কাব্যগ্রন্থর নাম ‘Love, Robot’। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে এদেশে হইচই শুরু হওয়ার অনেক আগে ২০১৭ সালেই এই বই লেখা হয়ে গিয়েছে। এক মানুষী আর এক রোবটের প্রেমকাব্য। এই বইয়ে মানুষ ক্রমশ কথা বলতে শুরু করছে রোবটের ভাষায়। এআই-সৌজন্যে এই আপাত অলীক কাব্য ঘোরতর বাস্তব হয়ে উঠছে ক্রমশ। ব্যক্তিগত, আঞ্চলিক এবং মান্য ভাষাও তার উষ্ণতা হারিয়ে হয়ে পড়ছে যান্ত্রিক! লিখলেন অংশুমান কর।
প্রেমিকা তার প্রেমিককে বলছে, সে যেন তার ‘রোটেশনের অ্যাক্সিস’-টুকু খেয়াল রাখে। বলছে যে, তার ‘প্রোগ্রামিং ইজ ন্যাসেন্ট’। এই হল প্রেমের ভাষা। আজকের কাব্যে। এই কবিতা লিখেছেন মার্গারেট রি। কাব্যগ্রন্থের নাম ‘Love, Robot’। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে এ-দেশে হইচই শুরু হওয়ার অনেক আগে ২০১৭ সালেই এই বই লেখা হয়ে গিয়েছে। এক মানুষী আর-এক রোবটের প্রেম নিয়ে এই কাব্য। লক্ষ করার বিষয় হল এই যে, এই বইয়ে মানুষ ক্রমশ কথা বলতে শুরু করছে রোবটের ভাষায়। মাঝে মাঝে পার্থক্য করা মুশকিল হচ্ছে মানুষের ভাষার সঙ্গে মেশিনের ভাষার। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যত শক্তিশালী হবে, ততই কি এভাবে মানুষের ভাষার জায়গা নিতে থাকবে যন্ত্রের ভাষা? বিপন্ন হতে থাকবে সব ক’টি মাতৃভাষাই? আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সপ্তাহে একটু ভাবতে ইচ্ছে করছে এই প্রশ্নটি নিয়ে, যে-প্রশ্ন ভাষাতাত্ত্বিকদের অনেককেই এখন ভাবাচ্ছে।
হায়দরাবাদ লিটারারি ফেস্টিভালে ভাষাতাত্ত্বিক জি. এন. ডেভি বলছিলেন যে, ছোট ছোট সম্প্রদায়ের ভাষাই যে এখন শুধু বিপন্ন, তা নয়, বিপন্ন পৃথিবীর সমস্ত ভাষাই। ব্যক্তিগত আড্ডায় এই লেখককেও তিনি বলছিলেন যে, প্রতিটি ভাষার যে-নিজস্বতা, যে-সূক্ষ্মতা, তা অন্তর্হিত হচ্ছে দ্রুত। এর অন্যতম কারণ অবশ্যই কৃত্রিম প্রযুক্তির বহুল ব্যবহার। বিপদটা ঠিক কোথায়? মানুষের জীবনে আরও বেশি বেশি করে রোবট প্রবেশ করবে, হয়তো হয়ে উঠবে জীবনসঙ্গীও, আর সেই জীবনসঙ্গীর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে মানুষকে পাল্টে নিতে হবে তার ভাষা, প্রতিনিয়ত ব্যবহার করতে হবে এমন এমন শব্দ, যেগুলির অঙ্গাঙ্গি যোগ যন্ত্রের সঙ্গে, কেবল সেইখানে? তা কিন্তু নয়। মার্গারেট রি-র কবিতা এই প্রবণতাকে ইতিমধ্যেই চিহ্নিত করেছে ঠিক, কিন্তু বিপদ কেবল এটিই নয়। কর্পোরেট সংস্থাগুলি এখন যে-ভাষায় তাদের কর্মীদের সঙ্গে কথোপকথন করে, তার অনেকখানিই যন্ত্রের ভাষা। মানুষের ভাষার যে-উষ্ণতা ভাষাকে শরীরী করে তোলে, সেই উত্তাপ এই ভাষায় অনুপস্থিত।
মানুষের সঙ্গে যন্ত্রের কথোপকথন যে কেবল এই ভাষায় হচ্ছে, তা নয়, হচ্ছে মানুষের সঙ্গে মানুষের কথোপকথনও। দিন-রাত এই আবহাওয়ার মধ্যে থাকতে থাকতে বহুজাতিক এক সংস্থার কর্মী ভুলে যাচ্ছেন নিজের মাতৃভাষার সূক্ষ্মতাগুলিও। প্রায় ব্যবহারই করছেন না প্রবাদ-প্রবচন। নানা কারণে ইতিমধ্যেই এমনকী শক্তিশালী ভাষারও একাধিক প্রবাদ-প্রবচন অব্যবহার্য হয়ে পড়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যখন মানুষের ভাষার দখলদারি প্রায় সম্পূর্ণ নিয়ে ফেলবে, তখন এইসব প্রবাদ-প্রবচনের আর একটিও জীবিত থাকবে কি না সন্দেহ জাগে। আরও একটি বড় বিপদও আমাদের সামনে উপস্থিত। সে-কথায় পরে আসা যাবে। তার আগে অন্য একটি কথা বলা জরুরি।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগে মানুষের ভাষার কেবল ক্ষতি হয়েছে বা ক্ষতি হবে, এমনটা কিন্তু আদৌ নয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগে মানুষের ভাষা লাভবানও তো হচ্ছে। তাই তো উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে ভাষার দুনিয়ায় এআই-এর প্রয়োগ। লাভের অঙ্কটি ঠিক কীরকম? ছাত্রছাত্রীরা দ্রুত ভাষা শিখছে এআইয়ের ব্যবহারে। বিশেষভাবে সক্ষম মানুষেরও ভাষা প্রয়োগের ক্ষেত্রে নানা সুবিধা করে দিচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। কথা বলতে পারে না যারা, মানে যাদের আমরা বলি ‘বোবা’, তারাও কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে সহজেই কথা বলতে পারছে অন্যদের সঙ্গে। ‘এআই ল্যাঙ্গোয়েজ মডেল’ সহজেই ‘টেক্সট’-কে পাল্টে নিতে পারছে স্পিচে। এক ভাষার মানুষের বলা কথা এআই দ্রুত অনুবাদ করে দিচ্ছে অন্য ভাষায়, যোগাযোগের পৃথিবী ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। এআইয়ের অনুবাদের মান নিয়ে এখনও কিছু অভিযোগ আছে বটে, কিন্তু ভাষাতাত্ত্বিকরা মনে করছেন, অতি দ্রুত এআই উন্নত মানের অনুবাদ করতে সক্ষম হবে। এমনকী, সাহিত্যের অনুবাদের ক্ষেত্রেও এআইয়ের করা অনুবাদকে খসড়া হিসাবে ব্যবহার করে, সেই অনুবাদকে ঘষামাজা করে প্রকাশযোগ্য করে নিতে পারবেন অভিজ্ঞ অনুবাদকরা।
কিন্তু এই সমস্ত কাজকর্ম হতে থাকবে কোন ভাষায়? বিপদটা এই প্রশ্নের উত্তরেই লুকনো। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিজের থেকে নতুন ভাষার জন্ম দিতে পারে না। সাইবার দুনিয়ায় ঘুরছে ভাষার যে-ক’টি রূপ, সে ব্যবহার করতে থাকে সেই ক’টি রূপকেই। একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। বঁাকুড়া বা পুরুলিয়ায় যে-বাংলা ভাষা ব্যবহার করা হয়, সাইবার দুনিয়ায় সেই ভাষাটির অস্তিত্ব কতখানি? তথাকথিত মান্য কৃষ্ণনাগরিক বাংলার তুলনায় বেশ কম। এআই-নির্ভর বাংলা ভাষা আগামী দিনে বাংলা ভাষার এই রূপগুলিকে আদৌ ব্যবহার্য বলে মনে করবে কি? কাজেই, ভাষা ব্যবহার যত বেশি এআই-নির্ভর হতে থাকবে, ততই একটি ভাষার একাধিক রূপের হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
সাইবার দুনিয়ার ভাষা অনেকখানি নিয়ন্ত্রিত উচ্চবিত্ত মানুষের দ্বারাও। নিম্নবিত্তর যে-ভাষা, সে-ভাষাকে সাইবার দুনিয়ায় সেভাবে খুঁজে পাওয়াই যায় না। একইভাবে পুরুষরা সাধারণত ব্যবহার করে থাকে যে-ভাষা, এ দুনিয়ায় তার চেয়ে অনেক কমজোর উপস্থিতি নারীর ব্যবহৃত ভাষার। কাজেই, পশ্চিমবঙ্গের বাংলার কথাই যদি ধরি, তাহলে কেবল যে কৃষ্ণনাগরিক, পুরুষশাসিত মান্য বাংলাই অন্য বাংলা ভাষাগুলোর উপরে আরও বেশি করে রাজত্ব করবে, তা-ই নয়, দাপট দেখাবে উচ্চবিত্তর ব্যবহৃত বাংলা ভাষাও। সে-ভাষাতেও বেশি বেশি করে ঢুকে পড়বে যন্ত্রের শব্দ। ভাষা তার সূক্ষ্মতা হারিয়ে, নিজস্ব বিচিত্র সৌকর্য ও ব্যবহার হারিয়ে হয়ে পড়তে থাকবে আরও বেশি সাধারণীকৃত, আরও বেশি মান্য। ব্রিটেনের একটি সমীক্ষা থেকে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নজরে এসেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার চাকুরিক্ষেত্রে যত বাড়তে থাকবে, ততই কাজ হারাতে থাকবে অদক্ষ শ্রমিকরা, কারণ এদের কাজ করে দিতে থাকবে যন্ত্র। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, ১৮৪১ সালে যেখানে কৃষিক্ষেত্রে ব্রিটেনে এই ধরনের শ্রমিকরা ছিল ২০%, এখন সেখানে তাদের উপস্থিতি মাত্র ১%। দেখা গিয়েছে, শহুরে পরিমণ্ডলে, এদের সংখ্যা হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গেই ভাষা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে এমন কিছু শব্দ, যা একসময় ব্যবহৃত হত যথেষ্ট পরিমাণে। কাজেই জি. এন. ডেভি ভুল কথা বলছেন না। প্রতিটি মাতৃভাষাই এখন বিপন্ন।
এই বিপদ থেকে পরিত্রাণের পথ কী?
ভাষাতাত্ত্বিকরা বলছেন যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যে-ভাষা ব্যবহার করবে, তাতে কোনও একটি অঞ্চলের ভাষা, বা উচ্চবিত্তর ভাষা বা পুরুষের ভাষার প্রতি পক্ষপাত দেখানো যাবে না। এই ভাষাকে করে তুলতে হবে যতখানি সম্ভব পক্ষপাতহীন, অর্থাৎ নিখুঁতভাবে মান্য ভাষা। কঠিন কাজ। কিন্তু সদিচ্ছা থাকলে এই কাজ করে ওঠা সম্ভব। আর তা না করা গেলে একদিন হয়তো শামসুর রহমানের কথাই সত্যি হয়ে উঠবে। কেউ কেউ বলে উঠবেন, ‘তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো,/ বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা।’
পুনশ্চ: এআইয়ের ভাষা-কেরদানি নিয়ে এক বন্ধু একখানি গল্প শোনাল কয়েক দিন আগে। তার বাড়িতে ইন্টারনেট পরিষেবা সরবরাহ করে যে-সংস্থা, সেখানে যখন কেউ ‘কমপ্লেন’ ঠোকে, তখন বিভিন্ন ভারতীয় ‘নাম’ (কখনও ‘দিব্যা’, কখনও ‘সুরেশ’) ধার করে যোগাযোগ চালিয়ে যায় মূলত ‘এআই বট’। সে জানতে চায়, বুঝতে চায়, উপভোক্তার কী ধরনের সমস্যা হচ্ছে। চ্যাট করার সময় এআই বট-কে মন্দ পরিষেবার যুক্তিতে চেপে ধরলে, প্রায় দেখা যায়, সে ‘অপশন’ দিচ্ছে উপভোক্তাকে। মানে, ক্যাটেগরিতে ফেলে বলতে বলছে ঠিক সমস্যা। আর, তাতেও কাজ না হলে ‘এআই বট’ স্পষ্ট করে জানাতে দ্বিধা করছে না– ‘তবে টিক দিন যে, আপনার সমস্যার কথা এই লিস্টে থাকা সমস্যার মধ্যে পড়ে না।’ এবার মানুষ উপভোক্তা এআই বট-কে কী বলবে, সেটা তার ব্যাপার। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মান্য-ছঁাচের ভাষাকে সংবেদনশীল ও কাজের ও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠতে গেলে যে অনেকখানি ধেঁায়াশামাখা পথ পেরতে হবে, সন্দেহ নেই তাতে।
(মতামত নিজস্ব)
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.