Advertisement
Advertisement
BJP

উলটা বুঝলি রাম

বাংলার মনস্তত্ত্ব কবে বুঝবে বিজেপি?

BJP failed to understand Bengal's mentality | Sangbad Pratidin
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:January 30, 2022 12:51 pm
  • Updated:January 30, 2022 12:51 pm

রাষ্ট্রীয় সম্মান দেওয়ার নামে বুদ্ধবাবুর সিঙ্গুরে টাটার কারখানা গড়ার চেষ্টা ও শিল্পায়নের নীতির প্রতিও কি বিজেপি সমর্থন জানাল? নন্দীগ্রামে গুলিচালনার পর মমতার রাজনৈতিক সাফল্য, অর্থাৎ ক্ষমতায় আসার ঐতিহাসিকতাকেও কিঞ্চিৎ ম্লান করার চেষ্টা আছে। সমস্যা একটাই। বিজেপি বাংলা ও বাঙালির মনস্তত্ত্ব বুঝতে বারবার ভুল করছে। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল

হল নিজের ঢাক নিজে পেটানোর যুগ। আপনি যদি নিজেই ঢাক না বাজান, তাহলে মানুষ মানবে কী করে যে, আপনি ঢাকটাও ভাল বাজাতে পারেন?

Advertisement

এহেন চিৎকারসর্বস্ব আবহে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পারার মধ্যে আছে এক অসম্ভব সংযম। আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর কথা বলছি। হয়তো তুলনাটা বেমানান হতে পারে, তবু চলচ্চিত্র জগতের সাহসিনী তারকা প্রয়াত সুচিত্রা সেনকে দেখেছিলাম খ্যাতির মধ্যগগনে অন্তরালে চলে যেতে। তাই পদ্ম-সম্মান যেভাবে বুদ্ধবাবু ফেরালেন, তাতে বিস্মিত হইনি। বরং বুদ্ধবাবু পদ্মভূষণ সম্মান গ্রহণ করে ফ্ল্যাটের বাইরে বেরিয়ে এসে টিভি চ্যানেলে বাইট দিয়ে নরেন্দ্র মোদির সরকারকে ধন্যবাদ জানালেই কি আমরা অনেক বেশি বিস্মিত হতাম না?

এবারও কলকাতায় এসে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে সিপিএমের সদর দপ্তরে গিয়েছিলাম। এই বাড়িটার সঙ্গে আমাদের সাংবাদিকতার জীবনের কত স্মৃতি জড়িয়ে! বুদ্ধবাবুর দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ কমরেড সর্বাণীকে বলছিলাম, জানি উনি দেখা করবেন না, তবু খুব ইচ্ছা ওঁর সঙ্গে দেখা করার। শুনলাম, উনি অন্তঃপুরবাসী এখন। কারও সঙ্গেই দেখা করতে আগ্রহী নন। চোখে কম দেখেন, কিন্তু দিল্লি-কলকাতা- কোথায় কী রাজনীতি হচ্ছে, সব খবর রাখেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বেশ কিছুদিন আগে ওঁর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন, কিন্তু বুদ্ধবাবু সকলের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েই নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। সত্যিকথা বলতে কী, বুদ্ধবাবু যখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখনও ওঁর স্ত্রী বা কন্যা সুচেতনাকে টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছি খুব কম।

[আরও পড়ুন: আয়কর ছাড়ে ফিরবে সুদিন?]

এহেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে আগাম আলোচনা না করেই মোদি-সরকার হঠাৎ পদ্মভূষণ দিতে চাইল কেন? রাষ্ট্রের এই সম্মানের রাজনৈতিক ব্যবহার তো নতুন কোনও ঘটনা নয়, রাষ্ট্রীয় সম্মান গ্রহণ ও প্রত্যাখ্যান- এই বাংলায় দুইয়েরই ঐতিহ্য আছে। মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন ডা. বিধানচন্দ্র রায়কে ‘ভারতরত্ন’ সম্মান দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু। সাধারণতন্ত্র দিবসের ঠিক একদিন আগে আচমকা এ-খবর আসে কলকাতায়। ডা. বিধান রায়ের সঙ্গে সাড়ে ১৪ বছর ব্যক্তিগত সচিব হিসাবে কাজ করা সরোজ চক্রবর্তী লিখেছেন, ২৫ তারিখে সেই ঘোষণা যখন হয়, তখন মুখ্যমন্ত্রী রাইটার্স বিল্ডিংয়ে বিধায়কদের সঙ্গে ডায়মন্ডহারবার এলাকায় এক নতুন উপনগরী গঠন নিয়ে মিটিং করছিলেন। কমিউনিস্ট বিধায়কদেরও সে-মিটিংয়ে ডাকা হয়। ‘ভারতরত্ন’ তিনি প্রত্যাখ্যান করেননি, তবে কেউই সেদিন ওঁকে উত্তেজিত হতে দেখেননি। তাঁর এই ‘ভারতরত্ন’ পাওয়া নিয়ে কোনও হইচই হয়নি। বরং ডায়মন্ডহারবারের নতুন টাউনশিপে জল ও পয়ঃপ্রণালীর জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০০ কোটি টাকা পাওয়ায় তিনি খুব খুশি ও উত্তেজিত হয়েছিলেন। নেহরু আর ডা. বিধান রায়ের সম্পর্ক সুবিদিত। আর-এক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ‘ভারতরত্ন’ প্রত্যাখ্যান করেন প্রায় দেড় দশকেরও বেশি সময় আগে। জ্যোতিবাবু বলেছিলেন, এসব রত্নের জন্য আমরা কাজ করি না।

রবীন্দ্রনাথ ‘নাইট’ উপাধি ত্যাগ করেন, নেতাজি বা ঋষি অরবিন্দ আইসিএস পাস করেও তা প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু এসব প্রত্যাখ্যান ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে। কিন্তু স্বাধীন রাষ্ট্রে শাসকদল যে-ই হোক, সরকার তো আমাদের, ভারতীয় নাগরিকদের। সেই রাষ্ট্র, সেই সমাজের কল্যাণে, জনজীবনে ভূমিকার জন্য পদ্মভূষণ দেওয়া হলে তা প্রত্যাখ্যান করা হয় কেন?

মনমোহন সিং যখন প্রধানমন্ত্রী, তখন প্রণব মুখোপাধ্যায়কে এ-সম্মান দেওয়া হয়েছিল। আবার নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হয়ে লালকৃষ্ণ আদবানি ও প্রয়াত প্রাক্তন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ব্রজেশ মিশ্রকেও এই সম্মান দিয়েছেন। বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ যখন প্রধানমন্ত্রী হন, তখন বিশিষ্ট সাংবাদিক প্রয়াত নিখিল চক্রবর্তীর জন্য ঠিক এভাবেই ২৫ জানুয়ারি পদ্ম-সম্মান ঘোষণা করা হয়। নিখিলবাবুও সেই সম্মান প্রত্যাখ্যান করেন। দিল্লিতেই থাকতেন নিখিলবাবু। ফোন করেছিলাম সেই সন্ধ্যায়, সেদিনও উনি বলেছিলেন, আমার সঙ্গে কোনও কথা না বলেই এভাবে একতরফা ঘোষণা করার আগে ওরা আমার সঙ্গে কথা বললেই পারত। তাহলে আর ওদের রাষ্ট্রীয় সম্মানটা প্রত্যাখ্যান করতে হত না।

মোদি-সরকারও কিন্তু বুদ্ধবাবুর অনুমতি নেয়নি। কথাও বলেনি। কিন্তু কেন? তবে কি দিল্লি ধরেই নিয়েছিল, বাংলার এই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এই সম্মান পেয়ে এতটাই গদগদ হয়ে যাবেন, যে, তা নিয়ে নেবেন? না কি কেন্দ্রের বিজেপি সরকার জানত, বুদ্ধবাবু ও তাঁর দল এই সম্মান প্রত্যাখ্যান করবে? তাহলে এই সম্মান প্রদানের মধ্য দিয়ে তারা বুদ্ধবাবু ও সিপিএমকে কি একটা ‘ফিল গুড’ বার্তা দিতে চাইলেন? বুদ্ধবাবুর সিঙ্গুরে টাটার কারখানা গড়ার চেষ্টা ও শিল্পায়নের নীতির প্রতিও কি বিজেপি সমর্থন জানাল? নন্দীগ্রামে গুলিচালনার পর মমতার রাজনৈতিক সাফল্য, অর্থাৎ ক্ষমতায় আসার ঐতিহাসিকতাকেও কিঞ্চিৎ ম্লান করার চেষ্টা আছে। এর ফলে কি সিপিএমের ভোটব্যাংক, অর্থাৎ এখনও যা আছে, তা বিজেপির অভিমুখে আরও ধাবিত হবে?

সমস্যা একটাই। বাংলা ও বাঙালির মনস্তত্ত্ব বুঝতে বিজেপি বারবার ভুল করছে। ১৯৯৬ সালে বালাজি রাঘবন বনাম ইউনিয়ন অফ ইন্ডিয়া মামলায় (১ এসসিসি-৩৬১, অনুচ্ছেদ ১৮১) বলা হয়, বংশগতভাবে কোনও ‘উপাধি’ (Hereditary tittle) রাষ্ট্র দেবে না, কিন্তু ভারতীয় নাগরিকদের মৌলিক কর্তব্য পালনের সাফল্যকে উৎসাহিত করার জন্য অনুচ্ছেদ ৫১ (এ) (জে) অনুসারে ‘অ্যাওয়ার্ড ও ডেকরেশন’ দেওয়া যাবে। এটা সাংবিধানিক বেঞ্চের বিখ্যাত রায়।

জাতীয় সংবিধানে পদ্মভূষণ হল তৃতীয় বৃহত্তম নাগরিক সম্মান। ভারতরত্ন ও পদ্মবিভূষণের পরেই। ১৯৫৪ সালের ২ জানুয়ারি এটি শুরু হয়। এই পদকের মাঝখানে দেবনাগরি ভাষায় লেখা থাকে নাম এবং পদ্মের নিচে লেখা থাকে ভূষণ। উলটোদিকে প্ল্যাটিনামে অশোক স্তম্ভ। আর লেখা থাকে ‘সত্যমেব জয়তে’। প্রত্যেক বছর পদ্ম-সম্মান দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতি একটি বিচারক কমিটি গঠন করেন। ১ মে থেকে ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে কমিটির বৈঠক হয়। সুপারিশ চূড়ান্ত হয়। এই রাষ্ট্রীয় সম্মান নিয়ে রাজনীতির অভিযোগ শাসকদলের বিরুদ্ধে উঠেছে বারবার। দু’-দু’বার এই সম্মান দেওয়াই বন্ধ করে দেওয়া হয়। ’৭৭ সালে মোরারজি দেশাই চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী হয়েই পদ্ম-সম্মান বন্ধ করে দেন। তিনি বলেছিলেন, এই সম্মান ‘worthless and politicized’। ১৯৮০ সালের ২৫ জানুয়ারি ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হয়ে আবার এটি চালু করেন। ১৯৯২ সালে আবার এই সম্মান প্রদান কিছুদিনের জন্য বন্ধ থাকে। কারণ, কেরল হাই কোর্টে ১৩ ফেব্রুয়ারি ও মধ্যপ্রদেশ হাই কোর্টের ইন্দোর বেঞ্চে বালাজি রাঘবন ও সত্যপাল আনন্দ জনস্বার্থ মামলা করেন এই মর্মে যে, এই সম্মান নিয়ে রাজনীতি হচ্ছে, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৮ অনুসারে নাগরিকের সাম্যের অধিকার বিঘ্নিত হচ্ছে। মধ্যপ্রদেশ হাই কোর্টের নির্দেশে পদ্ম-সম্মান প্রদান সাসপেন্ড করা হয়। তবে ১৯৯৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের বিশেষ ডিভিশন বেঞ্চ আবার পুরনো প্রথা ফিরিয়ে আনে।

শীর্ষ আদালত বলে, এই সম্মান ভারতীয় সংবিধানের ১৮ নম্বর অনুচ্ছেদের অধীনে দেওয়া হয়।
পদ্ম-সম্মান প্রত্যাখ্যানের ইতিহাসও সুপ্রাচীন। ১৯৫৯ সালে নাট্যকার শিশির ভাদুড়ী এই সম্মান গ্রহণ করেননি। তিনি বলেছিলেন, তাঁর মনে হয়, এসব রাষ্ট্রীয় সম্মান এক ধরনের স্তাবকবাহিনী গড়ে তোলে, যা একজন শিল্পীর জন্য ভাল নয়। তাছাড়া, আসলে যে সরকার নাটকের জন্য কিছুই করেনি, তা এই সম্মান নিলে ভুল প্রমাণিত হবে। ১৯৬৮ সালে সেতারবাদক ওস্তাদ বিলায়েৎ খান পদ্মবিভূষণ সম্মান প্রত্যাখ্যান করেন। ’৬৪ সালে পদ্মশ্রীও তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। রোমিলা থাপারও ১৯৯২ ও ২০০৫- দু’বার এই সম্মান প্রত্যাখ্যান করেন। কে. সুব্রহ্মণ্যম, সাংবাদিক ও বিশিষ্ট আমলা, ’৯৯ সালে সম্মান প্রত্যাখ্যান করে বললেন, আমলা ও সাংবাদিকদের এ-সম্মান নেওয়া উচিত নয়। রোমিলা থাপার রাষ্ট্রপতি আবদুল কালামকে চিঠি দিয়ে বলেছিলেন যে, যখন মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক এ-বিষয়ে তাঁর মত জানতে চায়, তখনই তিনি তাঁর অসম্মতি জানান। তবু কেন তাঁর নাম ঘোষণা করা হচ্ছে?

তাই পদ্ম-সম্মান নিয়ে এ-দেশে রাজনীতি নতুন নয়। এমনকী, ২০০৩ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের নেতা দত্তপন্থ ঠেংডি এই সম্মান নেননি। তিনি বলেছিলেন, যতদিন না আরএসএস প্রতিষ্ঠাতা কে. বি. হেডগেওয়ারকে আর এম. এস. গোলওয়ালকারকে এই সম্মান দেওয়া হবে, ততদিন তিনিও এ-সম্মান নেবেন না।

মনমোহন সিং যখন প্রধানমন্ত্রী, তখন, ২০১০ সালে, ইন্দো-আমেরিকান ব্যবসায়ী সন্ত সিং চাটওয়ালকে পদ্মভূষণ দেওয়া নিয়ে বিরাট বিতর্ক হয়। ২০০৮ সালে আমেরিকার ভোটে ট্যাম্পারিংয়ের অভিযোগ ছিল তাঁর বিরুদ্ধে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ককে ব্যবহার করে তিনি এ-সম্মান পান বলে অভিযোগ ওঠে। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে আমেরিকায় গিয়ে নিজের চোখে দেখেছিলাম, চাটওয়ালের সঙ্গে মনমোহন ও তাঁর পরিবারের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত সম্পর্ক। খুশবন্ত সিংহ পদ্ম-সম্মান গ্রহণ করেন, কিন্তু অপারেশন ব্লু স্টারের পর তা প্রত্যাখ্যান করেন। নিখিল চক্রবর্তী ১৯৯০ সালে বলেছিলেন, সাংবাদিকদের রাষ্ট্রীয় সম্মান গ্রহণ করা উচিত নয়, কারণ তাদের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করা ঠিক নয়। তবে মনমোহন জমানায় ও মোদি জমানায় বহু সাংবাদিকও পদ্ম-সম্মান গ্রহণ করেছেন। শেষে বলতে হয়, আলু আর আলুবোখরার ভেদজ্ঞান থাকে না। ‘গীতশ্রী’ সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে জীবনের শেষ লগ্নে ‘পদ্মশ্রী’? সত্যি বিজেপি, বাংলার মনস্তত্ত্ব- উলটা বুঝলি রাম!

[আরও পড়ুন: আবিদ, শাহ, হাবিবুররা ছিলেন নেতাজির বিশ্বস্ত, বিজেপি যেন না ভোলে]

২০২৪ এর পূজা সংক্রান্ত সমস্ত খবর জানতে চোখ রাখুন আমাদের দেবীপক্ষ -এর পাতায়।

চোখ রাখুন
Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement