিজেপি (BJP) অন্যদের থেকে কোথায় ও কেন আলাদা, সাম্প্রতিক কালের পদক্ষেপ ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত তার প্রমাণ। যেদিন থেকে বিজেপি তার পরবর্তী টার্গেট ৩৫৩ থেকে বাড়িয়ে ৪০০ করার কথা শুনিয়েছে, সেদিন থেকেই এক-একটা সিদ্ধান্ত পরিকল্পিতভাবে গৃহীত। নীতীশ কুমারকে জোটে ফেরানোর সিদ্ধান্তও সেই পরিকল্পনামাফিক। এখন তো মনে হচ্ছে, ‘ইন্ডিয়া’-য় নীতীশকে ঢোকানোই হয়েছিল মোক্ষম সময়ে বিরোধীদের চরম অপদস্থ করার উদ্দেশ্যে। বিস্মৃতির অতলে চলে যাওয়া প্রাক্তন সমাজতন্ত্রী কর্পূরী ঠাকুরকে ‘ভারতরত্ন’ দেওয়া সেই ছকেরই অঙ্গ। দেশের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মানকে ভোট-জয়ের হাতিয়ার করা যেতে পারে এ-যাবৎ কেউ সেভাবে ভাবেইনি। এক্ষেত্রেও মোদি অনন্য।
বিজেপি জানে, ২০২৪-এ ৪০০ ছুঁতে গেলে শুধুমাত্র উত্তর ভারত যথেষ্ট নয়। দরকার দাক্ষিণাত্যের দাক্ষিণ্য। সেজন্য তিনি ধাপে ধাপে কী করেছেন? তামিল জনতার মনে দাগ কাটতে সেখান থেকে ‘সেঙ্গল’ এনে প্রতিষ্ঠা করেছেন নতুন সংসদ ভবনে। সময় নিয়ে ভাঙন ধরিয়েছেন এআইএডিএমকে-তে। একের-পর-এক সরকারি প্রকল্প ঘোষণা করেছেন। একই সঙ্গে রামমন্দিরে রামলালার বিগ্রহে প্রাণপ্রতিষ্ঠার আগে ঘুরে বেড়িয়েছেন দাক্ষিণাত্যের একের-পর-এক মন্দির, যার সঙ্গে বনবাসে থাকাকালীন রামচন্দ্রর কোনও না কোনওরকম সংস্রব ছিল। প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গে জড়িয়ে আবেগের প্রশ্ন। এসবও মনস্তাত্ত্বিক চাপ। বলতেই হবে, সেই চাপ সৃষ্টির খেলায় মোদির বিজেপি ১০০-এ ১০০।
এই খেলার শেষ তুরুপের তাস ‘ভারতরত্ন’। কর্পূরী ঠাকুরের পর বিজেপির আদি ‘লৌহপুরুষ’-কে ‘ভারতরত্ন’ দিয়ে মোদি প্রশমিত করেছেন সংঘ পরিবারের সেসব মানুষের ক্ষোভ, যারা অযোধ্যায় আদবানি-বিহনে কাতর ছিল। এরপর পাইকারি হারে নরসিংহ রাও, কৃষিবিজ্ঞানী এম. এস. স্বামীনাথন ও জাট কৃষক নেতা চৌধরী চরণ সিং-কে মরণোত্তর ‘ভারতরত্ন’ দিয়ে তিনি কতগুলো পাখি মারলেন?
প্রথমত, দাক্ষিণাত্যের হৃদয় জিতলেন।
দ্বিতীয়ত, হেয় করলেন কংগ্রেসকে।
তৃতীয়ত, চৌধরী চরণ সিং-কে সম্মানিত করে নির্বিষ করলেন উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলের যাবতীয় জাট-প্রতিরোধ।
২০১৯ সালে উত্তরপ্রদেশের ৮০টি আসনের মধ্যে বিজেপি ১৬টি-তে হেরেছিল। তার মধে্য ছ’টি ছিল পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে। হারের অন্যতম কারণ ছিলেন চরণ সিংয়ের নাতি জয়ন্ত চৌধুরী। মোদি বুঝেছেন, ৪০০ আসন পেতে গেলে জয়ন্তর দল আরএলডি-কে ছেড়ে রাখলে চলবে না। কাছে টানলে পোয়াবারো। বিন্দু বিন্দুতেই সিন্ধু সৃষ্টি। তাছাড়া, জয়ন্তকে কাছে টানার অর্থ ‘ইন্ডিয়া’ ও অখিলেশের আরও একটা পঁাজর ভেঙে দেওয়া।
‘ইন্ডিয়া’-র শরিক হয়েও বারবার প্রকাশ্যে নানা বিষয়ে জোটের সমালোচনায় মুখর হয়েছেন প্রধানত তিনজন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অখিলেশ যাদব ও অরবিন্দ কেজরিওয়াল। তঁাদের ‘কংগ্রেস বিরোধিতা’ কীভাবে মোদির হাতিয়ার হয়েছে নতুন করে, তা বলার আর কোনও প্রয়োজন নেই। নিট ফল: ‘ইন্ডিয়া’-র রুগ্ণতার প্রকাশ ও তার হাস্যাস্পদ হয়ে ওঠা।
জোট যেখানে ছন্নছাড়া, সেখানে রাজ্য ধরে ধরে বিজেপি কিন্তু এগিয়ে চলেছে। বিহার নিশ্চিত করার পাশাপাশি তারা নজর দিয়েছে ঝাড়খণ্ডে। হেমন্ত সোরেনকে বাগে আনতে আপাতত তঁাকে শ্রীঘরে ঠেলেছে। সেখানে আগামী দিনে কোন ভোজবাজি শুরু হবে, কেউ জানে না। কমজোরি রাজ্যগুলোর মধ্যে এখন নজরে রয়েছে মহারাষ্ট্র। উদ্ধব ও শরদ পাওয়ারের ঘর দখলের পরেও তারা নিশ্চিত নয়। কংগ্রেস, শিবসেনা, এনসিপি-কে আরও দুর্বল করা তাদের টার্গেট। এই রাজ্যের ৪৮ আসন নিশ্চিত করার পাশাপাশি তারা নজর দিয়েছে কর্নাটকে। জেডিএস-কে বাগে এনে ভোক্কালিগার মন জয় করা ছিল তাদের প্রথম লক্ষ্য। এর পর তারা থাবা মারবে কংগ্রেসে। দাক্ষিণাত্যের ১৩০ আসনের মধ্যে গতবার তারা পেয়েছিল স্রেফ ২৯টি। ৪০০ টপকাতে গেলে সেখান থেকে এবার হাফ সেঞ্চুরি না করলেই নয়। নরসিংহ রাও ও স্বামীনাথনের মুখ মোদির রেডারে এমনি এমনি ধরা পড়েনি।
দল ভাঙানোর পাশাপাশি অযোধ্যাকে হাতিয়ার করে হিন্দুত্ববাদের চড়া ডোজ দিয়ে সারা দেশে লড়াইটাকে ৮০ বনাম ২০ করে তুলতে কী কী করছে বিজেপি? ধীর লয়ে হলেও পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে চলেছে কাশী ও মথুরার ‘শৃঙ্খলমোচন’-এর লক্ষ্যে। এখানেও পূর্বজদের চেয়ে মোদি আলাদা। আদবানির মতো গণ আন্দোলনে ভর না-দিয়ে আদালতের সাহায্যে তিনি সেই লক্ষ্য হাসিল করতে চান। রঞ্জন গগৈয়ের কাছে বিজেপি চিরকৃতজ্ঞ এই কারণেই।
এই খেলার সর্বশেষ সংস্করণে জুড়েছে ভারতের সংবিধান। ভারতীয় রাজনীতির অকৃত্রিম ‘লুজ ক্যানন’ সুব্রহ্মণ্যম স্বামী এবং ঘোষিত হিন্দুত্ববাদী আইনজ্ঞ পিতা-পুত্র হরিশঙ্কর ও বিষ্ণুশঙ্কর জৈন (হরিশঙ্করের আবেদনেই খুলেছিল বাবরি মসজিদের তালা, এখন কাশী-মথুরার মামলাকারী) সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেছেন সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ (সেকুলার) ও ‘সমাজতান্ত্রিক’ (সোশ্যালিস্ট) শব্দ দু’টি বাদ দিতে। মামলার ভাগ্য কোন খাতে কীভাবে বইবে, কেউ জানে না। আপাতত বিচারপতি সঞ্জীব খান্না ও দীপংকর গুপ্ত ‘অ্যাকাডেমিক’ আগ্রহ ও কৌতূহল প্রকাশ করেছেন। বছর ও তারিখ (১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর) অপরিবর্তিত রেখে প্রস্তাবনায় সংশোধন আনা যায় কি? এই প্রশ্ন তঁারা তুলেছেন। প্রথম প্রস্তাবনায় ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ও ‘সমাজতান্ত্রিক’ শব্দ দু’টি ছিল না। সেগুলো ঢোকানো হয় ২৭ বছর পর ১৯৭৬ সালে ৪২তম সংশোধনীর মাধ্যমে। তাহলে কি ক্ষমতায় থাকার হ্যাটট্রিক করে নেহরুকে ছোঁয়ার পর নরেন্দ্র মোদির লক্ষ্য প্রস্তাবনা সংশোধনের মাধ্যমে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র বিসর্জন দেওয়া?
ভারতকে ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ দেখার স্বপ্ন সংঘ পরিবারের আজন্ম। লোকসভায় ৪০০ আসন এলে রাজ্যসভাতেও দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতা অর্জন জলভাত। সেক্ষেত্রে ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ না হলেও ভারতের রাষ্ট্রীয় ধর্ম ‘হিন্দু’ করা যায় কি না, সেই ভাবনাচিন্তা শাসক মহলে রয়েছে। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। তেমন হলে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতও এক পঙ্ক্তিতে বসে যাবে। ১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধানের চারটি মূল ভিতের একটি ছিল ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’। ১৯৭৭ সালে পঞ্চম সংশোধনী এনে জিয়াউর রহমান সেটি তুলে দেন। ১৯৮৮ সালে হুসেন মহম্মদ এরশাদ ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম করেন। ২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্ট পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে এবং ধর্মনিরপেক্ষতা ফের সংবিধানের মৌলিক ভিত হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ এখন ‘ধর্মনিরপেক্ষ’, কিন্তু রাষ্ট্রীয় ধর্ম ইসলাম।
কে বলতে পারে, ঝোলায় ৪০০ পুরে নরেন্দ্র মোদির ভারত সেই পথে এগবে না?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.