কয়েক বছর ধরেই ভারতের বিভিন্ন প্রতিবেশী দেশে ভারত-বিরোধী মনোভাব বাড়ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশে ভারত-বিরোধী জঙ্গি সংগঠনের প্রধানকে মুক্ত করার মধ্য দিয়ে ভারতের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল আরও এক পরত! লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের কাজকর্ম ক্রমশ ভারতের পক্ষে উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে। যেভাবে জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান জসিমউদ্দিন রহমানিকে জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, তা যথেষ্ট চিন্তার। আনসারুল্লাহ বাংলা টিম আল কায়েদার সঙ্গে যুক্ত একটি সংগঠন। এদের সঙ্গে পাক জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তইবারও যোগাযোগ আছে। এর আগে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, অসম-সহ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ‘স্লিপার সেল’ ধরা পড়েছে। আল কায়েদা, লস্কর-ই-তইবা বরাবরই ভারতে অস্থিরতা তৈরি করতে সচেষ্ট। আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বাংলাদেশে আফগানিস্তানের মতো খিলাফত বানাতে চায়। রাজীব হায়দার নামে এক ব্লগারকে হত্যার অভিযোগে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান জসিমউদ্দিন ঢাকায় জেল খাটছিলেন। এরকম এক সন্ত্রাসবাদী নেতাকে মুক্ত করা থেকে বোঝা যায় বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস কতটা মৌলবাদী শক্তির পুতুল হয়ে বসে আছেন।
জঙ্গি নেতাকে মুক্ত করার আগে গত ২৪ আগস্ট জামাতে ইসলামির উপর থেকে ‘নিষেধাজ্ঞা’ তুলে নেন ইউনূস। জামাতে উপর নিষেধাজ্ঞা অবশ্য অল্প দিন আগে জারি হয়েছিল। কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্র আন্দোলন শুরু হওয়ার পর ১ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার জামাতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। ২৩ দিনের মধ্যে সেই নিষেধাজ্ঞা উঠে গেল। এই নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়াটা বড় বিষয় নয়, কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের উপর জামায়েতের প্রভাব যেভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে, তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৪১ সালে মৌলানা মউদুদির প্রতিষ্ঠিত জামাতে ইসলাম সমগ্র উপমহাদেশে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সেই দর্শন নিয়েই তারা এত বছর রাজনীতি করে চলেছে। মউদুদি পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মহম্মদ আলি জিন্নারও বিরুদ্ধে ছিলেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সময়ও প্রবল বিরোধিতা করেছিল জামাতে ইসলাম। ‘মুক্তিযুদ্ধ’-র পর বাংলাদেশ স্বাধীন হলে মুজিবুর রহমান জামাতেকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। মুজিব-হত্যার কয়েক বছর বাদে ১৯৭৯ সালে বিএনপি প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের আমলে জামায়েতের উপর নিষেধাজ্ঞা উঠেছিল। ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’-এর আদর্শে উদ্বুদ্ধ জামাতে যে নানারকম সন্ত্রাসবাদী সংগঠনকে মদত দিয়ে এসেছে, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। বাংলাদেশে জামাতের তৈরি রাজাকার সেনা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের উপর অত্যাচার চালিয়েছিল। সাম্প্রতিক বাংলাদেশের কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের সময় হাসিনার ‘রাজাকার’ নিয়ে মন্তব্য স্ফুলিঙ্গের কাজ করেছিল। হাসিনা আন্দোলন প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিপুতিদের সংরক্ষণ দেব না তো কাদের সংরক্ষণ দেব? রাজাকারদের নাতিদের সংরক্ষণ দেব?’
হাসিনা-বিরোধী আন্দোলনে যে জামাতের বড় ভূমিকা ছিল, কোনও সংশয় নেই। বাংলাদেশের বিভিন্ন নির্বাচনে জামায়েতে কখনওই কোনও সাফল্য দেখাতে পারেনি। তাদের ভোট শতাংশও কখনও দু’অঙ্ক পার করেনি। কিন্তু রাস্তায় নেমে হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ক্ষেত্রে তাদের সবসময় বড় ভূমিকায় দেখা গিয়েছে। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। ২০১৩ থেকে বাংলাদেশের ভোটে জামাত নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকারের অধীন যে নির্বাচন হবে, তাতে যে জামাত বড় ভূমিকা নিয়ে হাজির হবে, তা এখন থেকেই মোটামুটি বোঝা যাচ্ছে। জামাতের ভারত-বিরোধিতা এবং বিভিন্ন ইসলামি জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে সংস্রব সবসময়ই ভারতের পক্ষে উদ্বেগের। যদিও নিষেধাজ্ঞা ওঠার পর ঢাকায় বর্তমান জামাত-প্রধান এক সাংবাদিক বৈঠকে বলেছেন, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে তাঁরা আগ্রহী। জামাত নেতা এ-কথা বলার পরপরই জেল থেকে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের মতো জঙ্গি সংগঠনের প্রধানের জেল থেকে মুক্তি পাওয়া অবশ্য অন্য বার্তা দেয়।
গত কয়েক বছর ধরেই দক্ষিণ এশিয়ায় যেসব ঘটনা ঘটে চলেছে, তা ভারতের পক্ষে চিন্তার। ২০২১-এ আমেরিকা আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করার পর সেখানে বাংলাদেশের মতোই অভ্যুত্থান ঘটেছিল। ২০২১-এ মায়ানমারে সেনা সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তখন থেকেই মায়ানমার অশান্ত। শ্রীলঙ্কা ২০২২ সালে গণ-অভ্যুত্থান প্রত্যক্ষ করেছে। ২০২৩-এ মালদ্বীপে ভারত-বিরোধী মুইজ্জুু সরকার ক্ষমতা দখল করেছে। গত জুলাইতে নেপালে আচমকা ক্ষমতা পরিবর্তন হয়েছে। সেখানেও ভারত-বিরোধী শক্তি প্রাধান্য বিস্তার করেছে। ২০১৬ সালের পর থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক লাগাতার খারাপ হচ্ছে। চিনের সঙ্গে শত্রুতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। এহেন পরিস্থিতিতে আঞ্চলিক সংগঠনগুলির একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। একসময় সার্ক-এর মতো সংগঠন দক্ষিণ এশিয়ায় সুস্থিতি বজায়ের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করত। দেশগুলির পারস্পরিক আলোচনার একটা মঞ্চ থাকত। দুর্ভাগ্যের বিষয়, গত কয়েক বছর ধরে দক্ষিণ এশিয়ার এসব সংগঠনের অস্তিত্ব প্রশ্নের মুখে পড়ে গিয়েছে।
এই ধরনের আঞ্চলিক সংগঠনগুলিকে ফের সক্রিয় করার ক্ষেত্রে ভারতের উদ্যোগী হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে প্রধানমন্ত্রী টেলিফোনে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ওই আলোচনায় অবশ্য তিনি বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণের প্রসঙ্গ তুলেছেন। ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কথা মাথায় রেখে হয়তো মোদি এই প্রসঙ্গটিকে গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে শক্তির ভারসাম্যের যে পরিবর্তন ঘটছে, ভারতকে তা মাথায় রেখেই পদক্ষেপ করতে হবে। ভারতকে উপেক্ষা করে চলা বাংলাদেশের কোনও শক্তির পক্ষেই সম্ভব নয়। ভারতকেও পাল্টা চাপ তৈরির কৌশলে আসতে হবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.