জীবন আকস্মিকভাবে আমাকে ঠেলে দিয়েছিল বাচ্চাদের পড়াশোনার জগতে। না হলে বুঝতেই পারতাম না, মেধা নয়, সমস্যার শিকড় সিস্টেমে। হয় শ্রীনগর, না হয় দিল্লি থেকে লাদাখে বইপত্তর আসে। এত উচ্চতায় কোনও বাচ্চা জীবনে এলিফ্যান্ট, ফ্রগ, বা জিরাফ দেখেনি। বইয়ে যখন দেখল, ওদের তো মাথাতে ঢুকছে না। বুঝলাম– নির্ভর করতে হবে স্থানীয় ভাষা ও স্থানীয় দৃষ্টান্তে। জানালেন সোনাম ওয়াংচুক। সহলেখক সোমনাথ রায়।
আমি রাজনীতির লোক নই। রাজনীতিতে তাই আসছি না। জীবনে চলার পথে এত বাঁক এসেছে যে সত্যিই আগে থেকে কিছু বলা মুশকিল। তবু এটাই আপাতত মনের কথা।
জীবনে প্রথম বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিলাম ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে সুযোগ পাওয়ার পর। বাবা ভেবেছিলেন– সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ব। আর, আমি চেয়েছিলাম মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে। বাড়িতে কী যে অশান্তি সে নিয়ে! ভেবেছিলাম, কয়েক দিন রাগারাগির পর বাবা হয়তো মেনে নেবেন। কিন্তু অনেক করেও ভবি ভুলল না। বরং বাবা আমাকে দু’টি অপশন দিলেন।
এক, সিভিল পড়া। সেক্ষেত্রে এত দিন যেমন চলছিল, তখনও চলত তেমনটাই। মানে, পড়াশোনা থেকে শুরু করে অন্যান্য যাবতীয় খরচ দেবেন বাবা। দুই, মেকানিক্যাল। যেহেতু ওতে বাবার মত ছিল না, তাই বাবার ফান্ডও থাকবে না। অর্থাৎ যা করার, তা করতে হবে নিজের গাঁটের কড়ি খসিয়ে।
আমি তখন ১৮। ভাবলাম– এই সুযোগে সাবালক জীবনের প্রথম স্বাধীন সিদ্ধান্তটা নিয়েই নিই। বাবাকে প্রণাম করে বলেছিলাম, ‘নিজের স্বপ্নই পূরণ করতে চাই। সঙ্গে পালন করব তোমার আদেশও।’ সেই শুরু আমার শিক্ষকতা-জীবন। বাচ্চাদের পড়ানো শুরু করলাম। তবে চেনা পুঁথিগত স্টাইলে নয়। ওদের বুঝতে যাতে সমস্যা না হয়, তাই একটু অন্যভাবে পড়াতে থাকলাম। ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে আমিও ফল পেতে শুরু করলাম হাতেনাতে। ওরা ক্লাসে ইউনিট টেস্টে ভাল রেজাল্ট করে তাক লাগিয়ে দিতে থাকল। আমার কাছে আসতে থাকল প্রচুর ছাত্র-ছাত্রী। হয়তো বিশ্বাস করবেন না, তবে বাবার আদেশ পালন করতে আমার খুব বেশি সময় লাগেনি। প্রথম ছ’-মাসের মধ্যেই ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পুরো খরচ তুলে ফেলেছিলাম।
এরপর শুরু হয় শিক্ষকতা-জীবনের দ্বিতীয় ইনিংস। সেদিন ছিল আমাদের কনভোকেশন। এক বন্ধু গ্রুপ ফোটোগ্রাফের পর বলেছিল, ‘সোনম, ভেবে দ্যাখ আমরা কতটা ভাগ্যবান! লাদাখের ৯৫ শতাংশ বাচ্চা যেখানে ম্যাট্রিক-ই পাস করতে পারে না, সেখানে আমরা ইঞ্জিনিয়ার হয়ে গেলাম।’ কথাগুলো এখনও আমার কানে বাজে। নিজেকে নিজে প্রশ্ন করেছিলাম, আমার কাছে যে-বাচ্চাগুলো পড়ে, তারা তো ভাল রেজাল্টই করছিল। তাহলে বাকিদের কেন হচ্ছে না?
কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করে বুঝলাম, বাচ্চাগুলো নয়। ‘ফেল’ করছিল আসলে আমাদের সিস্টেম। ব্যস, নিজেকে নতুন চ্যালেঞ্জ দিয়ে দিলাম সেই সময়। ঠিক করেছিলাম, একজন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার যদি কম কাজ করে, তাহলে লাদাখের তেমন কোনও ক্ষতি হবে না। কিন্তু যদি কোনওভাবে সিস্টেমের ওই ব্যর্থতা ঠিক করতে পারি, তাহলে লাদাখের অনেক উপকার হতে পারে। চেনাশোনা কয়েকজনকে নিয়ে একটা টিম তৈরি করে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে গেলাম। তাদের বোঝালাম– আমাদের পরিকল্পনা।
ওরাও দেখল যে, আমাদের প্ল্যান যদি ঠিকভাবে কাজ করে, তবে ওদেরও লাভ। মাঠে নেমে কারা কাজ করছে, অত কিছু গ্রামগঞ্জের ওই গরিবগুব্বো মানুষরা বুঝবে না। লাভ হবে সরকারের। মানুষ ভাববে, জানবে পুরোটাই হয়েছে সরকারি উদ্যোগে। ওদের থেকে সাহায্যের আশ্বাস পেয়ে তৈরি করলাম ‘স্টুডেন্টস এডুকেশনাল অ্যান্ড কালচারাল মুভমেন্ট অফ লাদাখ’ বা ‘সেকমোল’। শুরু করলাম স্কুলে-স্কুলে যাওয়া। বাচ্চা, শিক্ষক, অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে সমীক্ষা করলাম। আমাদের সেই অ্যাক্টিভিটি-র নাম ছিল ‘অপারেশন নিউ হোপ’।
গলদ যে গোড়ায়, বুঝতে বেশি সময় লাগেনি। এখানে বাচ্চারা যে বই পড়ে তা তো আসে হয় শ্রীনগর, না হয় দিল্লি থেকে। ধরুন ‘এ ফর অ্যাপল…’। ‘বি ফর বল…’। আচ্ছা বলুন তো, আমাদের এই এত উঁচুতে কোনও বাচ্চা জীবনে এলিফ্যান্ট, ফ্রগ বা জিরাফ কি দেখেছে? ওদের মাথাতেই তো ঢুকছিল না যে, এগুলো খায় না মাথায় দেয়? পুরোটাই তো গিলতে হচ্ছিল। ঠিক করেছিলাম স্থানীয় ভাষায়, স্থানীয় জিনিস ব্যবহার করে, ওদের মতো করে, সহজভাবে নতুন বই লেখার কাজ শুরু করব।
কয়েক মাসের মধ্যে সেই কাজ শেষ করে ফেলেছিলাম। ফলও এসেছিল হাতেনাতে। ৭ বছরের মধ্যে পাসের হার বেড়ে ৫ থেকে হয় ৫৫ শতাংশ। এখন ৮০ শতাংশর বেশি। এখানেই অবশ্য একটু জিরিয়ে নিতে পারতাম। কিন্তু বাকি ২০ শতাংশও কেন পাস করতে পারছে না? সেই উত্তর পাচ্ছিলাম না। তাহলে কি আমাদের কাজ এখনও পুরোপুরি সার্থক হয়ে উঠল না? তখনই তৈরি করেছিলাম ‘সেকমোল ক্যাম্পাস’।
এখানে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা কী জানেন? প্রথমত, লাদাখি হতে হবে। কিছু মনে করবেন না, এই বিষয়ে আমি একটু প্রাদেশিক। লাদাখের কাজ ১০০% করে ফেলার পর বাকিদের নিয়েও লাগব। আর দ্বিতীয়ত, দশম শ্রেণিতে ফেল করা বা কোনও ড্রপ আউট ছাত্র-ছাত্রীই শুধু ভর্তি হতে পারে সেকমোল ক্যাম্পাসে। কারণ, আমার ‘টিজি’ (টার্গেট গ্রুপ) তো পাস করতে না-পারা ওই বাচ্চারা, যাদের সমাজ দুচ্ছাই করে। বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, তবু বলছি, চারবার-পঁাচবার ম্যাট্রিকে ফেল করার পর আমার ক্যাম্পাস থেকে পড়াশুনা করে কেউ লাদাখ অটোনমাস হিল ডেভলপমেন্ট কাউন্সিলের শিক্ষাবিভাগে এগজিউটিভ কাউন্সিলর হয়েছে, কেউ আবার আন্তর্জাতিক ফিল্ম মেকার। এসবই আমার প্রাপ্তি, শান্তির জায়গা।
একের পর এক হার্ডল টপকে-টপকে এখানে এসে পৌঁছেছি। বছর পঁাচেক আগে আপনার সঙ্গে যখন সেকমোল ক্যাম্পাসে দেখা হয়েছিল, তখন বলেছিলাম, লাদাখের মানুষের ক্ষোভের কথা, যা কোনও রাজনৈতিক দলই পূর্ণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে করে না। তার কয়েক মাসের মধ্যে লাদাখবাসীর সেই দীর্ঘ দিনের দাবি স্বীকৃতি পায়। সেই সময় সারা লাদাখ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, আমাদের বর্তমান সাংসদ জাময়াং শেরিং নামগ্যাল-কে নতমস্তকে প্রণাম জানিয়েছে। কিন্তু তারপর? চার-চারটে বছর অতিক্রান্ত। এখনও পর্যন্ত না আমাদের ষষ্ঠ তফশিলের অন্তর্গত করা হল, না স্বাধীন রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া হল। প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে এতগুলো বছর কি কম সময়?
আমাদের যাবতীয় ধোঁয়াশা কেটে গেল ৪ মার্চের মিটিংয়ে। সেদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবনে অ্যাপেক্স বডি লেহ এবং কারগিল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্সের বৈঠকে আমরা ইঙ্গিত পেয়ে যাই যে, এখনই ষষ্ঠ তফশিলের অন্তর্গত আমাদের করা হচ্ছে না। পূর্ণ রাজ্য? সে-ও বহু দূর। আর কোনও উপায় না-পেয়ে তাই আমাদের বেছে নিতে হয় আন্দোলনের পথ।
শুরু থেকেই ঠিক ছিল কোনও ঝগড়া, অশান্তি নয়। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করব। আর, শান্তিপূর্ণ আন্দোলন বলতেই তো প্রথমেই মাথায় আসে মহাত্মা গান্ধীর কথা। উনি বারবার অনশন করে ব্রিটিশ-ভিত নড়িয়ে দিয়েছিলেন। আমরা পারব না? গান্ধীজির সেই অনশন-ব্রহ্মাস্ত্রের সবথেকে বড় মেয়াদ ছিল ২১ দিন। তাই ঠিক করি ২১ দিন অনশনে বসব।
জিজ্ঞেস করতেই পারেন, এই আন্দোলনকে কেন ‘ক্লাইমেট ফাস্ট’ নামকরণ করেছি। আসলে, যেদিন থেকে আমরা আলাদা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হয়েছি, সেদিন থেকে বিলোপ হয়েছে ৩৭০ ধারা। ফলে এখন অনায়াসেই ‘বহিরাগত’-রা এখানে জমি কিনতে পারেন। শিল্প করতে পারেন। সেই কাজেই দেখা যাচ্ছে, লাদাখে এমন-এমন শিল্প করার প্রস্তাব আসছে, যার জেরে মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যাবে আমাদের আবহাওয়া, জলবায়ু, প্রকৃতির। আমাদের মাতৃভূমির। জীবনযাত্রা দু’ভাবে পরিকল্পনা করা যেতে পারে। এক, কীভাবে স্বাচ্ছন্দ্যে বঁাচতে পারি। দুই, কীভাবে পরবর্তী প্রজন্ম সুস্থ, স্বাভাবিক জীবন কাটাতে পারে, তা ঠিক করা। এই কারণেই জল, পেট্রোল-সহ অন্যান্য যা কিছু আমরা অপচয় করি, সেগুলো কমানো উচিত।
তেমনই লাদাখে যদি বড়-বড় শিল্প গড়ে ওঠে, তবে আমাদের প্রজন্মের হয়তো অনেক কর্মসংস্থান হবে। উপার্জন বাড়বে। লাদাখের অর্থনীতির উন্নয়ন হবে। কিন্তু মারা পড়বে আমাদের উত্তরপ্রজন্ম। মনে রাখতে হবে, লাদাখ কিন্তু কলকাতা, দিল্লি, মুম্বই বা চেন্নাই নয়। এখানের প্রকৃতি অনেক সংবেদনশীল। বুঝতে হবে, লাদাখের সমস্যার সমাধান করতে পারে স্থানীয়রাই। কোথায় কোন শিল্প হলে সামাজিক, অর্থনৈতিক উন্নতি হবে, কীসে ক্ষতি হবে, তা সবথেকে ভাল বুঝতে পারবে লাদাখিরাই। এর জন্যই দরকার ষষ্ঠ তফশিল। যেখানে স্থানীয়রা দায়িত্বে থেকে সাজাবেন লাদাখের বর্তমান। ঠিক করবেন, কী হবে আমাদের মাতৃভূমির ভবিষ্যৎ। কেন্দ্রীয় সরকারকেও বুঝতে হবে, আমরা কী বলছি; কেন বলছি। তার জন্য আমাদের আওয়াজ আরও উঁচুতে তুলতে হবে। কিন্তু নম্রভাবে। এটাই আমাদের লক্ষ্য। আমার লক্ষ্য। না, এর মধ্যে কোনও রাজনীতি নেই।
অনেকেই বলছেন, ভারতীয় পরিকাঠামোয় রাজনীতির বাইরে থেকে নিজেদের হক আদায় করা মুশকিল। ঠিক। মুশকিল। কিন্তু অসম্ভব কি? সেই অসম্ভবকে সম্ভব করতে আমার অন্তত রাজনীতিতে আসার দরকার নেই। শিক্ষকতা করাই আমার অভ্যাস। নেশা। ভালবাসা। রাজনীতি নয়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.