১৯১৬ সালে স্যামুয়েল ক্যারোথার্স ‘দ্য আটলান্টিক মান্থলি’ পত্রিকায় ‘A Literary Clinic’ নামের প্রবন্ধে প্রথম ‘বিবলিওথেরাপি’ শব্দটি ব্যবহার করেন। ‘ডোরল্যান্ড ইলাস্ট্রেটেড মেডিকেল ডিকশনারি’ বিবলিওথেরাপিকে মানসিক স্বাস্থ্যের স্বীকৃত চিকিৎসা পদ্ধতি হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেছে। এতে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটে। আবেগ, সহানুভূতি এবং সংকট মোকাবিলার ক্ষমতাও বাড়ায়। লিখছেন সুজনকুমার দাস।
‘বিবলিওথেরাপি’ এমন একটি পদ্ধতি– যেখানে বই মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। মানসিক সমস্যার সমাধানে বিবলিওথেরাপিস্টরা পেশেন্টকে ওষুধ প্রেসক্রাইব করেন না, প্রেসক্রাইব করেন বিভিন্ন বই, যেগুলো পড়ে মানুষ মানসিক সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম কখনও কখনও বই আমাদের হাত ধরে এমন এক জগতে নিয়ে যায়, যেখানে বাস্তবতার সমস্ত কোলাহল স্তব্ধ। শব্দহীন শব্দরা ওষুধের মতো কাজ করে ভুলিয়ে দেয় ক্ষত, প্রশমিত করে বেদনা, খুলে দেয় অন্ধকারের পর্দা। যখন জীবন ক্লান্ত, বিষণ্ন– যখন হতাশা ক্রমশ আষ্টেপৃষ্ঠে বঁাধছে, তখন একটি বই হতে পারে মুক্তির দরজা। শারীরিক রোগের যেমন ওষুধ প্রয়োজন, মানসিক ভারসাম্যের জন্য তেমনই প্রয়োজন হয় সাহিত্যের সংস্পর্শ। বই স্রেফ বিনোদন নয়, কখনও কখনও তা হয়ে ওঠে মানসিক আরোগ্যের মন্ত্র।
এই চিকিৎসা পদ্ধতির শিকড় প্রাচীন গ্রিসে। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দে গ্রিক চিকিৎসক হিপোক্রেটাস রোগীদের চিকিৎসায় গল্প ও কাব্যের আশ্রয় নিতেন। প্রাচীন গ্রিকের অ্যাসক্লেপিয়াস মন্দিরে রোগীদের মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসার জন্য গ্রন্থ পাঠ করানো হত। রোমান সম্রাট মার্কাস অরেলিয়াসের ব্যক্তিগত চিকিৎসক তঁার জন্য একটি আলাদা লাইব্রেরি গড়ে তুলেছিলেন, যাতে সেখানকার বইসমূহ মানসিক স্বস্তির উপায় হয়ে উঠতে পারে। আধুনিক ‘বিবলিওথেরাপি’-র সূচনা ঘটে উনিশ শতকের গোড়ার দিকে। আমেরিকান চিকিৎসক বেঞ্জামিন রাশ এবং মিনসন গাল্ট মানসিক পুনর্বাসনের অংশ হিসাবে রোগীদের জন্য গ্রন্থপাঠের ব্যবস্থা করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মানসিকভাবে ভেঙে পড়া সৈন্যদের চিকিৎসায় বই ব্যবহার করা হয়েছিল। ব্রিটিশ রেডক্রস হাসপাতাল ও আমেরিকার বেশ কয়েকটি পুনর্বাসন কেন্দ্রে সৈন্যদের জন্য আলাদা লাইব্রেরি স্থাপন করা হয়, যেখানে বইপাঠকে থেরাপির অংশ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
১৯১৬ সালে স্যামুয়েল ক্যারোথার্স ‘দ্য আটলান্টিক মান্থলি’ পত্রিকায় ‘A Literary Clinic’ নামের প্রবন্ধে প্রথম ‘বিবলিওথেরাপি’ শব্দটি ব্যবহার করেন। এর কয়েক দশক পরে ১৯৪১ সালে প্রকাশিত ‘ডোরল্যান্ড ইলাস্ট্রেটেড মেডিকেল ডিকশনারি’ বিবলিওথেরাপিকে মানসিক স্বাস্থ্যের একটি স্বীকৃত চিকিৎসা পদ্ধতি হিসাবে সংজ্ঞায়িত করে। বিবলিওথেরাপি শুধুমাত্র মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায় না, বরং এটি মানুষের আবেগ, সহানুভূতি এবং সংকট মোকাবিলার ক্ষমতাও বাড়ায়। ২০০৯ সালে ব্রিটেনের ইউনিভার্সিটি অফ সাসেক্সের একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, মাত্র ছয় মিনিটের বইপাঠ মানসিক চাপের মাত্রা প্রায় ৬৮% কমিয়ে দেয়। গবেষণার প্রধান লেখক ড. ডেভিড লুইস বলেন, বই আমাদের মস্তিষ্কে অবচেতন প্রভাব বিস্তার করে। বইয়ের মাধ্যমে আমরা কল্পনার জগতে প্রবেশ করি, যা আমাদের মানসিক ভারসাম্য স্থিতিশীল করে।
ইউনিভার্সিটি অফ টরন্টোর গবেষণায় দেখা গিয়েছে, উপন্যাস পাঠ মানুষের সহানুভূতি এবং সমঝোতার ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করে। যারা নিয়মিত উপন্যাস পড়ে, তারা অন্যের আবেগ ভাল বোঝে এবং সামাজিক সম্পর্ক মজবুত করতে সক্ষম হয়। মানসিক সমস্যার ক্ষেত্রে বিবলিওথেরাপির কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়েছে ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি, ট্রমা এবং বাধ্যতামূলক আচরণ বা ‘অবসেসিভ-কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার’-এর (OCD) মতো সমস্যায়। আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের মতে, বিবলিওথেরাপি চিকিৎসার পর প্রায় ৬০% রোগী মানসিক স্থিতিশীলতা ফিরে পেয়েছে।
মানুষ যখন কোনও উপন্যাস বা গল্পে নিজের জীবনের সমস্যার প্রতিফলন দেখতে পায়, তখন তার মধ্যে এক ধরনের আত্মবিশ্বাস জন্ম নেয়। বইয়ের চরিত্রটি তার মতোই যন্ত্রণার মুখোমুখি হয়েছে এবং তা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে– এই উপলব্ধিই পাঠকের মধ্যে আশার সঞ্চার করে। একজন বিবলিওথেরাপিস্ট মানসিক রোগীকে নির্দিষ্ট বই পাঠের পরামর্শ দেন। হতাশাগ্রস্ত রোগীর জন্য আর্নেস্ট হেমিংওয়ের লেখা ‘The Old Man and The Sea’ বইটি অনুপ্রেরণা জোগাতে পারে। এই উপন্যাসে বৃদ্ধ সান্তিয়াগো দীর্ঘ ৮৪ দিন মাছ ধরতে ব্যর্থ হওয়ার পর অবশেষে এক বিশাল মার্লিন মাছ ধরতে সক্ষম হয়। তিন দিন ধরে সমুদ্রে সংগ্রাম করে সে মাছটিকে হার মানাতে সক্ষম হয়। কিন্তু ফিরতি পথে হাঙর এসে মাছটিকে ছিঁড়ে খায়, ফলে সে কেবল মাছের কঙ্কাল নিয়ে ফিরে আসে। উপন্যাসটি মানুষের অধ্যবসায়, সংগ্রাম এবং পরাজয়ের মধ্যেও সম্মান বজায় রাখার প্রতীক।
‘ভগবদ্গীতা’ সরাসরি বিবলিওথেরাপির বই বলে বিবেচিত না হলেও, এটি একটি শক্তিশালী বিবলিওথেরাপিউটিক বই হিসাবে কাজ করে। কারণ, গীতার দর্শন এবং শিক্ষা মানুষের মানসিক স্থিতিশীলতা ও সংকট মোকাবিলায় সহায়ক, যা বিবলিওথেরাপির অন্যতম লক্ষ্য।
একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, যারা জে. কে. রাউলিংয়ের ‘হ্যারি পটার’ সিরিজ পড়েছে, তারা অন্য জাতি এবং সংস্কৃতির প্রতি তুলনামূলক বেশি সহনশীল হয়েছে। কাজেই বই শুধু মানসিক অবস্থার উন্নতি ঘটায় না, বরং সমাজের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিও পাল্টে দিতে সক্ষম। বর্তমান প্রজন্ম ক্রমশ বই থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। ভার্চুয়াল জগতের মোহে আটকে থাকা তরুণ-তরুণীরা মানসিক স্থিতি হারাচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমে প্রতিযোগিতা এবং স্বীকৃতির চাপ তাদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করছে। ২০২৩ সালে ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’-র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে ২৬৪ মিলিয়ন মানুষ অ্যাংজাইটিতে ভুগছে। প্রতি বছর ৭ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে, যার একটি বড় অংশ ১৫-২৯ বছর বয়সিরা। ভারতে ২০২৪ সালে মানসিক রোগের কারণে কর্মক্ষমতার ক্ষতি দঁাড়িয়েছে প্রায় ৩.৩ বিলিয়ন ডলার।
এই বাস্তবতায় বই হয়ে উঠতে পারে এক গুরুত্বপূর্ণ নিরাময়। বিবলিওথেরাপি শুধু মানসিক চিকিৎসার ‘বিকল্প’ নয়, এটি আত্মোন্নয়নের হাতিয়ার। একটি ভাল বই জীবন পাল্টে দিতে পারে। মানুষ যখন হতাশায় ডুবে যায়, তখন বই তাকে নতুন করে বঁাচার অনুপ্রেরণা দেয়। বিবলিওথেরাপি আমাদের জানায় যে, সমস্যার গভীরে আলো রয়েছে, যা একটি শব্দ, একটি বাক্যের মধ্যেই লুকিয়ে থাকতে পারে। স্যামুয়েল জনসন যথার্থই বলেছিলেন– ‘A writer only begins a book; a reader finishes it.’ বিবলিওথেরাপি কেবল মানসিক স্বাস্থ্যের নিরাময় নয়, এটি নতুন করে বেঁচে থাকার মন্ত্র। একটি ভাল বই যে আলো জ্বালাতে পারে, তা কোনও ওষুধ বা পরামর্শ হয়তো পারে না।
আধুনিক যুগে পাঠাভ্যাসের পরিবর্তন এসেছে। ই-বুক, অডিও বুক এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম জনপ্রিয় হয়েছে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ই-বুক পাঠে আবেগগত সংযোগ কম হয়, কারণ স্ক্রিনে মনোযোগ ভঙ্গ হয়। তবে, ই-বুকের সুবিধা হল বহন করা সহজ এবং তাৎক্ষণিক প্রাপ্তি। যারা নিয়মিত ই-বুক পড়ে, তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি দেখা যায়। অডিও বুক মানসিক চাপ কমায় এবং ঘুমের মান উন্নত করে।
বিবলিওথেরাপিতে ই-বুক বা অডিও বুকের কার্যকারিতা পাঠকের পছন্দের উপর নির্ভর করে। তবে, গভীর আবেগের জন্য প্রিন্ট বই অপরিহার্য।
তবে বিবলিওথেরাপি যে সর্বরোগের মহৌষধ তা নয়। নির্দিষ্ট কিছু মানসিক রোগে বিবলিওথেরাপির ফলাফল উল্লেখযোগ্য। মানসিক অবসাদ, উদ্বেগ, অস্তিত্বের সংকটে ভোগা, সম্পর্কজনিত সমস্যায় বিবলিওথেরাপি কার্যকর। কিছু কিছু শারীরিক সমস্যাতেও বিবলিওথেরাপি কাজে দেয়। ‘ট্রেজার আইল্যান্ড’ খ্যাত স্কটিশ ঔপন্যাসিক রবার্ট লুই স্টিভেনসন যেমন নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলেছিলেন– স্যর আর্থার কোনান ডয়েল রচিত ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চারস অফ শার্লক হোমস’ বইটি পড়ে নাকি সাময়িকভাবে তঁার দঁাত ও বুকের ব্যথা দূর হয়েছিল। তাই নির্দ্বিধায় বলা যায়, সাহিত্যের স্পর্শ জীবনের অনেক সমস্যারই সমাধান হয়ে উঠতে পারে।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক অধ্যাপক, শ্রীপৎ সিং কলেজ
sujandaas@gmail.com
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.