ভারতের লোকসভা ভোটের ফলাফল, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে কৌতূহলী আবিশ্ব। বিজেপি প্রথম থেকেই ভেবেছে, ২০২৪ ভোট মানে মোদির ভোট। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে কেন এমন প্রচার, এমন ধারণা তৈরি হচ্ছে যে, বিজেপির সমর্থক সংখ্যা ক্রমশ কমছে! তিন দফা ভোটের পর গরিষ্ঠতার গ্যারান্টি-ই বা কেন উধাও? মোদির ফেরা নিয়ে কি শিল্পপতিরাও ধন্দে? লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল।
চারদিনের জন্য মাসকাট গিয়েছিলাম। রাষ্ট্রসংঘর উৎসাহে অায়োজিত এক আন্তর্জাতিক আলোচনা সভায় যোগ দিতে। বিষয়: প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের বিদেশনীতি। শুধু ভারতীয় নয়, সেখানে নানা দেশের মানুষ। মজার ব্যাপার হল, কূটনীতির আলোচনার মধে্য মাঝে-মাঝেই নানাভাবে এসে পড়ছিল ভারতের নির্বাচন ২০২৪-এর (Lok Sabha Election 2024) প্রসঙ্গ। কী হবে নরেন্দ্র মোদির (PM Modi)? আচ্ছা উনিই কি আবার ক্ষমতাসীন হবেন?
কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, কেন এমন প্রচার, এমন ধারণা তৈরি হচ্ছে যে, বিজেপির সমর্থক সংখ্যা নাকি ক্রমশ কমছে! তিন দফা ভোটের পর গরিষ্ঠতার গ্যারান্টি কেন উধাও? শেয়ার মার্কেটে এমন ধস নামছে কেন? মোদির ফেরা নিয়ে কি শিল্পপতিরাও ধন্দে? আবার দেশের ভোট ফলাফলের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে কৌতূহল কিছু কম নয়। লন্ডন থেকে যঁারা এসেছেন, তঁারা তো প্রতিনিধি দলে একমাত্র বাঙালিকে পেয়ে নানা প্রশ্নে জর্জরিত করে দিলেন। ২০১৯-এ বিজেপি পেয়েছিল ১৮। তাহলে এবার কি বিজেপির আসন পশ্চিমবঙ্গে বাড়বে না কমবে?
বুঝতে পারছিলাম, ওই আলোচনায় যোগ দেওয়া বহু মানুষই মোদিভক্ত। বিশ্বগুরুর ভারতের ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন। পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে কেন এত প্রশ্ন জানেন? কারণ, একটাই। ভারতের হিন্দি বলয়ে বা যেসব এলাকায় শক্তিশালী ভোট ব্যাঙ্ক আছে বিজেপির, সেসব ভোটকেন্দ্রে যদি গত দশ বছরে সামান্যতম অ্যান্টি-ইনকামবেন্সি হয়, তাহলে তো সংখ্যা কমতে বাধ্য। সে তো ল’ অফ নেচার। দিল্লিতে লোকসভা কেন্দ্র ৭টি। ‘মোদি ফ্যাক্টর’ যতই শক্তিশালী হোক, ৭-এর জায়গায় বিজেপির ৮টা আসন তো লাভ হতে পারে না। আর তাই দক্ষিণ ও পূর্ব ভারতের মতো নন-বেস এরিয়াতে বিজেপির আসন বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি। আর, এসব এলাকার মধে্য পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির কাছে প্রথম থেকেই তো অগ্রাধিকার।
২০১৯ সালে ৪২টির মধে্য ১৮টা আসন পেয়ে বিজেপির ক্ষুধা তো আরও বেড়ে গিয়েছে। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে আবার ক্ষমতায় এসেছেন মমতা বন্দে্যাপাধ্যায়। তবু বিজেপি রণে ভঙ্গ দেয়নি। শতকরা ভোটব্যাঙ্ক আছে অনেকটা তাই বিজেপির ২০২৪-এ বিশেষ আশা ছিল। বিশেষত, উত্তরবঙ্গে। তাছাড়া বিজেপি প্রথম থেকেই ভেবেছে, ২০২৪ লোকসভা ভোট মানে মোদির ভোট, অতএব মোদির প্রতি মানুষের প্রত্যাশা এখনও অনেক। জাতীয় স্তরে কোনও ‘বিকল্প’-ও নেই। আর তাই বিজেপি মনে করেছে, পশ্চিমবঙ্গ থেকে এবার আরও আসন আসবে। অমিত শাহ তো প্রথমে দলীয় বৈঠকে বাংলায় ৩০-৩৫টি আসন পাওয়ার কথা বলেছিলেন। তবে সেটা যুদ্ধের সময় একজন জেনারেলের প্রত্যাশা তৈরির বিবৃতি। যাতে দলীয় কর্মীদের মনোবল আরও বেড়ে যায়।
সমুদ্রতীরে জনমানবহীন ওমান দেশে বসে সবাইকে বলেছি, এখনও পশ্চিমবাংলায় চার কিস্তিতে ভোট বাকি। ভোটের রাজনীতিও কোনও স্থিতিশীল ধারণা নয় তা গতিশীল। স্বতঃ পরিবর্তনশীল। তবু বাংলায় এত দিন থাকলাম ভোটের সময়, শিকড় ও বাংলার হাওড়ায় বাংলার ভাল-মন্দর নাড়ির সঙ্গে আজীবন যুক্ত। বাংলার ভবিষ্যৎ বাঙালির ভবিষ্যৎ নিয়ে এখনই কোনও আলোচনা করছি না। সেটি একটি পৃথক বিষয়।
কিন্তু ভোটের রাজনীতির বিষয়ে বলতে পারি– বিজেপির পক্ষে এবার ১৮টি আসনও ধরে রাখা কঠিন। আসন সংখ্যা ১৮০ তলায় চলে গেলেও বিস্মিত হব না। জে্যাতিষী নই, পোলস্টারও নই। কিন্তু রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করে বলতে পারি, এ রাজে্য বিজেপির রামমন্দিরে রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠা কোনও বড় আবেগতাড়িত ইসু্য হয়নি। দ্বিতীয়ত, নাগরিকত্ব বিল হিন্দি বলয়ে কী প্রতিক্রিয়া হবে জানি না কিন্তু বাংলায় বিজেপির জন্য উল্টো হয়ে গেল। শতকরা ৩০ ভাগ মুসলমান সমাজ আরও বেশি করে তৃণমূলের ছাতার তলায় এসেছে। মুসলিম ভোট ভাঙার সম্ভাবনা এবার খুবই কম। এজন্য ২০১৯ এমনকী ২০২১-এও ‘ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট’ যতটা প্রাসঙ্গিক ছিল, এবার তা নয়। এবার তো আইএসএফের সঙ্গে সিপিএম নির্বাচনী জোট পর্যন্ত করেনি। তৃতীয়ত, উত্তরবঙ্গে বিজেপি পৃথক রাজ্যর দাবিতে সোচ্চার হয়নি দক্ষিণবঙ্গের ভোট হারানোর ভয়ে, ফলে উত্তরবঙ্গে আবার তৃণমূল গতবারের তুলনায় এবার ভাল ফল করছে। বিজেপি এমতাবস্থায় সন্দেশখালি ইসু্যকেও প্রধান প্রচারের বিষয় করে। কিন্তু তৃণমূলের আক্রমণাত্মক পাল্টা রণকৌশল বিজেপির কাছে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ছিল। সন্দেশখালির স্টিং অপারেশনে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে বিজেপি কীভাবে সন্দেশখালিতে গণধর্ষণের ‘প্লট’ তৈরি করেছিল। তৃণমূলের এই আক্রমণাত্মক রণকৌশলের প্রধান কারিগর অভিষেক বন্দে্যাপাধ্যায়।
নরেন্দ্র মোদি অবশ্য দুর্নীতিকেই প্রধান হাতিয়ার করতে চাইছেন। শিল্পক্ষেত্রে নিয়োগ দুর্নীতি বা রাজে্যর মন্ত্রীদের দুর্নীতিকেই প্রধান ইসু্য করতে চাইছেন। তৃণমূলের দুর্নীতি নিয়ে বাঙালির মধ্যবিত্ত সমাজে কোনও প্রতিক্রিয়া নেই এমনও নয়, কিন্তু সিবিআই, ইডি, আয়কর বিভাগ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে এ-কাজ করছে, বিজেপির খাতায় নাম লেখালে সব দোষ মাফ, এই ‘ওয়াশিং মেশিন’ তত্ত্বর ও পালটা প্রভাব জনমানসে নেই তা নয়। আরও একটা ব্যাপার: দিল্লির বিজেপি নেতারা এখন বলছেন যে, মোদির ব্র্যান্ড ইকুইটি এখনও শক্তিশালী, কিন্তু উত্তরপ্রদেশে তঁার বার্তা গ্রামে-গ্রামে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য যেমন যোগী আদিত্যনাথ আছেন, তেমনটা বাংলায় নেই। শুভেন্দু অধিকারী, সুকান্ত মজুমদার, দিলীপ ঘোষ পরিশ্রম কম করছেন না, কিন্তু এখনও জাতীয় স্তরে যেমন মোদির ‘বিকল্প’ মুখ নেই, তেমন রাজে্যও নেই মমতারও ‘বিকল্প’ মুখ।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.