শেষ পঁাচটা বছর কী কঠিনই না গিয়েছে ভারতবাসীর– অতিমারী, লকডাউন, মূল্যবৃদ্ধি, ছঁাটাই, আয় হ্রাস! এসব পেরিয়ে ক’জন ভোটার আছে এমন, যারা খুশিমনে ভোট দিতে আসবে? কে জিতল বা হারল, তা নিয়ে ভোটাররা উদাসীন? লিখলেন রাজদীপ সরদেশাই।
দুটো রাউন্ড শেষ। আরও পঁাচটা বাকি। সাধারণ নির্বাচনের এই মরশুম, উপর্যুপরি এই ঝঁা ঝঁা গরম হাওয়ার স্রোতে বড়সড় একটা প্রশ্ন ভেসে বেড়াচ্ছে– টিভি স্টুডিও এবং তার বাইরের পরিসর জুড়ে এত যে অবিরাম ঢাকঢোল বাজল গণতন্ত্রের ‘উৎসব’ নিয়ে, তা সেখানে অংশগ্রহণের হার, অর্থাৎ ভোটদানের হার এত কম কেন? দেশজুড়ে এটাই প্রবণতা। তা, এমন দাবদাহ, তার সঙ্গে চাষবাসের সময়, আর দীর্ঘ সাপ্তাহিক ছুটি– এসবের অজুহাতে আংশিকভাবে ভোটাভুটির হ্রাসকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। কিন্তু, প্রকৃত সত্য হল, দেশের সিংহভাগেই গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক প্রবণতার ব্যাপক ঘাটতি! কাকে বাছব, কীই বা তফাত? অধিকাংশ ভোটারের মনই হয়ে গিয়েছে তেতো, যার ফলে ভোটদানের প্রতি তাদের এই উদাসীনতা।
ভোট শুরুর আগে, বিজেপি জয়ের নিনাদ ছাড়ছিল ‘অব কি বার, চারশো পার’; যেন ভোট হয়েই গিয়েছে, এখন কেবল দেখার পালা– প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রাজীব গান্ধীর ১৯৮৪-তে ৪১৪টা লোকসভা আসন জিতে প্রধানমন্ত্রিত্বের পদে আসার রেকর্ড ভাঙতে পারলেন কি না। এখন, যত দিন যাচ্ছে, দেখা যাচ্ছে, উভয় তরফেই বাস্তবের ছবি অনেকটাই আলাদা। রাজে্য রাজে্য ভোটাভুটির হাওয়া প্রায়-স্তিমিত।
যা থেকে আন্দাজ পাওয়া যাবে, কেন, প্রথম ভোটপর্বে সমগ্র দেশে মাত্র ৩ শতাংশ গড়ে ভোট পড়েছে দেখে, পরের দিন থেকেই নরেন্দ্র মোদি তঁার ভাষণে একেবারে নিলাজ সাম্প্রদায়িক আখ্যান টানতে শুরু করলেন। ২০৪৭-এর মধে্য ‘বিকশিত ভারত’-এর প্রতিশ্রুতি নিয়ে নির্বাচনী প্রচার শুরু হলেও, অতর্কিতে প্রচারের ভঙ্গিমা আশার রাজনীতি থেকে ভয়ের রাজনীতিতে ভোল বদলাল। ঘটনাচক্রে, ভয় এবং আশা– খুব অস্বস্তিকর, কিন্তু পিঠোপিঠি দুই বন্ধু। ভয় খুব ক্ষতিকারক বস্তু, ধ্বংসাত্মক তার চরিত্র, উল্টোদিকে আশা বড়ই সদর্থক এবং সৃষ্টির খাসতালুক। ২০২৪-এর সাধারণ নির্বাচন আশার বাণী দিয়ে শুরু হলেও, হুড়মুড়িয়ে তা অবনমিত হল ভয়ের বাতাবরণে, লাজলজ্জাহীন হয়ে ছড়াতে শুরু করল অর্ধসত্য এবং মিথ্যাচার।
রাজস্থানে, জনতাকে খেপিয়ে তোলার মতো আগুন-ঝরানো ভাষণে নরেন্দ্র মোদি (PM Modi) যখন কংগ্রেসের (Congress) ‘ন্যায়’ ইস্তাহারকে মুসলিম লিগের ইস্তাহারের সঙ্গে তুলনা করলেন, ব্যক্তিগত ধন-সম্পত্তি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের ‘ঘুসপেটিয়া’ কিংবা অনুপ্রবেশকারীদের হাতে চলে যাওয়ার ভয় দেখালেন, এমনকী, মঙ্গলসূত্র ছিনতাই হওয়ার আখ্যান জুড়লেন, তঁার রাজনৈতিক কৌশলের হঁাড়ি একেবারে হাটে ভাঙল। উদ্দেশ্য স্পষ্ট– পার্টির নিগূঢ় হিন্দুত্ববাদী সমর্থক শ্রেণিকে পরিচিত এবং বানানো এক ‘শত্রু’ গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়া।
ভারতীয় মুসলিম সম্প্রদায় বরাবরই বিজেপি উত্থানের নেপথে্য অন্যতম নির্বাচনী তুরুপ হয়ে থেকেছে অপরায়নের আখ্যানে। গত শতকের নয়ের দশকের সময় তো রীতিমতো খুলে-আম মুসলিমদের ‘বাবর কা অওলাদ’ বলে ব্যঙ্গ করা হত, আর বর্তমানে সেই জায়গা দখল করেছে ‘ঘুসপেটিয়া’ তরজমা। বুঝতে অসুবিধা হয় না, বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদির ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’ আখ্যান আদপে বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতার খাতিরেই আওড়ানো।
বিজেপি যদি তাদের দীর্ঘস্থায়ী সাম্প্রদায়িক উসকানি পুনরুজ্জীবিত করে থাকে, কংগ্রেসও কাল্পনিক ভয়ের টোপ কিছু কম ফেলছে না। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী তঁার সমাবেশে সংবিধানের একটি অনুলিপি নাড়িয়ে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে, বিজেপি ক্ষমতায় এলে তারা দলিত, আদিবাসী এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি, অর্থাৎ ওবিসি-দের জন্য সংরক্ষণ তুলে দেওয়ার দিকে এগবে, আর সেভাবেই সংবিধানে সংশোধন আনবে। বিজেপি যদি উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক আবেগকে জাগিয়ে তুলতে প্রয়াসী হয়, কংগ্রেস সেখানে মণ্ডলীয় ‘সামাজিক ন্যায়বিচার’-এর ধুয়া তুলতে উদে্যাগী, গত তিন দশকে উত্তর ভারতে যা তাদের পতনের মূল সূত্র হয়ে থেকেছে।
এত সবকিছুর পরেও, মৌলিক অধিকারটুকু আদায়ে নাজেহাল গড় ভোটার, জড়ভরত হয়ে বসে আছে। দেশের যেখানেই যান না কেন, দেখা যাবে, নেতা এবং নাগরিকদের মধে্য সংযোগ প্রায় নামমাত্র। শেষ পঁাচটা বছর কী কঠিনই না গিয়েছে ভারতবাসীদের– অতিমারী, দীর্ঘ লকডাউন, মূল্যবৃদ্ধি, চাকরি ছঁাটাই, আয় হ্রাস আরও কত কী! এসব পেরিয়ে ক’জন ভোটার আছে এমন, যারা খুশিমনে ভোট দিতে আসবে? পঁাচতারা হোটেলের নৈশভোজে ‘রাইজিং ইন্ডিয়া’ নিয়ে আলোচনা হতে পারে বটে, কিন্তু ভারতের সিংহভাগ বাস্তব পড়ে রয়েছে ওই প্রান্তিক ভারতে। তীব্র গরমে ধুলিধূসরিত সেসব প্রান্তে, এমন অনেক জায়গা রয়েছে, যেখানে আট দিনে একদিন, জলের একটাই ট্যাঙ্কার আসে, আর বাড়িতে বাড়িতে কয়েক গামলা করে জল দিয়ে যায়। উত্তেজনাময় রাজনৈতিক বক্তৃতা এবং জীবনের অস্থির অস্তিত্বের মধ্যে এ-দেশে এত অমিল, যে, ভোট প্রক্রিয়ার প্রতি যদি উদাসীনতা না থাকে, তাহলে ঠিক আছে, নয়তো বেশিরভাগ ভোটারই অস্থিরচিত্ত হয়ে থাকবে। মহারাষ্ট্রই উত্তম উদাহরণ হতে পারে।
গত পঁাচ বছরে আর কোনও রাজে্য এত রাজনৈতিক টানাপোড়েন ঘটেনি। পঁাচ বছরের মধে্যই তিনজন মুখ্যমন্ত্রী, জোটের ভোলবদল, গোপনে অভিসন্ধি আর যোগসাজশ– রাজনীতি বলে কিছু নেই আর রাজ্যটায়। এমনকী, বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক কর্মীরাও এখন আর তেমন একটা নির্বাচনী ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত বলে দেখা যাচ্ছে না। কারণ, সেই ব্যবস্থা তো চলছে অনৈতিক, আদর্শগতভাবে দেউলিয়া একটা সিস্টেমের পরিচালনায়। যখন যে কোনও মূল্যে ক্ষমতার আসনে থাকতে ক্রমাগত নীতিহীন আপস করে যাচ্ছেন প্রধান নেতৃত্বরা, তখন কেন দলের অনুগত কর্মীরা পরিশ্রম করবে? ধরা যাক, এই কাল অবধি যারা প্রচণ্ড প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল, আজকেই তারা হয়ে যাচ্ছে প্রধান জোটসঙ্গী। প্রবল সুবিধাবাদের লোভে নির্লজ্জভাবে টাকার খেলা নিয়ে পুরনো রাজনৈতিক কর্মীরা তো রীতিমতো বীতশ্রদ্ধ!
যদিও রাজনীতিবিদদের সুচারুভাবে আখের গোছানো থামছে না। গড়ের চেয়েও কম বৃষ্টিপাতের কারণে চাষবাসের দুর্দশা ভয়ংকরভাবে অসম ও আধুনিক এক ‘ডিসটোপিয়া’ তৈরি করেছে– একদিকে মুম্বইয়ের অতি-ধনবানরা তাদের সুইমিং পুলের পাশে আম এবং ক্রিম নিয়ে মশগুল। অন্যদিকে, প্রত্যন্ত মহারাষ্ট্রে, ট্যাঙ্কার মাফিয়ারা বালতি পিছু ২০০ টাকায় জল বিক্রি করছে! কেন রাজ্যজুড়ে গ্রামীণ অঞ্চলে বেশিরভাগ ভোটারই অপূর্ণ প্রতিশ্রুতির কাছে বুঝভুম্বুল হয়ে আছে, তা বুঝতে আর অবাক লাগবে না। এমনকী, ‘মোদি কি গ্যারান্টি’ সংবলিত পোস্টারগুলি দেশের প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে রইলেও, তা মোটেও স্থানীয় বিরোধী মননকে শান্ত করার জন্য যথেষ্ট নয়। যে-কারণে, বিজেপি শতাধিক বর্তমান সাংসদকে পরিবর্তন করেছে চলতি ভোটের প্রার্থী বাছাইয়ে।
যে অব্যবহিত কারণে, আরেকটা বড় প্রশ্ন টোকা মারে– এহেন ক্লান্ত অবসন্ন ভোটার ও ভোটদানের চক্করে কার লাভ হবে, কারই বা লোকসান? বিজেপি তো স্বাভাবিকভাবেই আত্মবিশ্বাসী, তারাই হ্যাটট্রিক করবে জয়ের, কারণ তাদের প্রধান নেতৃত্ব নরেন্দ্র মোদির প্রতি মানুষের যা বিশ্বাস, তেমনটা আর কারও প্রতি নেই, আর তার সঙ্গে আছে তাদের সর্বগ্রাসী সংগঠন। কংগ্রেস ওদিকে হাপিতে্যশ আশায়, নিশ্চয়ই ভোটার করুণাঘন হয়ে, পরিবর্তনের দাবিতে কংগ্রেসকে ভোট দিয়ে অন্তত লড়াই করার সুযোগটুকু দেবে, একটা টক্কর অন্তত দেবে তারা। যদিও, ভারতীয় গণতন্ত্রর সংকট আদপে বিজেপি বনাম বিরোধী আখ্যান ছাড়িয়ে। আসল দুশ্চিন্তা হল, কে জিতল বা হারল, তা নিয়ে ভোটাররা উদাসীন হয়ে পড়ছে। ‘কী হবে ভোট দিয়ে?’– এই উদাসীনতার গতি ক্রমবর্ধমান। কিচ্ছুই যেন আর যায়-আসে না তাদের। ভোট দিলেন না যঁারা, তঁারা সম্ভবত এই বার্তাটাই দিতে চাইছেন– আমাদের হেয় করো না আর!
পুনশ্চ- সাম্প্রতিক একটি টুইটে, একজন দর্শক দারুণ এক মন্তব্য করেছেন– যখনই টেলিভিশনে কোনও রাজনীতিবিদের বাড়িতে গৃহীত সাক্ষাৎকার দেখা যায়, কী ঐশ্বর্য, কী প্রাচুর্য সেই বাড়িঘর জুড়ে! আর অন্যদিকে দেখুন, সাধারণ নাগরিক যখন ক্যামেরার সামনে তাদের যন্ত্রণা, ঝঞ্ঝাট, দাবির কথা বলছে, তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড হয়ে আছে দমবন্ধ ভিড় বাস, কিংবা শুকনো খটখটে জমি, টালির বাড়ি ইত্যাদি প্রভৃতি। এমন বৈষমে্যর মাঝে কে হবে সেতু? কে ঘোচাবে এই দূরত্ব?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.