‘ভারত জোড়ো যাত্রা’-র সাফল্যে রাহুল গান্ধী এতটাই উদ্বুদ্ধ ও উজ্জীবিত যে, আরও একটা যাত্রার ঘোষণা সম্মেলনের আসর থেকে করা হয়েছে। কংগ্রেস সমমনোভাবাপন্ন দল নিয়ে জোট গঠনেও আগ্রহী। তবুও প্রধানমন্ত্রিত্বর দাবিদার হিসাবে রাহুলকে খাড়া করা হচ্ছে না। রাজনীতিতে কৌতূহল হয়তো এভাবেই জিইয়ে রাখতে হয়। কলমে সৌম্য বন্দোপাধ্যায়
রায়পুরে কংগ্রেসের মহা অধিবেশন অনেকগুলো বিষয় স্পষ্ট করে দিল। প্রথমটি বিরোধী জোট কেন্দ্রিক। কংগ্রেস জানিয়েছে, সমমনোভাবাপন্ন দল নিয়ে জোট গঠনে তারা আগ্রহী। সেই জোট হবে ইউপিএ জোটের মতোই- যেখানে বিজেপি-বিরোধী দলগুলি গণতন্ত্র, সাম্য, প্রগতিশীল ভাবনাচিন্তা ও ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী হবে। বিজেপি-বিরোধিতা হতে হবে খাদহীন। দ্বিতীয় বিষয়, সেই জোটের নেতৃত্ব দেবে কংগ্রেস। কারণ, কংগ্রেস মনে করে, বিজেপি-বিরোধিতার ক্ষেত্রে তারা নিরবচ্ছিন্নভাবে ধারাবাহিক এবং সর্বভারতীয় আঙিনায় বিজেপিকে টক্কর দেওয়ার যোগ্য। তৃতীয় বিষয়, রাহুল গান্ধী সেই জোটের যোগ্য নেতা। ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ এক ‘নতুন’ রাহুল গান্ধীর জন্ম দিয়েছে। যাত্রার সাফল্যে তিনি এতটাই উদ্বুদ্ধ ও উজ্জীবিত যে, আরও একটা যাত্রার ঘোষণা সম্মেলনের আসর থেকে করা হয়েছে। প্রথম যাত্রা দক্ষিণের সঙ্গে উত্তরের মেলবন্ধন ঘটিয়েছে, দ্বিতীয় যাত্রা জুড়বে পুবের সঙ্গে পশ্চিমকে।
জোটের নেতৃত্বদানের প্রশ্নে কংগ্রেস কোনওরকম আপসে রাজি নয়। সেটা বোঝানো হলেও প্রধানমন্ত্রিত্বের দাবিদার হিসাবে রাহুলকে কিন্তু খাড়া করা হচ্ছে না। প্রশ্নটি উহ্য থাকছে। এটা অবশ্যই এক সুচিন্তিত কৌশল। রাজনীতিতে কিছু কৌতূহল অনেক সময় জিইয়ে রাখতে হয়।
চতুর্থ বিষয়টি নির্বাচনী প্রচার-কেন্দ্রিক। এত দিন ধরে রাহুল ও কংগ্রেস যে-বিষয়টির উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আসছে, নির্বাচনী প্রচারেও সেটাই হবে তাদের প্রধান হাতিয়ার। রাহুলের ভাষণেই তা স্পষ্ট। ভাষণটি শুনলে বোঝা যাবে, কংগ্রেসের আক্রমণের প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সৎ ও দুর্নীতি-বিরোধী রাজনীতির কথা নিরন্তর আওড়ালেও তিনি যে বন্ধুতোষণের মধ্য দিয়ে স্বজনতোষী পুঁজিবাদী নীতির বিকাশে নিবেদিতপ্রাণ, ইংরেজিতে যা ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’, তা প্রমাণে কংগ্রেস তুলে ধরবে মোদির স্বজাতি শিল্পপতি গৌতম আদানির উল্কা-সম বাণিজ্যিক উত্থানকে। রাহুলের ভাষণের সিংহভাগ জুড়ে তাই ছিল মোদি-আদানি আখ্যান। নরেন্দ্র ও গৌতম তাঁর কাছে পৃথক সত্তা নয়। এক এবং একাকার। ‘যিনি রাম তিনিই কৃষ্ণ’ গোছের। রাহুল ভাষণেও তাই বলেছেন, ‘নরেন্দ্র মোদি ও গৌতম আদানি এক ও অভিন্ন।’
এই অভিন্নতা কীভাবে দেশের ক্ষতি করছে, অর্থনীতিকে বিপন্ন করে তুলেছে, সাধারণ মানুষের বিপদ বাড়িয়েছে, প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়ে নতুন অশান্তির বীজ পুঁতেছে এবং সেই সুযোগের আঠেরো আনা সদ্ব্যবহার করছে চিন, তা ব্যাপকভাবে প্রচারের ছক কংগ্রেস কাটতে শুরু করেছে। সম্মেলনে গৃহীত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক প্রস্তাব এবং পরবর্তী রাজনৈতিক আন্দোলনের কর্মসূচিতে চোখ বোলালে বিষয়টি জলের মতো স্বচ্ছ হয়ে যাবে। লোকসভা ভোটের আগে রায়পুরের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে কিছু প্রশ্ন মাথাচাড়া দিচ্ছে।
প্রথম প্রশ্ন, সম্ভাব্য জোটবদ্ধতাকে কেন্দ্র করে। সমমনোভাবাপন্ন দল নিয়ে জোট গঠনের কথা বললেও তা কতটা দানা বাঁধবে সেই সংশয় অনেক দিনের। রায়পুর তার নিরসন করতে পারেনি। বছরের শেষ পর্যন্ত প্রশ্নটি জলের উপর তেলের মতো ভেসে থাকবে। বিধানসভার পরবর্তী ভোটে কংগ্রেস ভাল করলে একরকম, না হলে অন্যরকম। বিজেপি-বিরোধিতার সংজ্ঞাও ঠিক কী, জেগে থাকবে সেই বিতর্কও। আম আদমি পার্টি, তৃণমূল কংগ্রেস এবং কর্নাটকের জনতা দল (এস) কতটা বিজেপি-বিরোধী, সেই প্রশ্ন কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য নেতৃত্বের অনেকে প্রকাশ্যেই তুলেছেন। উত্তরপ্রদেশের সমাজবাদী পার্টি, অন্ধ্রপ্রদেশের ওয়াই এস আর কংগ্রেস ও তেলেঙ্গানার ভারত রাষ্ট্র সমিতি ‘সমমনোভাবাপন্ন’ কি না সেই বিতর্কও কংগ্রেসে জেগে রয়েছে। রাহুল গান্ধীকে জোটের নেতা হিসাবে এই দলগুলো মানবে কি না, ভারত জোড়ো যাত্রার ‘সাফল্য’-র পরও সেই সংশয় কাটেনি।
রায়পুরে রাহুল সোজাসাপটা বলেছেন, তৃতীয় ফ্রন্ট গঠনের অর্থ বিজেপির সুবিধা করে দেওয়া। বিরোধী কুলের একাংশ সেই সম্ভাবনায় এখনও জল ঢালেনি। তাহলে? তৃতীয় ফ্রন্টের পাটিগণিতে অবশ্যই বিজেপির পোয়াবারো। সেই চেষ্টায় তারা খামতিও রাখবে না নিশ্চিত।
পাটিগণিতের হিসাবটাও ঝালিয়ে নেওয়া দরকার। প্রধানত যে-আঞ্চলিক দলগুলির ‘নিখাদ’ বিজেপি-বিরোধিতা নিয়ে কংগ্রেস দ্বিধাগ্রস্ত, তাদের খাসতালুকে কংগ্রেস প্রায় অস্তিত্বহীন। এক বছরের মধ্যে তাতে বিশেষ পরিবর্তনের সম্ভাবনাও নেই। পশ্চিমবঙ্গ, তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্রপ্রদেশের মোট লোকসভা আসন ৮৪। সমাজবাদী পার্টি ও বহুজন সমাজ পার্টির উত্তরপ্রদেশকে এই সঙ্গে জুড়লে সংখ্যাটা হচ্ছে ১৬৪। আম আদমি পার্টি-র দিল্লি ধরলে ১৭১। ওড়িশায় বিজু জনতা দলকে কংগ্রেস কখনও বিজেপি-বিরোধী মনে করেনি। মনে করার কারণও নেই। সেই রাজ্যের ২১ আসনেও কংগ্রেস নিভু নিভু। অর্থাৎ, বিজেপি-বিরোধী লড়াইয়ের শুরুটাই কংগ্রেসকে করতে হবে ১৯২ আসন ছেড়ে রেখে। সমমনোভাবাপন্নতা ও নেতৃত্বের গোঁ বজায় রাখার অর্থ মোদি-বিরোধিতা জোলো হয়ে যাওয়া। কংগ্রেস নিজেও তা জানে ও বোঝে। এখন দেখার, এই ফঁাক ভরাট করতে মল্লিকার্জুন খড়গে ও রাহুল গান্ধীরা বাড়তি পথ হাঁটতে প্রস্তুত কি না। কিংবা সমঝোতা করে হাঁটলেও কতটা নমনীয়ভাবে।
এই রাজনৈতিক পট বদলে দিতে পারে মে মাসে কর্নাটকের ভোট। দক্ষিণী এই রাজ্যে বিজেপি খুব একটা ভাল অবস্থায় নেই। তুলনায় কংগ্রেসের হাল মন্দের ভাল। দু’টি বিষয় জয়-পরাজয় ঠিক করে দেবে। বিজেপির রাজ্য সভাপতি নলিন কাতিলের চাহিদামতো লড়াইটা টিপু সুলতান বনাম সাভারকর হয়ে দাঁড়ালে একরকম। হিন্দুত্বের জোয়ারে বিরোধীরা ভেসে যেতে পারে। কিন্তু তা যদি না হয় এবং সিদ্দারামাইয়া ও ডি. কে. শিবকুমার-কে দুই পাশে নিয়ে মল্লিকার্জুন খড়গে যদি ঠিকঠাক পা ফেলেন, তাহলে কংগ্রেসি ক্যানভাস উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারে। সেক্ষেত্রে বছরশেষে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ের ভোটও রাজনৈতিক থ্রিলার হয়ে উঠতে পারে। জোটবদ্ধতা ও আসন সমঝোতার দরাদরি প্রকৃত অর্থে শুরু হবে তখন থেকে।
রায়পুর একটা সংশয়েরও জন্ম দিয়েছে।একটু পিছিয়ে যান। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের প্রেক্ষাপট বিচার করুন। নরেন্দ্র মোদির মোকাবিলায় কংগ্রেসের প্রচারের প্রধান বিষয় ছিল রাফাল এবং সেই চুক্তিকে কেন্দ্র করে ‘চৌকিদার চোর হ্যায়’ স্লোগান। দেশের মানুষ কিন্তু মোদিকে ‘চোর’ ভাবতে চায়নি। রাহুলের প্রচার আমলে না-নিয়ে মোদিকেই ভরসা করেছিল। আরও বেশি আসনে জিতিয়েছিল। আগামী চিত্রনাট্যও কিন্তু সেই এক ধাঁচে লেখা হচ্ছে। রাফালের স্থান নিয়েছেন গৌতম আদানি। ২০১৯-এ রাহুল অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন। এবারও করবেন। ভারত জোড়ো যাত্রা ও রায়পুরের মহা অধিবেশন তারই ইঙ্গিত। এটা ঠিক, গৌতম আদানি রাফালের মতো ‘অ্যাবস্ট্র্যাকট’ বা বিমূর্ত নন। এটাও ঠিক, হিন্ডেনবার্গের অভিযোগ যে অসত্য, আদানি তা প্রমাণ দিতে পারেননি। সমগ্র বিষয়টা ভারত তথা মোদি-বিরোধিতায় পশ্চিমি চক্রান্ত, বিজেপিও তার ‘প্রশ্নহীন’ প্রমাণ দিতে পারেনি। উল্টে তদন্ত নিয়ে তীব্র অনীহা ও আদানির অবিরাম রক্তক্ষরণ বুঝিয়ে দিচ্ছে ‘ডাল মে কুছ কালা’ নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও শেষ বেলায় ‘মোদি ম্যাজিক’ বিমোহিত করবে না কে বলতে পারে? দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার প্রশ্নে মোদির চৌহদ্দির মধ্যে এখনও কোনও মাথা উঁচু হয়নি। এখনও একটা বছর বাকি। বারাণসীর গঙ্গা ও অযোধ্যার সরযূ দিয়ে এখনও অনেক জল গড়াবে।
অমিতাভ বচ্চনকে খাড়া করে রাজীব গান্ধীকে সরিয়ে দিয়েছিল সেই সময়কার বিরোধী মহল। গৌতম আদানিকে আক্রমণ করে নরেন্দ্র মোদিকে সরানো গেলে ৩৫ বছর আগের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে।
(মতামত নিজস্ব)
[email protected]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.