শিল্পীর শরীর খারাপ হতে নেই? অনুষ্ঠানের মাঝপথে তিনি হাতজোড় করে বলতে পারেন না, দোহাই, আজকে শো মাস্ট নট গো অন? গান আগে না প্রাণ আগে? আড়াই হাজারি মঞ্চে সাত হাজার মানুষের মধ্যে এক—দু’জনও কি শুভবুদ্ধিসম্পন্ন কেউ ছিলেন না? যাঁরা থামাতে পারতেন এই দুর্ঘটনা? তাঁর অঙ্গুলিহেলনে উত্তাল হয়ে উঠছে জনরব। ওই মোহময়তার মুহূর্তটায়, হ্যাঁ , তিনিই ঈশ্বর। কিন্তু গান থামলে তিনি যে মানুষ, তিনি তো মানুষ, মরণশীল। লিখছেন অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় ।
শিল্পী ক্ষণজন্মা। ক্ষণ, মানে মুহূর্ত। মানে, পল। মানে, কৃষ্ণকুমার কুন্নাথ। কেকে (KK)। বহু স্মরণীয় গানের পাশাপাশি তাঁকে এজন্যও স্মরণ করা হবে, যিনি তাঁর অন্তিমক্ষণেও গান থামাননি। স্পটলাইটগুলো অসহ্য লাগছিল, প্রতিটি হিটের পর উইংসে ঘাম মুছতে হচ্ছিল, ফায়ার এক্সটিংগুইশারের স্প্রে তাঁর দমবন্ধ করে দিচ্ছিল বারেবারে– তবু তিনি গান থামাননি। গত শতকের সেরা এক আফ্রিকান প্রতিভা, মিরিয়াম মাকেবা (Miriam Makeba), গান গাইতে গাইতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন মঞ্চে। কিন্তু মিরিয়ামের বয়স ছিল ৭৬, সেখানে কে কে-র ৫৩। যে মানুষ স্টেজ কাঁপিয়ে এক্ষুনি ‘আলভিদা’ গাইছেন, কীভাবে এত দ্রুত হতে পারে তাঁর প্রস্থান?
আসলে সমুদ্র যেমন ছলনাময়, জনসমুদ্রও তাই। সে বিনোদন পেতে এসেছে। যে কোনও মূল্যে তার ন্যায্য বিনোদন হুল্লোড় চাই-ই। এটুকুই তার হিসাব। শিল্পীকে তো পারিশ্রমিক দেওয়া হয়েছে। তাহলে সে এই তিনঘণ্টা আমার শ্রমিক। যতগুলো হিট আছে, সব গাইতে হবে। আমোদ নিংড়ে নিতে হবে, একলপ্তে শুষে নিতে হবে।
গানের মঞ্চে যখন প্রথম-প্রথম ৫-১০ হাজার লোক দেখছি, ভয় ভয় লাগত। সব উদ্যোক্তারা হয়তো নয়, কিন্তু কিছু আয়োজকের মনে হত, পয়সা উশুল হল না পুরো। আরও আধঘণ্টা। আরও নাচের গান। একজন শিল্পী সারারাত জেগে ধুঁকতে ধুঁকতে অন্তত দশবার ‘শেষ গান’ করেন। করতেই হবে। নইলে ছাড়ান নেই।
একটা গানে লিখেছিলাম– ‘এই যে গাইছি গান/ শুনছে পালোয়ান/ শিল্পী এলে তল্পিতল্পা জুলফি ধরে টান’। যত অডিয়েন্স তত অডাসিটি। তুমি বর্মহীন গ্ল্যাডিয়েটর। প্রতিটি আনন্দ-আক্রমণ তোমায় প্রাণপণে ঠেকাতে হবে। ভালবাসার ভালুক নইলে তোমায় কপ্ করে গিলে নেবে। যে কোনও আবেগঘন উদ্দামতার একটা জিঘাংসা থাকে। একটা অদ্ভুত ভায়োলেন্স, যা মুহূর্তে মুহূর্তে উন্মনা করে তোলে শিল্পীকে। সব আর্টিস্ট সমান কনফিডেন্ট নন। কেউ নিতে পারেন, কেউ পারেন না। এখানে দোষ-গুণ নয়, শ্রোতার সংবেদনশীলতা অনেক বেশি জরুরি। নরম শ্রোতা আর পেলাম কই জীবনে, যা দেখি, যা পাই, সবই খরশ্রোতা।
কেকে আমার অন্যতম এক পছন্দের গায়ক। মনে পড়ছে, ফ্লোরিডায় দেখা ওঁর শো। ফ্লাইট দেরি করেছে, তাই বেলা এগারোটায় ১৫ ঘণ্টা বিমানযাত্রার পর, দু’ঘণ্টা সাউন্ড ব্যালেন্স সামলে আরও তিনঘণ্টার ঝোড়ো শো। পুরো সময়টায় একবারও জল খাননি, জেট ল্যাগ পকেটে পুরে স্টেজ জুড়ে নেচেছিলেন। এতটাই স্মার্ট আর ফিট কে কে। প্রবল চিৎকারের মধ্যে তাঁর সুর কাঁপে না, ‘ইয়ারো দোস্তি’ সবাইকে দিয়ে চারবার করে গাওয়ান। এমন গ্ল্যাডিয়েটরের তবে কী হল গতকাল?
কোভিড-ছাপ দুর্বলতা ছিল? আয়োজকদের চাপ কোনওভাবে বাড়িয়ে তুলেছিল রক্তচাপ? টাকা নিয়েছেন ফলে এ-খেলা শেষ অবধি খেলতেই হবে, এমন পরিস্থিতি ছিল? শিল্পীর শরীর খারাপ হতে নেই? অনুষ্ঠানের মাঝপথে তিনি হাতজোড় করে বলতে পারেন না, দোহাই, আজকে শো মাস্ট নট গো অন? গান আগে না প্রাণ আগে? আড়াই হাজারি মঞ্চে সাত হাজার মানুষের মধ্যে এক-দু’জনও কি শুভবুদ্ধিসম্পন্ন কেউ ছিলেন না? যাঁরা থামাতে পারতেন এই দুর্ঘটনা?
হয়তো আলো এসে পড়ছে। হয়তো তাঁর এক অঙ্গুলিহেলনে উত্তাল হয়ে উঠছে জনরব। ওই মোহময়তার মুহূর্তটায়, হ্যাঁ, তিনিই ঈশ্বর। গান থামলে কিন্তু তিনি মানুষ। কী আশ্চর্য, কে কে তাঁর জীবনের শেষগান গেয়েছিলেন– ‘হাম রহে ইয়া না রহে ইয়াদ আয়েঙ্গে ইয়ে পল’।
পল মানে ক্ষণ। পল মানে মুহূর্ত। আবেগের সেরা যত মুহূর্ত কে কে উপহার দিয়েছিলেন আমাদের, শুধু আমরা তাঁকে বেঁচে থাকার মুহূর্তটুকু ফিরিয়ে দিতে পারলাম কই?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.