মোদিতন্ত্রর মোকাবিলার জন্য একনাগাড়ে রাজনীতি করার যে মানসিকতা প্রয়োজন, তা রাহুল গান্ধীর নেই। বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু একমুখী ও একাগ্র হয়ে কাজ করতে জানেন। দুর্ভাগ্য, রাহুল কোনও দিন মোদি-বিরোধী রাজনীতির রণকৌশল নিয়ে আলোচনা করলেন না তাঁর সঙ্গে। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল।
একটি সত্য ঘটনার কথা শুরু করি। ১২, তুঘলক লেনে রাহুল গান্ধীর (Rahul Gandhi) বাসভবনে তাঁর সঙ্গে বৈঠকে বসেছেন এক প্রবীণ সম্পাদক। দেশের রাজনীতি নিয়ে আলোচনা হয় প্রায় এক ঘণ্টা ধরে। বৈঠকের শেষে বেশ বিরক্ত হয়ে বেরলেন সম্পাদকমশাই। পরে ওই সম্পাদকমশাই বলেছিলেন, আমি দেশের রাজনীতিতে কীভাবে নরেন্দ্র মোদি (Narendra Modi) কার্যত নির্বিকল্প হয়ে উঠছেন সেটাই বলার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু ‘আর. জি.’ (এই নামেই দিল্লিতে সবাই রাহুলকে ডাকেন) খুবই অমনোযোগী ছিলেন। তিনি নিজে খুব বেশি কথা বলেননি, কোনও কাউন্টার প্রশ্ন করেননি। সম্পাদকমশাই যখন কথা বলছিলেন, তখন মাঝে মাঝেই আর. জি. অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিলেন। গালে হাত দিয়ে মাথা নাড়ছিলেন ঘন ঘন। কিন্তু মনে হচ্ছিল অন্য কিছু ভাবছেন।
আধ ঘণ্টা পর হঠাৎ আর. জি. বললেন– আচ্ছা, কোন দেশের অলিভ অয়েল বেস্ট বলে আপনার মনে হয়? আপনি তো ভূ-পর্যটক। আগে জানতাম, ইতালির অলিভ অয়েল, হালে শুনছি অস্ট্রেলিয়ার অলিভ অয়েল নাকি শ্রেষ্ঠ। খুব ‘বোর’ হন সম্পাদকমশাই। পরে তিনি বলেন, একজন নেতার এতটা নন-সিরিয়াস হওয়া ভাল কথা নয়। না কি এই আচরণের মধ্যে আছে জমিদারি ঔদ্ধত্য?
অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মাও তো কংগ্রেস নেতা হিসাবে রাহুলের সঙ্গে তাঁর শেষ বৈঠকের কথা প্রকাশ্যে আনেন, তা-ও তো আমরা ভুলিনি। হিমন্তর প্লেট থেকে বিস্কুট নিয়ে রাহুল নাকি ডগিকে খাওয়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
রাহুল গান্ধীর সঙ্গে আমার একাধিকবার কথা বলার সুযোগ হয়েছে, আমার কিন্তু কখনই ওঁকে ‘বুদ্ধিহীন’ মনে হয়নি। বরং ২০১৪ সালের ভোটের আগে তিনি আমাকে বলেছিলেন, মোদি যেন এক ‘হলোগ্রাম’। এই পরাবাস্তবতার সঙ্গে লড়ে জেতা সহজ কাজ নয়। তবে দলের সেনাপতি হয়ে সে-কথা প্রকাশ্যে বলি কী করে?
আসলে, রাহুল ভাল মানুষ। বুদ্ধিমান। কিন্তু ভারতের এখনকার রাজনীতিতে মোদিতন্ত্রর মোকাবিলা করার জন্য যে বাস্তববোধ, ধরাতলের সঙ্গে যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ, ২৪X৭ একনাগাড়ে রাজনীতি করার মানসিকতা ও অগ্রাধিকার প্রয়োজন, সেটা ওঁর মধ্যে নেই। লেবানিজ-আমেরিকান লেখক নাসিম নিকোলাস তালেবের ‘ব্ল্যাক সোয়ান’ পড়ে তিনি মুগ্ধ হয়ে যান। তালেবের সঙ্গে দিল্লিতে এই বইটি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেন। এখন সেই তালেব-হুজুগ নেই। এই যেমন মাঝে জঁ দ্র-কে নিয়ে রাহুলের তীব্র আগ্রহ জন্মেছিল।
এসবই তো গভীর অনুসন্ধিৎসা। কিন্তু এই যে মোদি অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণের জাতীয় অনুষ্ঠান করবেন, সেই মেগা শোয়ে মুকেশ আম্বানি, শচীন তেন্ডুলকর-অমিতাভ বচ্চন আমন্ত্রিত। আমন্ত্রিত পৃথিবীর বহু কূটনীতিকও। সেই মেগা রাজনীতির মোকাবিলা ২০২৪-এর লোকসভা ভোটে কীভাবে করবেন রাহুল?
২২ জানুয়ারি রামমন্দিরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের প্রেক্ষিতেই হচ্ছে অনুষ্ঠানটি। বেআইনি করসেবা তো নয়। ১ ফেব্রুয়ারি বাজেট অধিবেশন শেষ হলেই নির্বাচন ঘোষণা হবে। সেখানে কীভাবে বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’ মোদিতন্ত্রর মোকাবিলা করবে? রাহুল গান্ধী বলতেও পারছেন না যে, আমার বাবা-ই তো প্রথম এই মন্দিরের শিলান্যাস করেছিলেন। বিজেপির রাজনীতির সঙ্গে লড়তে নিজেকে ব্রাহ্মণ প্রমাণ করতে গিয়ে রাহুল উপবীতধারী হয়ে মন্দির থেকে মন্দিরে অভিযান, গঙ্গাস্নান, সূর্যপ্রণাম করছেন। এসব কি তাঁকে মানাচ্ছে? দলের মধ্যে একাংশের মত, বিজেপিকে অনুকরণ করে কংগ্রেসের বিজেপির ‘বি-টিম’ হয়ে ওঠা এবং তার মাধ্যমে নেহরুবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ, বহুত্ববাদী চরিত্রকে বিনষ্ট করাও কিন্তু একপ্রকারের ভুল রাজনীতি। বিজেপির এই ফাঁদে পা দেওয়ার অর্থ আদতে সংখ্যালঘু জনসমাজকে রুষ্ট করা। এই অনুকরণের রাজনীতির প্রলোভনে পা না বাড়িয়ে কংগ্রেসের সাবেক নিজস্ব চরিত্রকে পুনরুজ্জীবিত করা প্রয়োজন।
এহেন কঠিন পরিস্থিতিতে এখনও যদি কংগ্রেসকে মোদি-বিরোধী সর্বভারতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ময়দানে নামতে হয়, তাহলে রাহুলের উচিত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে বাস্তব রাজনীতির পাঠ নেওয়া। এই মুহূর্তে মোদি-শাহর রাজনীতির মোকাবিলায় কেউ যদি আজও সক্ষম হন তবে তিনি, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
ভোটের রাজনীতিতে হার-জিত থাকেই। বিগত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপিও কর্নাটকে পরাস্ত হয়েছিল কংগ্রেসের কাছে। কিন্তু তাতেও শীর্ষ নেতৃত্ব হতাশ হয়ে পড়েনি। বরং সঙ্গে সঙ্গে নেমে পড়ে পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের জেতার জন্য ব্লু-প্রিন্ট তৈরির কাজে। মোদির এই পরিশ্রম এবং ‘Singleness of purpose’-প্রশংসনীয়। মোদিকে আপনার পছন্দ না-ও হতে পারে, কিন্তু ইংরেজি প্রবাদ বলে শয়তানকেও তার অংশীদারিত্ব দিতে হয়– ‘Give the devil his due’। এই রাজনৈতিক গুণটি এখনকার দিনে বিরল।
ভারতের রাজনীতিতে একমাত্র মমতাকে দেখি উদয়াস্ত রাজনীতি করেন। ওই পরিশ্রম এই বয়সে ক’জন করতে পারেন? মমতার লড়াই মোদির চেয়েও কঠিন। কয়েক দশক ধরে তিনি সিপিএম বিরোধী লড়াই লড়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। কিন্তু বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় এসে যেভাবে গত দশ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গ দখলের জন্য অন্তহীন লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, তারও মোকাবিলা মমতা করে চলেছেন। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে ১৮টা আসন পেয়ে যায়।
ব্র্যান্ড মোদির এবং উগ্র-হিন্দুত্ব ও জাতীয়তাবাদকে হাতিয়ার করে। ২০২১-এ মমতা কিন্তু সেই পাশা উল্টে দিতে সক্ষম হন। পশ্চিমবঙ্গে ‘বহিরাগত’, ‘উগ্র হিন্দুত্ব’-র বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে বাংলার জাতিসত্তা, গরিব মানুষের জন্য অজস্র পরিষেবা ও প্রকল্প এবং সর্বোপরি ‘দিদি’ ফ্যাক্টরকে মূলধন করেই এই বিপুল জয়।
এবারও ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে সিবিআই-এনফোর্সমেন্ট-দুর্নীতি ইস্যুতে মোদি-শাহ-র ঘন ঘন আগমন, এক লাখ মানুষকে নিয়ে গীতাপাঠের সমাবেশ, নাগরিকত্ব ইস্যু, অনুপ্রবেশ থেকে সন্ত্রাস-হিংসা নানা প্রচার, কেন্দ্রীয় সরকারের বঞ্চনা, ডাবল ইঞ্জিনের তত্ত্ব, নানাভাবে দিল্লির ক্ষমতা দিয়ে রাজ্যকে ঘিরে ফেলা– এতকিছুর মধ্যেও মমতা লড়ে যাচ্ছেন। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী জানেন কীভাবে মোদি-অমিত শাহর মোকাবিলা করতে হয়। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে হয়। তাই রাজ্য বিজেপি ‘মমতা চোর’ লেখা
টি-শার্ট পরে আসরে নামলে, তৃণমূলও সঙ্গে সঙ্গে ‘মোদি চোর-শাহ চোর’ লেখা টি-শার্ট বানিয়ে পাল্টা আন্দোলনে নামে।
গিরিরাজ কিশোর ‘কলকাতা আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’-এ মমতার ‘নৃত্য’ নিয়ে কটাক্ষ করতে-না-করতেই তৃণমূল বিধানসভায় বিজেপিকে ক্ষমা চাওয়ার দাবিতে সোচ্চার। একে বলে ইটের বদলে পাটকেল রাজনীতি। কংগ্রেসকে কখনও এই ধরনের মোকাবিলার রাজনীতি করতে দেখেছেন? ‘ব্যাপম কেলেঙ্কারি’ নিয়ে কংগ্রেস কোনও আন্দোলন করেছে মধ্যপ্রদেশে? ‘মহাদেব অ্যাপ দুর্নীতি’ নিয়ে মোদির প্রচারের মোকাবিলায় রাহুলকে দেখেছেন? এমন অভিযোগ তুললে মমতা নিজেই ধরনায় বসে যেতেন। যেমন, একবার নিজে সিবিআই অফিসে চলে গিয়েছিলেন। বিজেপির বহু নেতাই একান্তে মমতার এই রাজনৈতিক ক্ষিপ্রতার, স্বতঃস্ফূর্ততার প্রশংসা করেন।
দুর্ভাগ্য, রাহুল কোনও দিন মমতার সঙ্গে আলোচনা করে মোদি-বিরোধী রাজনৈতিক রণকৌশল তৈরি করলেন না। সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরি এখন নাকি রাহুলের ঘনিষ্ঠ পরামর্শদাতা। ‘ইন্ডিয়া’ গঠনের আগে থেকেই মমতা যেভাবে ১:১ আসন সমঝোতার কথা বলেন, যেসব পরামর্শ দেন, তার কিছুই কার্যত শোনেননি রাহুল। মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্রিশগড়ের মতো হিন্দি বলয়ের রাজ্যে মূল লড়াই ছিল কংগ্রেস বনাম বিজেপি। কিন্তু চাইলে কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব এই ভোটে আসন না-দিয়েও বিভিন্ন আঞ্চলিক নেতাদের নিয়ে গিয়ে মোদি-বিরোধী প্রচারের একটা জাতীয় মঞ্চ গড়ে তুলতে পারত। রাজস্থানে সামাজিক ভিত্তি নির্ভর ছোট ছোট রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বিজেপি জোট করলেও কংগ্রেস করেনি। এখন দেখা যাচ্ছে, এই ছোট ছোট দল বিজেপি জাতভিত্তিক ভোট বাড়াতে সাহায্য করেছে।
এখনও সময় আছে। দক্ষিণ ভারতে এমন ১৩০টা আসন আছে, যেখানে এখনও বিজেপি সেভাবে জমি দখল করতে পারেনি। চার রাজ্যে যেখানে ভোট হয়েছে সেখানে লোকসভার ৮২-র মধ্যে ৬৬টা আসন বিজেপি পায় ২০১৯-এ। এটা কি বিজেপি আরও বাড়াতে পারবে? কাজটা সহজ নয়, কারণ এসব রাজ্যে বিজেপি এবার আসন পেলেও কংগ্রেসের ভোটব্যাঙ্ক অবলুপ্ত হয়নি। বিজেপির ভোট বেড়েছে বটে, কিন্তু কংগ্রেসের ভোট কমেনি।
তাই রাহুলের প্রয়োজন সঠিক রণকৌশল আর ২৪ ঘণ্টা পরিশ্রম। মমতার কাছ থেকে রাহুলের রাজনৈতিক পাঠ নেওয়া প্রয়োজন। প্রশিক্ষণের জন্য অবশ্য সময় খুবই কম। তবু বলব, ‘Better late than never’। রাহুলের উচিত মমতার শরণাপন্ন হওয়া।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.