Advertisement
Advertisement
Kamal Chakraborty

কমল, কলম, ক্যারিশমা

এক অনবদ্য কলম। অফুরান প্রাণশক্তি। অনন্য মানুষ।

Anupam Roy remembering Kamal Chakraborty
Published by: Biswadip Dey
  • Posted:September 1, 2024 10:29 am
  • Updated:September 1, 2024 10:29 am

‘১৮ বছর আগে পরিচয় হয়েছিল কমল চক্রবর্তীর সঙ্গে। আমার বাংলা লেখালিখির ধারণা তাঁর সংস্পর্শে এসে পালটে যেতে থাকে। এক অনবদ্য কলম। অফুরান প্রাণশক্তি। অনন্য মানুষ।’ লিখছেন অনুপম রায়

২০০৬-এর বেঙ্গালুরু। শমিত রায়ের বাড়ি। আমার হাতে তুলে দেওয়া হয় ‘কৌরব ১০২’। বাংলা সাহিত্য পত্রিকা। সেই এক পত্রিকার হাত ধরে আমার বহু মানুষের সঙ্গে আলাপ। শুধু আলাপ নয়, কেউ-কেউ হয়ে ওঠে আমার গুরু, আমার পরম বন্ধু, হিতাকাঙ্ক্ষী। আসলে, কমলদার কথা বলতে গেলে আমাকে ‘কৌরব’-এর কথা বলতেই হবে। ‘কৌরব ১০২’-এ প্রথম পড়ি কমলদার লেখা, ‘পাখি পুরাণ’। ভারি অবাক হই। মুক্তগদ্যর সঙ্গে প্রথম আলাপ হয়। ভালো লেগেছে জেনে, শমিতদা এর পর আমাকে ‘ব্রাহ্মণ নবাব’ পড়তে দেয়। তা পড়ে তো আমি দারুণ উৎসাহিত। আরও খুঁজতে খুঁজতে ‘ব্রহ্মভার্গব পুরাণ’ পেয়ে যাই। মুগ্ধ হই। উৎসাহ বাড়তেই থাকে।

Advertisement

এর পর ২০১০-এ, ‘কৌরব ১১০’-এ আমার নিজের মুক্তগদ্য ছাপা হয়– ‘আমাদের বেঁচে থাকা’। দারুণ ভালো লাগে। একই সঙ্গে ২০১০-এর পুজোয়, আমার গান এবং আমি একসঙ্গে বিখ্যাত হই। হঠাৎই একদিন ফোন আসে কমলদার। এই প্রথম কথা। ফোনে শুনতে পাই– ‘জয় বৃক্ষনাথ’! কমলদা ফোন করে ‘হ্যালো’ বলতেন না, যঁারা ওঁর সঙ্গে কথা বলেছেন জানেন। বেশ কিছুক্ষণ কথা হয়। আলাপচারিতার সারমর্ম– কমলদার এক বন্ধু জানিয়েছিলেন, যে অনুপম রায় (Anupam Roy) ‘বিখ্যাত’ হয়েছে, তার লেখাই ‘কৌরব’-এ ছাপা হয়েছে।

‘বৃক্ষমানব’ কমল চক্রবর্তী। ছবি: সংগৃহীত।

[আরও পড়ুন: মাসের শুরুতেই পকেটে টান! একধাক্কায় অনেকটা বাড়ল বাণিজ্যিক গ্যাসের দাম]

বলে রাখা ভালো, যদিও ‘কৌরব’ কমলদারই সন্তান, কিন্তু ‘১০২’ নম্বর সংখ্যা যখন বেরচ্ছে, তখন নতুনরা সম্পাদনার হাল ধরেছে। নতুন সম্পাদকদের মধ্যে আমার মূলত সুদেষ্ণাদির সঙ্গেই কথা হত লেখা নিয়ে। তার পর আর্যনীলদার সঙ্গে যোগাযোগ। আর্যনীলদার মতে, ‘নীলাঞ্জন’ থেকে কবি ‘আর্যনীল’ হয়ে ওঠার নেপথ্যে কমলদার বিশাল অবদান। আর্যনীলদার কথা এই কারণে লিখলাম, আটের দশকে শুরু হয়ে ‘কৌরব ১’ থেকে ‘কৌরব ১০২’-এর যাত্রাপথে অনেক অজানা তথ্য আর্যনীলদার থেকেই শোনা। ‘কৌরব’ পত্রিকার লোগো, একটি ‘কালো গাধা’ বানিয়ে গিয়েছেন এই বাংলার আর এক প্রতিভাবান কমল, কমলকুমার মজুমদার। আর্যনীলদাকে উদ্ধৃত করছি– ‘গদ্যের যে আয়োজন কমলদা কৌরবে ৭০-৮০-৯০ দশকে করেছিলেন তার জুড়ি নেই। অমিয়ভূষণ, কমলকুমার, উদয়ন ঘোষ, সন্দীপন, কমলদা নিজে, কখনও বারীন ঘোষাল, কখনও রাজকুমার মুখোপাধ্যায়, বিনয়ের গদ্য– এরকম উদাহরণ বাংলা সাহিত্যে খুব কম’– অর্থাৎ পরীক্ষামূলক এবং ইনোভেটিভ।

আর্যনীলদার থেকেই শুনেছি, ‘কৌরব ৫০’-এর প্রকাশ অনুষ্ঠানে কলকাতা থেকে জামশেদপুর ট্রেনে করে নিয়ে আসা হচ্ছে সাগরময় ঘোষকে। বাংলা লিট্‌ল ম্যাগের দুনিয়ায় এই দৃশ্য বিরল। ‘কৌরব ১০০’-তে সুনীল গঙ্গোপাধ‌্যায় লিখছেন। শক্তি লিখছেন, শঙ্খ ঘোষ লিখছেন। এবং লেখাগুলি অন্যরকম। অন্য জায়গায় এঁরা যেমন লিখতেন, তেমন ঠিক নয়। ব্যতিক্রমী লেখা। কমলদা বলছে বলেই লিখছেন। আর্যনীলদার মতে, এটাই কমলদার ক্যারিশমা। ক্যারিশমা যে আছে, সে আমি ফোনে কথা বলেই বুঝতে পেরেছি। কমলদার সাহিত্যের অনুরাগী ছিলাম, এবার হলাম কথার। কমলদা বাগ্মী। কমলদার কথা বলায় ম্যাজিক ছিল। এমন সুন্দর করে বলবেন, কিছুতেই না করা যায় না। ভালো না বেসে থাকা যায় না।

[আরও পড়ুন: ২ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন, প্রচার ফেলে আমেরিকা সফরে রাহুল গান্ধী!]

এর পর দেখা হওয়া। সাদা দাড়ি, পাঞ্জাবি, কঁাধে ঝোলা ব্যাগ। বরাবর এমনই দেখেছি কমলদাকে। বইমেলায় দেখা হয়েছে। আমার বাড়ি এসেছে কতবার! কমলদার লেখা একটা ছোটগল্প নিয়ে অনিন্দ্যদার (চট্টোপাধ্যায়) ও আমার মাঝে মাঝেই ঝগড়া হয়েছে। গল্পটি আমাদের দু’জনেরই ভীষণ পছন্দ। দু’জনেই এক সময় ভেবেছি, ওটা নিয়ে আমরা ছবি করব। শুধু অনিন্দ্যদা আমার কিছু বছর আগে ভেবেছিল। যার ফলে দৌড়ে আমি পিছিয়ে। কমলদার মাঝে মাঝে অনিন্দ্যদার উপর হালকা রাগ হত। তখন আমাকে ফোন করত– ‘বুড়ো, তুই করে ফেল! অনিন্দ্য ফেলে রেখেছে, করছে না কিছুই!’ এদিকে, আমিও কিছু করার মতো জায়গায় নেই। গল্পটির নাম ইচ্ছা করেই লিখলাম না, কিন্তু গল্পটি ভীষণ আধুনিক এবং আমার খুবই প্রিয়।

আমার বাড়ির অনুষ্ঠানেও কমলদাকে পেয়েছি। ২০১৮-র বইমেলায় ‘আমাদের বেঁচে থাকা’ শীর্ষক ‘কৌরব’ প্রকাশনা থেকে আমার একটি মুক্তগদ্যের সংকলন বের হয়। সেই বই প্রকাশের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বইমেলার মঞ্চে ছিল কমলদা। বাগ্মী মানুষের সঙ্গে পরিচয়ের কিছু সুফল আছে। যখন কমলদা আমার বইটি এবং আমার লেখালিখি নিয়ে বলতে শুরু করলেন তখন আমার নিজেরই লজ্জা লাগছিল। এত ভালোও বোধ করি আমি লিখি না।
কলকাতা বইমেলা সূত্রে ‘কৌরব’-এর স্টলে কমলদার সঙ্গে বহুবার দেখা। মেলায় আবার ভালোপাহাড়ের অনেকের সঙ্গে আলাপ। আমি তার আগেই জানতাম কমলদার ‘ভালোপাহাড়’ প্রকল্প প্রসঙ্গে। প্রকৃতিপ্রেমী এই মানুষটা গাছ লাগিয়ে লাগিয়ে পুরুলিয়া একটি জায়গাটাই নাকি বদলে দিয়েছেন। কমলদা দেখা হলেই বলতেন– ‘বুড়ো, এইবার কিন্তু তোকে আসতেই হবে ভালোপাহাড়। বসন্তের সময় আসবি। পলাশ ফুটে থাকবে। সারা রাত জেগে আমরা গান গাইব, কবিতা পড়ব।’ দুঃখের কথা, আমার কোনও দিন ভালোপাহাড় যাওয়া হয়নি। এত প্ল্যান করেও পারিনি।

আমার ঘরকুনো স্বভাবের জন্যই। কমলদার সঙ্গে বারবার কলকাতাতেই দেখা। কিন্তু কমলদার সঙ্গে কোনও দিনই কলকাতায় বোধহয় দেখা করা উচিত হয়নি। ফঁাকা মাঠে, ঘন জঙ্গলে, নদীর ধারে, পূর্ণিমা রাতে মুখোমুখি দেখা হলে বেশ হত। অদ্ভুত মানুষ কমলদা। এক অদম্য প্রাণশক্তি নিয়ে ছুটে বেড়াতেন। দেখা হলেই মনে হত, এখুনি হয়তো দশ কিলোমিটার হেঁটে আসছেন। আমার সঙ্গে কথা বলেই আবার হনহন করে হঁাটতে শুরু করবেন। আসলে, নানা কাজ নিয়ে কলকাতায় আসতেন। থাকতেন তো ভালোপাহাড়েই। তাই বোধহয়, হি ওয়াজ অলোয়েজ ইন আ হারি।

কমলদার সঙ্গে সখ্যের আর একটা কারণ ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’। বুলাদা, রঞ্জন কাকু এবং গৌতম চট্টাপাধ্যায়ের বেশ ঘনিষ্ঠ ছিলেন কমলদা। এদিকে, আমার মহীন-প্রীতি নতুন করে বলার কিছু নেই। কমলদার ‘পাখি পুরাণ’-এ মহীনের উল্লেখ পাওয়া যায় বারবার। ‘ক্ষ্যাপার গান’ ক্যাসেটে বুলাদার সুরে ‘সাত তলা বাড়ি’ গানটি তো কমলদারই লেখা। অন্যদিকে, আমার সঙ্গে রঞ্জনকাকুর একটা সুসম্পর্ক ছিল, তাই সেই সূত্র ধরে, আমরা একে-অন্যের খবর ঠিক পেয়েই যেতাম মাঝেমধ্যে।

কমলদার সঙ্গে আমার আলাপ বড্ড দেরিতে এবং কিছুটা দূর থেকে তো বটেই। তঁার জীবনের মূল ক্রিয়েটিভ সময় তখন কমলদা মনে হয় পেরিয়ে এসেছেন। যঁারা আরও সামনে থেকে দেখেছেন, জামশেদপুরের দিনগুলিতে দেখেছেন, তঁারা আরও ভালো বলতে পারবেন। আমার কাছে কমলদা এক অনবদ্য কলম। অফুরান প্রাণশক্তি। অনন্য মানুষ। জানি না, এরকম মানুষ এখন আর তৈরি হয় কি না।
(মতামত নিজস্ব)

২০২৪ এর পূজা সংক্রান্ত সমস্ত খবর জানতে চোখ রাখুন আমাদের দেবীপক্ষ -এর পাতায়।

চোখ রাখুন
Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement