‘সোর্স’ জানাতে সাংবাদিক বাধ্য নন। তবে আধুনিক সাংবাদিকতায় একটা প্রশ্ন অবশ্য অনেকেই তুলছেন যে, সোর্সভিত্তিক সাংবাদিকতার কি দিন ফুরিয়েছে? এখন অনেক বেশি গবেষণানির্ভর সাংবাদিকতা হয়। এটা যুগের সমস্যা। এখন সাংবাদিকরাও মেরুকরণের শিকার। সোর্সকে বাঁচাতে গেলেই একটা পক্ষ নিতে হচ্ছে সাংবাদিকদের। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল
সুপ্রিম কোর্ট সম্প্রতি জানিয়েছে, সাংবাদিকের ‘সোর্স’ অর্থাৎ সংবাদের উৎস জানানো কখনওই বাধ্যতামূলক হতে পারে না। অর্থাৎ, খবরের সোর্স যদি সাংবাদিককে জানাতে হয় বা জানাতে বাধ্য করা হয়, সেক্ষেত্রে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে সমস্যা উপস্থিত হবে। এরপর সেই ‘সোর্স’ সাংবাদিককে তথ্য জানাতে অসম্মত হতে পারে। তাতে সাংবাদিকদের কাজের ক্ষতি। ‘সোর্স’ জানাতে বাধ্য করা সাংবাদিকের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার শামিল।
এটা ঐতিহাসিক ঘোষণা। এই ‘রায়’ এই সময়ের ভারতীয় সাংবাদিকতার জগতে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে খুব স্পষ্ট ভাষায় ‘freedom of the press’-এর কথা লেখা রয়েছে। ভারতের সংবিধানে আলাদা করে সাংবাদিক বা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা উল্লেখিত না থাকলেও সংবিধানে উল্লিখিত মৌলিক অধিকার বা নাগরিক অধিকারের আওতাতেই সাংবাদিকের অধিকারও আছে। কিন্তু সাংবাদিকদের স্বাধীনতা এবং সোর্সকে রক্ষা করার অধিকার এখন রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে নানা ক্ষেত্রে, নানা রাজ্যে কার্যত বিলুপ্ত হতে বসেছে। সাংবাদিকতার ধারাটাই কেমন বদলে যাচ্ছে। সূত্রের প্রয়োজনীয়তা হাজার টুইট, ফেসবুক পেজ, সোশ্যাল মিডিয়া সত্ত্বেও থেকে যাবে। তা না হলে ‘ইনভেস্টিগেটভ জার্নালিজম’ নামক বিষয়টাই অবলুপ্ত হবে যে!
তবে, এটা ঠিক যে, ভারতীয় সাংবাদিকতাও একটা রূপান্তর পর্বের মধ্যে রয়েছে। সুতরাং, ‘চরৈবেতি, চরৈবেতি’ করতে করতে সাংবাদিকতা এগবে- এটুকু আশা করি। নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে রয়েছে সাংবাদিকতার ক্ষেত্র। মাঝে মাঝে মনে হয়, ‘জার্নালিজম ইজ ডেড’। কিন্তু সেই অবিচুয়ারি লেখার আগে এ-ও মনে হয়, ভারতের শত শত, হাজার হাজার সংবাদ-কর্মী লড়াই চালাচ্ছে একত্রে, সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে নতুন প্রজন্ম আসছে এই ক্ষেত্রে, মাস কমিউনিকেশন পড়ছে কত ছেলে-মেয়ে, কত চ্যানেল তৈরি হচ্ছে, কত নতুন সংবাদমাধ্যম আসছে- আর এভাবেই সাংবাদিকতার নিত্যং নব ধারা তৈরি হচ্ছে। এককথায়, নেতিবাচক টিপ্পনী দিয়ে উপসংহার টানার সময় এখনও আসেনি।
বরং ‘সোর্স’ নামক বিষয়টা নিয়ে আসুন কিছু গপ্পো শোনাই। এক গোয়েন্দা অফিসারের কাছ থেকে শোনা গল্প। জার্মানিতে কোনও এক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হল। পুলিশ জার্মানির সেই সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করল। তাঁকে আদালতে পেশ করা হল। সেই সাংবাদিক সন্ত্রাসবাদীদের নিয়ে কিছু খবর লিখেছিলেন। তা প্রকাশিতও হয়েছে। সেসব কাগজের কাটিং দেখিয়ে আইনজীবী বললেন, মহামান্য ধর্মাবতার, এই সাংবাদিক সমস্ত গোপন নিরাপত্তা-সংক্রান্ত তথ্য ফাঁস করে দিয়েছেন। ডিফেন্স সিক্রেসি পর্যন্ত আর রইল না দেশের! সুতরাং, এই সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করাটা খুব জরুরি।
তারপর শুনানিতে সাংবাদিককে যখন ডাকা হল, তিনি প্রকাশিত সমস্ত খবরের ‘সূত্র’ হিসাবে বিভিন্ন প্রকাশিত রিপোর্ট, নথি, সংবাদপত্রের কাটিং ফোটোকপি করে মহামান্য আদালতের কাছে পেশ করলেন। তিনি বললেন, আমি যা লিখেছি, তা কোনওটাই অপ্রকাশিত তথ্য নয়, সবটাই প্রকাশিত। অর্থাৎ সেই সাংবাদিকের প্রতিবেদনের বিভিন্ন ধরনের ইনপুট বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল, এখন আমরা যেমন ‘উইকিপিডিয়া’ বা ‘গুগ্ল’ থেকে পাই। সেসব সংগৃহীত তথ্যগুলির সমন্বয় সাধন করে একটা দৃষ্টিকোণ দিয়ে সেগুলোকে তিনি লিপিবদ্ধ করেছিলেন মাত্র। সুতরাং, সেগুলো কোনওটাই ‘ক্লাসিফায়েড ডকুমেন্ট’ নয়, প্রকাশিত ডকুমেন্ট।
এই গল্পটা বলে সেই গোয়েন্দা অফিসার আমাকে বলেছিলেন, আসলে মন দিয়ে খবরের কাগজ পড়া বা প্রকাশিত তথ্য, সংসদের রিপোর্ট, এমনকী, প্রেস বিবৃতি পর্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লাইন বাই লাইন পড়ার একটা ট্রেনিং গোয়েন্দা-কর্মীদের দেওয়া হয়। অর্থাৎ, মনোযোগ দিয়ে পড়লে, বুঝলে এবং তারপর বিভিন্ন সোর্সের সঙ্গে কথা বললে অনেক সময় নতুন নতুন তথ্য বেরিয়ে আসতে পারে। প্রেক্ষাপট ব্যতীত তথ্য অনেক সময়ই কাজে লাগে না।
‘সোর্স’ যেমন প্রতিষ্ঠান হতে পারে, ‘সোর্স’ ব্যক্তিও হতে পারে। তবে আধুনিক সাংবাদিকতায় একটা প্রশ্ন অবশ্য অনেকে তুলছেন যে, ‘source-driven journalism’-এর কি দিন ফুরিয়েছে? এখন অনেক বেশি গবেষণানির্ভর সাংবাদিকতা হয়। রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী, কূটনীতিক, আমলাকে সোর্স হিসাবে ব্যবহার করার কালচারটা কি শেষ হয়ে যাচ্ছে? আধুনিক প্রজন্মের অনেক সাংবাদিক বলেন যে, সোর্স-ড্রিভেন সাংবাদিকতায় সোর্সকে বাঁচাতে হয়। অনেক সময় সেই সোর্স যদি খুব গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতা বা নেত্রী হন, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে তো কিছু লেখাই যায় না। সোর্সকে বাঁচানোর জন্য, অথবা সোর্স যাতে ড্রাই না হয়ে যায়, সেজন্য সোর্সকে কখনও আঘাত করা যায় না। অনেক সময় কম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সোর্স হলে সুবিধা হয়। অর্থাৎ, বামফ্রন্টের মিটিং ‘কভার’ করতে গেলে আরএসপি কিংবা মার্কসবাদী ফরওয়ার্ড ব্লকের কোনও সদস্য আমাদের কাছে জ্যোতিবাবুর থেকে অনেক বেশি বাঞ্ছনীয় ‘সোর্স’ হতেন।
সোর্স যদি খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হন, তাহলে তাঁকে গোপন রাখাটা সবচেয়ে বেশি জরুরি, যা হালফিলের সাংবাদিকতার একটা মস্ত বড় সমস্যা। এটা যুগের সমস্যা। এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে এই আধুনিক রাজনৈতিক নেতাদের নানা কায়দার জন্যই সেটা হচ্ছে। সাংবাদিকরা একটা মেরুকরণের শিকার হচ্ছেন। একদা আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বুশ সাহেব যেমন এক সাংবাদিককে বলেছিলেন যে, তুমি কোনদিকে? আমার দিকে, না ওদের দিকে? এই যে তীব্র ‘either-or’, এই ‘আমরা-ওরা’-র বিভাজন আগে সাংবাদিকতায় ছিল না। ইদানীং, সাংবাদিকদের প্রথমেই একটা জার্সি গায়ে দিতে হয়। অর্থাৎ, তুমি বিজেপি, কংগ্রেস, সিপিএম বা তৃণমূল- কিছু একটা হবেই। আমি বলি যে, আমি কোনও রাজনৈতিক দলেরই পৃষ্ঠপোষক নই, আমার গায়ে কোনও জার্সি নেই, আমি ভারতের মিডিয়ার প্রতিনিধি। যখন কেউ কোনও প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে, তিনি তখন সেই প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী। আর, যখন কোনও সাংবাদিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত নন, তখন তিনি ফ্রি মিডিয়ার প্রতিনিধি।
বাংলাদেশে গিয়েছি। বিএসএফের এক কর্মী একটি মেয়েকে সীমান্তে অত্যাচার করে তার মরদেহ ঝুলিয়ে দিয়েছিল। এই ঘটনার ছবি তুলে সেটাকে প্রকাশ করা হয়েছিল। আর বলা হয়েছিল, এটা করা হয়েছে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ এভাবে অনুপ্রবেশ করতে না পারে। সেই নিয়ে মানবাধিকার কমিশনে পর্যন্ত হইচই পড়ে গিয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা কার্যত আমাকে ঘেরাও করে ফেলেছিল। তখন আমি কিন্তু তাদের বলেছিলাম, তোমরা যেভাবে এই নিগ্রহের নিন্দা করছ, আমিও একইভাবে তার নিন্দা করছি। কেননা, আমি ভারত থেকে এলেও ভারত সরকারের প্রতিনিধি নই। আমি কিন্তু ভারতের ফ্রি মিডিয়ার প্রতিনিধি। কাশ্মীরে সেনাবাহিনী মানবাধিকার লঙ্ঘন করলে আমরা তার নিন্দা করি। সেখানে বিএসএফ তো আধা-সামরিক বাহিনী। সুতরাং, এখানেও জার্সি পরার একটা সমস্যা এসে যাচ্ছে। কোনও না কোনও দলের হয়ে আমাকে কথা বলতেই হবে- এর কোনও মানে নেই। আমি ইস্যুভিত্তিক কথা বলতেই পারি। কিছুদিন আগে কোনও এক সাংবাদিক আমাকে বলেছেন যে, আমি সবার সঙ্গে ভাল সম্পর্ক রাখতে চাই। সব দলের সব নেতার সঙ্গে। আর, সেটা নিয়ে টিপ্পনীও কেটেছেন। কিন্তু আমার মনে হয়েছে যে, সেটাই তো স্বাভাবিক ঘটনা!
বেশ কয়েক বছর আগে একটি চ্যানেলে অর্ণব গোস্বামীর এক বিতর্ক অনুষ্ঠানে হাজির ছিলাম। সেখানে অর্ণব আমাকে বলেছিলেন যে, জয়ন্তদা, তুমি কোনও সাইড নিচ্ছ না। কোনও পক্ষ নিচ্ছ না। আমি বলেছিলাম, এখানে ডেরেক ও’ব্রায়েন আছেন, তিনি তৃণমূলের প্রতিনিধিত্ব করছেন। মহম্মদ সেলিম সিপিএমের প্রতিনিধিত্ব করছেন। আমি তো একজন সাংবাদিক। আমি তো আমার মতো করে বিষয়টা বলব। আমার তো কোনও রাজনৈতিক দলের পক্ষে বা বিপক্ষে বলার কথাই নয়। তখন যেটা আমি বুঝেছিলাম, এই ধরনের টিভি চ্যানেলে সবসময়ই একটা পক্ষ-বিপক্ষের দরকার হয় ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য। বিতর্কটা জমানোর জন্য। কিন্তু আমার কথা হচ্ছে যে, এটা তো কোনও কলেজের বিতর্ক নয়। কিন্তু ইদানীং সাংবাদিকতা একটা ইভেন্টের মতো হয়ে যাচ্ছে। যেখানে আগে ঠিক করে নিতে হয়, কে কোন পক্ষে থাকব। কিন্তু সাংবাদিকতাটা তো ঠিক এমন হওয়ার কথা ছিল না!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.