২০২৪-এ মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। আরও অনেক জল গড়ানো বাকি। তবে হালের প্যালেস্টাইন-ইজরায়েল দ্বন্দ্বে জো বাইডেন যেরকম অন্ধভাবে ইজরায়েলকে সমর্থন ও সাহায্য করেছেন- তাতে প্রশ্ন উঠেছে- তাহলে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁর তফাত কোথায়? ডেমোক্র্যাট নেতার জন্য এ তো তাত্ত্বিক বিচ্যুতি। কলমে সুমন ভট্টাচার্য
আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস বিয়ে করেছেন ইহুদিকে। তাই এই সংকটের সময় আমেরিকার অ-শ্বেতাঙ্গ ভোটারগণ, যারা নিজেদেরকে প্যালেস্টাইন দাবির সমর্থনে একজোট করছে, তারা ভাইস প্রেসিডেন্ট হ্যারিসকে বিশ্বাস করছে না।
ইটালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি তাঁর প্রধান কূটনৈতিক উপদেষ্টা ফ্রান্সেসকো তালো-কে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছেন। তালো যে-সে ব্যক্তি নন, এর আগে ইজরায়েল এবং ন্যাটোতে ইটালির রাষ্ট্রদূত ছিলেন। ইটালির নব্য-নাৎসি প্রধানমন্ত্রীর নিজের প্রধান উপদেষ্টাকে ছেঁটে ফেলার কারণ- মেলোনি-র সঙ্গে তালো এমন একজনের ফোনে কথা বলিয়ে দিয়েছিলেন, যাঁকে তিনি আফ্রিকান ইউনিয়নের একজন কর্তা বলে ভেবে বসেছিলেন। নিজের ‘প্রধান উপদেষ্টা’ কথা বলতে বলছেন, মেলোনি-ও তাঁর সঙ্গে ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সবিস্তার আলোচনা করেন। পরে ওই ফোনালাপ সামাজিক মাধ্যমে ফাঁস হওয়ার পর দেখা যায়, আসলে তিনি কথা বলেছিলেন রুশ কৌতুকশিল্পী ভ্লাদিমির কুজনেতসভ এবং আলেক্সি স্তোলিরভ-এর সঙ্গে। পরিচিত মহলে ‘ভোভান’ আর ‘লেক্সাস’ নামে জনপ্রিয় এই দুই কৌতুক শিল্পীর খোদ ইটালির প্রধানমন্ত্রীকে এভাবে বোকা বানানো নিয়ে ইটালি তো বটেই গোটা ইউরোপে হইচই পড়ে গিয়েছে। শেষ পর্যন্ত সব দায় নিয়ে পদত্যাগ করতে হয়েছে ইটালির ডাকসাইটে কূটনীতিক এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রধান উপদেষ্টাকে।
এই ঘটনা নিয়ে যেমন আলোচনা হয়েছে ইউরোপে, তেমনই রুশ পত্রপত্রিকাও ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করতে ছাড়েনি। আর ভ্লাদিমির পুতিন? রুশ একনায়ক নিশ্চয় মুচকি হেসেছেন তাঁর দেশের দুই কৌতুকশিল্পী এভাবে ইউরোপের একটি প্রধান দেশের রাষ্টনায়ককে নাকানিচোবানি খাইয়ে দেওয়ায়!
পুতিন এবং মস্কোর অবশ্য ‘খুশি’ হওয়ার অনেক কারণ রয়েছে। গত কয়েক বছর ধরেই তাঁর সঙ্গে যাঁর প্রধান শত্রুতা, সেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জনপ্রিয়তা যেভাবে দিন-দিন কমছে, তাতে ক্রেমলিনের উচ্ছ্বসিত হওয়ারই কথা।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রাশিয়া-চিনের অক্ষে ইরান আগেই যোগ দিয়েছিল, কিন্তু প্যালেস্টাইন ও ইজরায়েল সংঘাত যেভাবে আরব দেশগুলিকেও, বা বলা চলে মুসলিম বিশ্বকেই ওয়াশিংটনের থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তাতে মস্কো নিজের কূটনৈতিক সাফল্যই দেখবে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যা হচ্ছে হোক, খাস মার্কিন মুলুকেও যে জো বাইডেনের জনপ্রিয়তা দিন-দিন কমছে, এ নিয়ে অন্তত কোনও সংশয় রাখার দরকার নেই। ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন সংঘাত শুরু হওয়ার আগে মার্কিন জনমত সমীক্ষাগুলি দেখাচ্ছিল যে ভোটারদের মধ্যে জো বাইডেনের সঙ্গে প্রায় একই বিন্দুতে জাঁড়িয়ে রয়েছেন রিপাবলিকান দলের প্রার্থী হওয়ার দৌড়ে-এগিয়ে-থাকা প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বাইডেন এবং ট্রাম্প দু’জনেরই রেটিং ছিল ৪২ পয়েন্ট করে। কিন্তু গাজা বনাম তেল আভিভের যুদ্ধ মার্কিন রাজনীতির গোটা সমীকরণটাকেই বদলে দিয়েছে।
ডেমোক্র্যাটদের প্রধান ভোট ব্যাঙ্ক, ‘কালার্ড ভোটার’-রা যে বাইডেন থেকে ভোট সরাচ্ছে, তার ইঙ্গিত ইতিমধ্যেই বিভিন্ন জনমত সমীক্ষা দিচ্ছে। ‘অভিবাসীদের দেশ’ বলে মূলত পরিচিত আমেরিকায় আরব মুসলিমরা, দক্ষিণ এশীয়রা এবং কৃষ্ণাঙ্গরা প্রশ্ন তুলছে। বাইডেনও যদি অন্ধভাবে ইজরায়েলকে সমর্থন করেন, গাজায় রক্তস্নান নিয়ে মাথা না-ঘামান, তাহলে তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পের থেকে ভালো, এ-কথা কেন বিশ্বাস করতে হবে? আমাদের মনে রাখতে হবে, এসব জনগোষ্ঠীর ভোটই ২০২০-তে বাইডেনের ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হারাতে সাহায্য করেছিল। একটা উদাহরণ দিয়ে বিষয়টা দেখা যাক। মিশিগানের মতো ‘স্যুইং স্টেট’, যেখানে বাইডেনের জয়ের ব্যবধান ছিল দেড় লক্ষ ভোট, সেখানে আরব মুসলিমদের জনসংখ্যা দুই লক্ষের কাছাকাছি।
‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর প্রতিবেদনই বলে দিয়েছে, এবার মিশিগানের আরব মুসলিমরা কোনওমতেই বাইডেনকে সমর্থনের জন্য তৈরি নয়। আমেরিকার আরব অভিবাসীরা মনে করছে, এর চেয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প এলে তাদের জন্য আর কী খারাপ হতে পারে!
রাষ্ট্রসংঘে যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে রাশিয়া-চিনের সমর্থিত প্রস্তাবের পক্ষে ১২০টি রাষ্ট্র ভোট দিয়েছে, এটি জো বাইডেনের জন্য যতটা বিপজ্জনক, তার চেয়ে ঢের বেশি উদ্বেগের বিষয় হল- মার্কিন কংগ্রেসে ডেমোক্র্যাটদের যে ১৮ জন সদস্য যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে যে প্রস্তাব এনেছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই ‘কালার্ড’ পিপল্। শনিবার নিউ ইয়র্ক থেকে ওয়াশিংটনের বিভিন্ন শহরে প্যালেস্টাইন দাবির সমর্থনে বিরাট মিছিল, বিক্ষোভ আসলে বলে দিচ্ছে মুক্তচিন্তার দেশে এখন আর শুধু ইহুদি লবি সক্রিয় নয়, তার প্রতিস্পর্ধী বা আরব মুসলিমদের স্বার্থরক্ষাকারী গোষ্ঠীগুলিও নিজেদের শক্তি প্রদর্শনে পিছপা হচ্ছে না। সেই কারণেই মার্কিন কংগ্রেসের একমাত্র প্যালেস্তিনীয় মুসলিম মহিলা সদস্য হিসাবে পরিচিত রশিদা তালিব যখন সমাজমাধ্যমে ভিডিও পোস্ট করে লেখেন যে, গাজায় গণহত্যায় মদত দেওয়ার জন্য তাঁরা কোনওদিন জো বাইডেনকে ক্ষমা করবেন না এবং ২০২৪-এ, অর্থাৎ সামনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সমস্ত হিসাব সুদে-আসলে বুঝে নেবেন, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না আরব মুসলিমদের মুখ হিসাবে রশিদা আসলে কী বলতে চাইছেন।
ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিসাবে ২০২৪-এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে এমনিতেই জো বাইডেনকে যথেষ্ট নড়বড়ে দেখাচ্ছে। তার বড় কারণ যদি হয় একদিকে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী হিসাবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ফের ময়দানে নামার সম্ভাবনা এবং প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্টের অতি-দক্ষিণপন্থীদের মধ্যে উত্তুঙ্গ জনপ্রিয়তা, তাহলে অন্যদিকে ৮০-ঊর্ধ্ব হোয়াইট হাউসের বর্তমান বাসিন্দাকে নিয়ে অনেকেরই সংশয় রয়েছে। এহেন সময়ে প্যালেস্টাইন-ইজরায়েল সংঘাত সবকিছু বদলে দিয়েছে। আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস নিজেও ‘কালার্ড উম্যান’, কিন্তু তিনি বিয়ে করেছেন একজন ইহুদিকে। তাই এই সংকটের সময় আমেরিকার অ-শ্বেতাঙ্গ ভোটারগণ, যারা নিজেদেরকে প্যালেস্টাইন দাবির সমর্থনে একজোট করছে, তারা ভাইস প্রেসিডেন্ট হ্যারিসকে বিশ্বাস করছে না। আমেরিকার এই অ-শ্বেতাঙ্গ ভোটাররা মনে করছে, গত ১০০ বছর ধরে সেখানে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের বিরুদ্ধে, সমানাধিকারের দাবিতে যে আন্দোলন চলছিল, তারই প্রসারণ ঘটিয়ে ইজরায়েলের বিরোধিতা এবং প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের দাবিতে সমর্থন করতে হবে। সে কারণেই তো কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েড-এর একজন শ্বেতাঙ্গ পুলিশের হাতে হত্যার পরে, যেসব প্রতিবাদী সংগঠন আমেরিকার রাজপথে নেমে মিছিল করেছিল, এবার তারা-ই আবার ফিরে এসেছে প্যালেস্টাইনকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা ও স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিতে।
মনে রাখতে হবে, মার্কিন ভোটারদের মধ্যে যারা এই প্রগতিশীল বাম এবং যারা অ-শ্বেতাঙ্গ, তারা-ই কিন্তু ডেমোক্র্যাটদের প্রধান ‘ভোট ব্যাঙ্ক’। মার্কিন ভোটারকুলের সেই অংশই যদি মনে করে ইজরায়েলকে অন্ধভাবে সমর্থন করে বাইডেন তাদের সঙ্গে আদর্শগত বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন, তাহলে ২০২৪-এর নির্বাচনের আগে ডেমোক্র্যাট প্রার্থীর জন্য বড় ধাক্কা। অতি সম্প্রতি প্রায় সব ওপিনিয়ন পোলই দেখাচ্ছে ৩৫-এর নীচে মার্কন ভোটারদের মধ্যে বাইডেনের জনপ্রিয়তা তলানিতে এসে ঠেকেছে। আরও চিন্তার বিষয় যে, এই নবীন প্রজন্মের মধ্যে যারা ডেমোক্র্যাট সমর্থক, তারাও বর্তমান প্রেসিডেন্টকে দু’-চোখে দেখতে পারছে না।
তাহলে কী হবে? আইনগত সব বাধা সামলাতে পারলে কি অতি-দক্ষিণপন্থী প্রেসিডেন্ট হিসাবে আবার ডোনাল্ড ট্রাম্পের ফেরা নিশ্চিত? কারণ মার্কিন সমাজের প্রগতিশীল অংশ যারা ডেমোক্র্যাটদের ভোট দেয়, তারা মনে করছে জো বাইডেনের সবকিছু ভুলে গিয়ে ইজরায়েলকে সমর্থন আসলে আদর্শগত বিচ্যুতি। আরব মুসলিম ও কৃষ্ণাঙ্গদের প্রশ্ন, বাইডেন আদতেও কি ট্রাম্পের থেকে আলাদা বা উদারমনস্ক?
তাহলে কি সামনের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে ফেরাটা অনিবার্য হয়ে গেল? না কি সংকট বুঝে ডেমোক্র্যাটরা প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী বদলে দিয়ে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার চেষ্টা করবে? সময়ই হয়তো সে-কথা বলবে, কিন্তু এটা নিশ্চিত- সাম্প্রতিকতম প্যালেস্টাইন-ইজরায়েল সংঘাত শুধু আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে বদলে দেয়নি, আমেরিকার অভ্যন্তরীণ সমীকরণকে একেবারে নড়িয়ে দিয়ে গিয়েছে ঝুঁটি ধরে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.