Advertisement
Advertisement

Breaking News

Bank run

ব্যাংক বাঁচানোর অ্যান্টিডোট

১৯২৯-’৩৩, ঘটে যাওয়া মহামন্দার নেপথ্যে ছিল ‘ব্যাংক রান’।

Bank run and the complex riddle of economy | Sangbad Pratidin
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:October 20, 2022 1:24 pm
  • Updated:October 20, 2022 1:24 pm  

ব্যাংক কী এবং কেন? ব্যাংক গচ্ছিত টাকা কি সবসময় একশো শতাংশ সুরক্ষিত? না। এবং টাকা ফেরত না পাওয়ার আশঙ্কায় আমানতকারীরা টাকা তুলতে থাকলে ব্যাংক থুবড়ে পড়তে বাধ‌্য। ১৯২৯-’৩৩, উন্নত বিশ্বে ঘটে যাওয়া মহামন্দার নেপথ্যে ছিল যে এই ‘ব্যাংক রান’- তা দেখিয়েছিলেন বেন বারনানকি। এবং কীভাবে এর সম্ভাবনা কমানো যায়, তার উপায় বাতলেছিলেন ডগলাস ডায়মন্ড আর ফিলিপ ডিবভিগ। এ বছর অর্থনীতিতে নোবেল পেলেন এই ত্রয়ী। কলমে অচিন চক্রবর্তী

 

Advertisement

মেরিকার তিন অর্থনীতিবিদ- বেন বারনানকি, ডগলাস ডায়মন্ড আর ফিলিপ ডিবভিগ- এ বছর অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, মূলত অর্থনীতিতে ব্যাংকব্যবস্থার ভূমিকার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক অবদানের জন্য। মনে পড়ে পঞ্চম শ্রেণির ইংরেজি পাঠ্যবইয়ে একটি রচনা ছিল, যার উদ্দেশ্য ছিল ব্যাংকিং বিষয়ে গল্পচ্ছলে ছোটদের খানিক ওয়াকিবহাল করে তোলা। রচনাটির শুরু এভাবে- এক ব্যক্তি প্রতিদিন ব্যাংকে গিয়ে তাঁর জমানো টাকা তুলতেন, স্পর্শ করে গুনে দেখতেন পুরো টাকাটা ঠিক আছে কি না, তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে পুরো টাকাটা আবার জমা করে বাড়ি ফিরতেন। গল্পটি দিয়ে ব্যাখ্যা এগতে থাকে- ব্যাংক বস্তুটি কী, লেনদেনের কাজকর্ম ব্যাংক কীভাবে সাধিত করে, কেন ব্যাংক রাখা অর্থ রোজ তুলে দেখার প্রয়োজন নেই, প্রয়োজনের সময়ে তুললেই হবে, ইত্যাদি। আমানতকারীদের টাকা কিছুটা রেখে দিয়ে, যাকে বলে ‘ন্যূনতম আনুপাতিক নগদ জমা’, বাকিটা ধার দিয়ে দেয় ব্যাংক। বলা বাহুল্য, এসব বিষয়ে উল্লিখিত ব্যক্তিটির কোনও ধারণা না থাকার জন্যই এমন অদ্ভুত কাণ্ডটি তিনি রোজ করে থাকেন।

কিন্তু আমরা যারা এমন কাজ করি না, তারাও কি ব্যাংক কী করে এবং কেন করে, তার সবটা বুঝতে পারি? ব্যাংক গচ্ছিত টাকা কি সবসময় একশো শতাংশ সুরক্ষিত? আমানতের টাকা চাইলেই পাব? না, কারণ ব্যাংক ‘ফেল’ করতে পারে, এবং তা ব্যাংকের নিজের দোষে না-ও হতে পারে। হঠাৎ যদি অনেকের মনে হয় ব্যাংক শিগগিরি ফেল করবে (যে অনুমানের বাস্তব ভিত্তি না-ও থাকতে পারে), তাহলে ফেল করবেই। কারণ ফেল করবে এই আশঙ্কায় আমানতকারীরা সব টাকা তুলে নিতে চাইবে, কিন্তু ব্যাংকের পক্ষে একসঙ্গে অনেক আমানতকারীকে টাকা ফেরত দেওয়া সম্ভব নয়। ফেরত দেওয়ার মতো টাকা ব্যাংকে নেই, জানাজানি হলে আরও বেশি সংখ্যায় আমানতকারী টাকা তুলতে আসবে এবং টাকা পাবে না। একে অর্থনীতির পরিভাষায় বলে ‘সেল্‌ফ-ফুলফিলিং প্রফেসি’- অনেকে একসঙ্গে যদি মনে করে এটি হবে, তাহলে সেটি হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায় খুব। সবথেকে বিপদের কথা, একটি ব্যাংকে এরকম শুরু হলে একটার পর একটায় তা ছড়িয়ে পড়তে পারে। এই ‘ব্যাঙ্ক রান’ যে অর্থনীতির পক্ষে মস্ত বড় বিপদ, তা মোটামুটি জানা, কিন্তু ১৯২৯ থেকে ১৯৩৩- উন্নত বিশ্বে যে মহামন্দা দেখা দিয়েছিল, তা অতি সাংঘাতিক হয়ে ওঠার নেপথ্যে যে ছিল এই ‘ব্যাংক রান’, বেন বারনানকি তা গভীর বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছিলেন। তিনি এ বছরের নোবেল প্রাপক ত্রয়ীর মধ্যে অন্যতম।

[আরও পড়ুন: শান্তির নোবেলে ‌আম ও ছালা দুই-ই গেল ইউক্রেনের]

অর্থের ইতিহাসে ব্যাংক রানকে একটি চরম সংকট হিসাবে দেখা হয়। ব্যাংক যে ধার দেয়, তা ব্যাংকের ‘অ্যাসেট’ আর ব্যাংক যে আমানত জমা নেয়, তা ব্যাংকের ‘লায়াবিলিটি’ বা দায়। একদিকে যেমন আমানতকারী যে কোনও সময়ে গচ্ছিত অর্থ নগদে তুলে নিতে পারে, অন্যদিকে ব্যাংকের অ্যাসেটকে ঝটপট নগদে রূপান্তর করে ফেলা যায় না। অর্থাৎ আমানত বেশি ‘লিকুইড’ আর ঋণ কম ‘লিকুইড’। আমানত আর ঋণের মধ্যে এই অসাম‌্যই আসলে সমস্যার মূলে। তাহলে উপায়? আমানতের বিমা একটি উপায় হতে পারে। অর্থাৎ ব্যাংক ফেল করলেও আমানতকারীরা কিছু টাকা ফেরত পাবেনই। কিন্তু সেই টাকার অঙ্ক সাধারণত মোট আমানতের তুলনায় খুব কমই হয়। একেবারে অন্যরকম একটি উপায় হল- ঋণের কেনাবেচার একটি সেকেন্ডারি বাজার তৈরি করা, যেখানে এক সংস্থা আর-একটি সংস্থা থেকে অন্যদের দেওয়া ঋণ কিনে নেবে। এভাবে ‘ইললিকুইড’ ঋণ লিকুইড হয়ে এল প্রাথমিক ঋণদাতার হাতে। কিন্তু এর বিপদের দিক হল, এভাবে ঋণ কেনাবেচা হতে থাকলে মূল যে-কারণের জন্য ঋণ নেওয়া হয়েছিল, সেই বাজারে একটু এদিক-ওদিক হলে গোটা ব্যবস্থাটাই টলমল হয়ে উঠতে পারে। ২০০৮ সালে আমেরিকা এমনভাবেই সংকটে নিমজ্জিত হয়েছিল, যার ধাক্কা গোটা বিশ্বে কমবেশি পড়েছিল।

কী কী উপায়ে ব্যাংক রানের সম্ভাবনা কমানো যেতে পারে, তা একটা শক্তপোক্ত তত্ত্বের পথে খোঁজ না করে আলটপকা নীতি এনে ফেললে লাভের থেকে ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি। সেই গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব গড়ার কাজটি করেছেন অন্য দুই নোবেলজয়ী ডগলাস ডায়মন্ড আর ফিলিপ ডিবভিগ, তাঁদের ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধে। অর্থনীতির উচ্চতর ধাপের ছাত্রছাত্রীদের কাছে ‘ডায়মন্ড-ডিবভিগ’ মডেল পরিচিত। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, সেই তত্ত্বও বিশ্ব অর্থনীতির সংকটে পড়া ঠেকাতে পারেনি।

এই তিনজনের মধ্যে বারনানকি-র পরিচিতি সবচেয়ে বেশি, কারণ তিনি আমেরিকার ‘ফেডেরাল রিজার্ভ’-এর প্রধান ছিলেন, যা এদেশে রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নরের মতো। আমেরিকায় আর্থিক নীতির ভালমন্দের দায়ের সিংহভাগ বর্তায় এই পদাধিকারীর উপর। ২০০৮-এর সংকটের সময়, যে-সংকট শুরু হয় অতিকায় ব্যাংক এবং আর্থিক সংস্থার পতন দিয়ে- তিনিই ছিলেন ফেডেরাল রিজার্ভের মাথায়।

এরকম বিপর্যয়ে বিপর্যস্ত মানুষের যাবতীয় ক্ষোভ যে এই পদাধিকারীর দিকেই ধাবিত হবে, তা স্বাভাবিক। বিশেষত, ভূপতিত ব্যাংকগুলিকে উদ্ধার করতে মার্কিন সরকার যে বিপুল অর্থ ঢেলেছিল, তাঁর পরামর্শে তাকে ঘিরেই ক্ষোভ ছিল বেশি। যারা ঝুঁকিপূর্ণ বন্ধকি ব্যবসা করতে গিয়ে নিজেদের ডোবাল, সেইসঙ্গে গোটা অর্থনীতিকে ডোবাল, তাদের উদ্ধারে করদাতাদের অর্থ ঢালা? রাগ হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু বারনানকি-ডায়মন্ড-ডিবভিগ ত্রয়ীর তত্ত্ব অনুসরণ করলে এই উদ্ধারকর্ম, যাকে পরিভাষায় বলে ‘বেল আউট’, তার যুক্তিটি বোঝা যায়। ব্যাংক যখন অতিকায় হয়ে ওঠে, তখন সেই ব্যাংকের পতন গোটা অর্থনীতিকে ধসিয়ে দিতে পারে। তাই সেরকম ব্যাংক পতনোন্মুখ হলে রাষ্ট্রকেই উদ্ধার কর্মে নামতে হবে অর্থনীতিকে বাঁচাতে। করদাতাদের টাকা অপাত্রে যাওয়াটা অন্যায্য মনে হতে পারে, কিন্তু সেটি না হলে যে-বিপর্যয় নেমে আসবে নাগরিক জীবনে, সেই ক্ষতি আরও বেশি। আমেরিকার আর্থিক সংকটে বারনানকির নীতি নিয়ে বিতর্ক হয়তো চলতেই থাকবে, ফলে তাঁর নোবেল প্রাপ্তিতে বিরূপ মন্তব্যও ভেসে আসছে। তবে এই প্রথম নয়, অর্থনীতির নোবেল নিয়ে বিতর্ক আগেও হয়েছে।

 

(মতামত নিজস্ব)
লেখক ইনস্টিটিউট অফ ডেভেলপমেন্টাল স্টাডিজ, কলকাতার ডিরেক্টর ও অর্থনীতির অধ‌্যাপক
[email protected]

[আরও পড়ুন: ‘হেট স্পিচ’ নিয়ে ভর্ৎসনা সুপ্রিম কোর্টের, তবুও কেন নীরব সরকার?]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement