এবারের নির্বাচনী ফলাফলে ভারতীয় রাজনীতি এক ইন্টারভ্যালের পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। একটা জিনিস স্পষ্ট– নরেন্দ্র মোদিকে ঘিরেও যে জে্যাতির্বলয় এতকাল জ্বলজ্বল করছিল, তা হালে ঢিমে। ভোটার জনগণ মনে করিয়ে দিল যে, এমনকী, ঈশ্বরের পা-ও মাটি দিয়ে গড়া। লিখলেন রাজদীপ সরদেশাই।
যে কোনও ব্লকবাস্টার সিনেমা দেখার মজা হরেক। তবে, অন্যতম উত্তেজনা দেয় সিনেমার ইন্টারভাল, কারণ তখন অদ্ভুত এক নাটকীয় উচ্চতায় পৌঁছে যায় ছবির প্লট। কিছুক্ষণের বিরতি, বুকে একরাশ আলো আর অভূতপূর্ব কিছু ঘটার আশা নিয়ে সিনেমা হলের ওই ঝিম অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসা। ভারতীয় রাজনীতিও প্রায় এক দশকজুড়ে টানা ক্রিয়াশীল আর চড়া দাগের মেরু বিভাজন পেরিয়ে তেমনই এক ইন্টারভালের পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। ২০১৪ সালে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নরেন্দ্র মোদির অভিষেকের পর থেকে সংবাদমাধ্যমকে স্টেরয়েড দিয়ে সদা-জাগ্রত রাখতে হয়েছে। একের পর এক খবর উত্তেজনার বাতাবরণ তৈরি করেছে। নোটবন্দি থেকে শুরু করে লকডাউন, বিরোধী সাংসদদের সংসদ থেকে বহিষ্কার কিংবা কৃষক বিদ্রোহ– বলতে গেলে হঁাফ ফেলার সময়টুকু পাওয়া যাচ্ছিল না। এখন, শেষমেশ দেশজুড়ে ভোটার ভগবান ভোটদান করে সেই অবিরাম জগঝম্পে কিছুক্ষণের হলেও বিরাম টানল, যদিও তা কতক্ষণ স্থায়ী হবে, জানা নেই।
তাই, ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের এই জনাদেশকে নিয়ে খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে যাওয়াটা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। মোদিভক্ত কুল একদিকে ঢাক পিটিয়ে চলেছে, বিজেপি আর যা-ই হোক ২৪০টা আসন পেয়েছে, যা গত তিরিশ বছরে কংগ্রেসের চেয়ে ভাল, আর তাই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি (PM Modi) এখনও নেতা নাম্বার ওয়ান-ই রয়েছেন। অন্যদিকে, মোদির সমালোচক গোষ্ঠীর বক্তব্য, এবারের জনাদেশ শাসকের বিরুদ্ধেই গিয়েছে– যে শাসক দল ‘চারশো পার’-এর হঁাকডাক তুলেছিল খুব, কিন্তু কী অদ্ভুত, এককভাবে তারা ২৭২-এর ‘ম্যাজিক ফিগার’ বা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ধারেকাছে অবধি পৌঁছতে পারল না। কিন্তু, আসল সতি্যটা, বরাবরের মতোই, এই দুই আখ্যানের মাঝামাঝি কোথাও ঘাপটি মেরে আছে।
এক রাজ্য থেকে আরেক রাজে্য বিজেপি (BJP) যেভাবে অশ্বমেধ যজ্ঞের বিজয়ঘোড়া ছোটাবে বলে ভেবেছিল, সেই প্রয়াসকে নিঃসন্দেহে থামানো গিয়েছে। দেশের তিন বড় রাজ্য– উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র এবং পশ্চিমবঙ্গে, দ্বিতীয় স্থানে থেমে গিয়েছে বিজেপির রথ। এমন ফলাফল– কেন হল, কোথায় গলদ তৈরি হল; তা নিয়ে অনেক চাপানউতোর চলছে বটে, তবে একটা জিনিস স্পষ্ট– এই সর্বেসর্বা নির্বাচনতন্ত্র মোটেই আর অজেয় নয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ঘিরেও যে জে্যাতির্বলয় এতকাল জ্বলজ্বল করছিল, তা হালে ঢিমে– ‘সেন্টার ফর স্টাডিজ অফ ডেভেলপিং সোসাইটিজ’-এর নির্বাচন-পরবর্তী সমীক্ষাই তার প্রমাণ। উত্তরপ্রদেশের মতো জায়গায় দেখা যাচ্ছে, রাহুল গান্ধী স্বয়ং নেতৃত্বের দিক থেকে মোদির চেয়ে বহুগুণে এগিয়ে। বিগত কয়েক দশকে, এই প্রথম সম্ভবত, রাহুল গান্ধী গোবলয়ের মূল ভূখণ্ডে এমন জনপ্রিয়তার রোশনাই পেলেন!
তবুও, দেশজুড়ে বিজেপির তুলনায় কংগ্রেস ভোটসংখ্যা এবং আসনে অনেকটা পিছিয়েই রইল। যেখানে যেখানে বিজেপি বনাম কংগ্রেসের টক্কর হয়েছে, সেখানে আসনের ব্যবধান পঁাচ বছর আগের চেয়ে অনেকটাই কমেছে, কিন্তু ততটাও কম নয়, এবং ভারিক্কি বিজেপির পক্ষেই– বিজেপি জিতেছে ১৫৭টা আসন, কংগ্রেস জিততে পেরেছে সেখানে মাত্র ৫১টা। একমাত্র রাজ্য, যেখানে কংগ্রেস সতি্যই দাপট দেখিয়েছে, তা হল কেরল, আর সেখানেও কংগ্রেসের বিপক্ষ বামপন্থী দল, বিজেপি নয় কিন্তু। কর্নাটক, তেলেঙ্গানা, হিমাচল প্রদেশ– যেখানে রাজ্য সরকার হিসাবে কংগ্রেসের শাসন, সেখানেও এই নির্বাচনে কংগ্রেসের আসন কম।
যদিও, এই নির্বাচনী অঙ্ক ২০২৪ নির্বাচনের কিয়দংশই ব্যাখ্যা করতে সক্ষম। এবারের নির্বাচনের হল্লা ছিল একটিমাত্র রসায়ন, একটিমাত্র অনড় বিশ্বাসকে ঘিরেই– ‘মোদি কি গ্যারান্টি’ স্লোগান একাই বিজেপিকে তাদের অভীপ্সিত লক্ষে্যর শিখরে পৌঁছে দেবে। কিন্তু, এটাই বিজেপির ক্যাম্পেনিংয়ের গলদে পর্যবসিত হল। তারা ভুলে গেল, বৈচিত্রের দেশ ভারতে, জনতাই জনার্দন। একা কেউ জনগণের চেয়ে বড় নন। দেখুনই না, বিজেপির শতাধিক প্রার্থী অন্যান্য দল থেকে তুলে আনা, অন্যদিকে ১৩২ জন সাংসদকে প্রতিস্থাপিত করা হল। যা থেকে বোঝা যায়, বিজেপি আত্মবিশ্বাসে অন্ধ হয়ে পড়েছিল। তাদের ‘এক নেতা, এক দেশ’-এর কোরাস এই অন্ধবিশ্বাসের প্রণেতা। যার পরিণতিতে একজন ব্যতীত বাকি সমস্ত প্রার্থী হয়ে উঠল মুখহীন এবং অপ্রয়োজনীয়।
এহেন মোদি-কেন্দ্রিক রাজনীতি এখন নিরতিশয় ক্লান্ত, ধুঁকছে, ক্ষয় শুরু হয়ে গিয়েছে এর। বিজেপির মূল ভোটব্যাঙ্ক রাজ্য গুজরাত আর মধ্যপ্রদেশ বাদ দিলে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ভোটার এই ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ ব্যক্তিক ভাবমূর্তিকে প্রত্যাহার করেছে– আর পছন্দ হিসাবে বেছে নিয়েছে অধিক আঞ্চলিক, মনুষ্যপ্রতিম প্রার্থীকে। এর তিনটি দৃষ্টান্তমূলক ফল স্পষ্টত দৃশ্যমান– প্রথমত বেনারস। বিজেপি ভেবেছিল, এখানে প্রধানমন্ত্রী রেকর্ড ব্যবধানে জিতবেন। কিন্তু, হা হতোস্মি! দেখা গেল, জয়ের মার্জিনে ৩.২ লক্ষ ভোট কমেছে আগের থেকে।
ফৈজাবাদ-অযোধ্যা তো অন্যতম দৃষ্টান্ত। এই সেই জায়গা, যেখানে, জানুয়ারি মাসে, রামমন্দিরের আত্মপ্রকাশ-কে ঘিরে হিন্দুত্ববাদী ভাবধারার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ হিসাবে দেখা হয়েছিল। কিন্তু, এখানেই দলিত সম্প্রদায়ের এক তরুণ তরতাজা নতুন মুখ হারিয়ে দিল দু’বার জেতা, পোড়খাওয়া সাংসদকে। আর, অবশ্যই তালিকায় থেকে যাবে, রাজস্থানের বঁাশওয়াড়া। এখানেই প্রধানমন্ত্রী সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক ভাষণ দিয়েছিলেন, ‘মঙ্গলসূত্র’ বিষয়ক এবং মুসলিম সম্প্রদায়কে ঠেস মেরে। আর এখানেই, ‘ভারত আদিবাসী পার্টি’-র এক তরুণ আদিবাসী নেতা জয়ী হলেন। বিজেপি নয়।
সামগ্রিকভাবে, এই ফলাফলগুলি এবং সার্বিকভাবে বিভক্ত রায় পেশিবহুল হর্তাকর্তাময় রাজনীতিরই সীমাবদ্ধতাকে উলঙ্গ করল। এই সেই রাজনীতি প্রকরণ, যেখানে দেবতার ভেকময় শালপ্রাংশু রাজা-মহারাজাসুলভ ব্যক্তিত্বের অধীনে প্রতিষ্ঠান এবং আদর্শ, এমনকী, ধর্ম এবং সমাজকেও আবছা করে দেওয়া হয়। উলটোদিকে, এবারের ভোটার জনগণ আমাদের মনে করিয়ে দিল যে, এমনকী ঈশ্বরের পা-ও মাটি দিয়ে গড়া। এই জনাদেশ শাসকের কাছে বৃহত্তর দায়বদ্ধতার দাবি তৈরি করেছে এবং অবশ্যই, রাজনৈতিক নেতৃত্বের নম্রতাও।
এই আধিপত্যময় ভাবমূর্তিকে বেআব্রু করে ফেলা হলেও, এমনকী তঁার দলের রাজনৈতিক ও নৈতিক ধার-কে কিঞ্চিৎ ভেঁাতা করা গেলেও, ক্ষমতাচু্যত করা তো যায়নি। তাই, মোদি-যুগ এখনই ফুরিয়ে যাচ্ছে না। হতেই পারে, এবার জোট সরকার গঠিত হল, কিন্তু পূর্বতর জোট আয়োজনের নিরিখে এবারে একটি পার্টির আধিপত্য কিন্তু সেই থাকছেই। এবং, বিজেপি এবার ৬৩টি আসন হারলেও, পূর্বের তুলনায় ৬৯ লক্ষ বেশি ভোট পেয়েছে। এতদিন যা একতরফা সিদ্ধান্তগ্রহণে চলছিল, এবার হয়তো আলোচনার পরিসর গড়ে উঠবে, কিন্তু তা কদ্দিন, যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে।
একদিক থেকে, কী হবে এরপর, তা কিন্তু মোটেই বিজেপির জোটশক্তির উপর নির্ভর করছে না। কারণ, তাদের হাতে উপায় সীমিত, ক্ষমতার ছত্রছায়ায় থাকা ছাড়া বিকল্প নেই খুব একটা। বরং, ক্ষমতা অনেক বেশি ন্যস্ত বিরোধী পক্ষের উপর। কারণ, জনগণ এই পক্ষকে এবারে বিপুল ভোটদানে শক্তিশালী করে তুলেছে। প্রায় দশ বছর ধরে দুরমুশ হতে হতে, ভাঙা দল নিয়ে, বিরোধী নেতারা জেরায় জেরবার এমনকী কারাবন্দি হয়ে– সংসদ ভবন নিতান্ত নোটিস বোর্ডে রূপান্তরিত হয়েছিল। কিন্তু, এবার বিরোধী পক্ষ সংখ্যায় অনেক বেশি, এবং তাদের বলার স্বর তৈরি হয়েছে, সংখ্যায় বেড়েছে, আর সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। জনগণ কেবলই একজন বিনয়ী প্রধানমন্ত্রীকে চায় না, একই সঙ্গে চায় বিরোধী পক্ষ হোক তেজি। মানুষের সমস্যাকে তারা খুঁটিয়ে এবং সমন্বিতভাবে তুলে আনবে সংসদে, আর সেখানে থাকবে যৌথতা। সেই যৌথতা হবে গঠনমূলক, বিশৃঙ্খল নয়।
ভারতীয় রাজনীতির এই ইন্টারভাল কতক্ষণের, তা স্পষ্ট নয় আপাতত। হয়তো আগামী বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল অবধি এর গুবগুবি চলবে। কিন্তু, যা অধিক নিশ্চয়তার সঙ্গে বলা যায়, ভারতীয় ভোটার দ্বন্দ্বের জায়গায় বেছে নিয়েছে ঐকমত্য, বেছে নিয়েছে একাধিপত্যবাদী প্রশাসনের বদলে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, এবং স্বৈরিতার বিরুদ্ধে স্থাপন করেছে বহুমত, বৈচিত্রকে। এই অভূতপূর্ব নির্বাচনীকে ফলকে গ্রহণ করতে তো হবেই শাসক দলকে, আর তার জন্য চাই সার্বিক বিচক্ষণতা, সৎ বিবেচনা। নয়তো উত্তরোত্তর অধৈর্য ভোটার আবার ফুঁসে উঠবে, আর ইন্টারভালের পর দ্বিতীয় দফায় রাজনৈতিক হালচাল কোথায় গিয়ে পৌঁছবে, তা ভেবেও কুলকিনারা পাওয়া যাবে না।
পুনশ্চ: মানুষের অন্যতম গুণ যদি হয় বিনয়, তাহলে তার খাতিরেই সংবাদমাধ্যমের বেশ কয়েকজনের উচিত জনতার কাছে ক্ষমতা চেয়ে নেওয়া। তাদের অপরাধ: তারা দেখিয়েছিল এবং উচ্চকিত স্বরে আরোপ করেছিল, তাদের বুথফেরত সমীক্ষাই আসল নির্বাচনী ফল। আমাদের বুঝতে হবে, দরকারে বিরতি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে, কীভাবে নির্বাচনী তরজা ও ফলাফলের আখ্যান তুলে ধরা যায়। সেখানে উসকানিমূলক, উত্তেজনা উদ্রেককারী ভাষ্য পরিহার করতে হবে, সবজান্তা ভাব কমাতে হবে। আরও বেশি করে বুঝতে হবে ভোটারের মন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.