Advertisement
Advertisement

Breaking News

এক শুভ্র ঋজুতার অবসান

'মৃণাল' আবেগে ভাসলেন অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়।

Anindya Chatterjee remembers Mrinal Sen
Published by: Utsab Roy Chowdhury
  • Posted:December 31, 2018 11:40 am
  • Updated:December 31, 2018 11:41 am  

অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়: মৃণাল সেন যে বেঁচে ছিলেন, তা আমরা সকলে এতদিন জানতাম তো? তাঁর অস্তিত্ব সম্পর্কে যথেষ্ট অবহিত ছিলাম তো, আমরা? না কি এই প্রয়াণ নতুন করে আবার জন্ম দিল তাঁর? মৃত্যুর ঠিক আগে সব মানুষই আসলে বিস্মরণের নিষ্ঠুর খাতায়, আর চলে যাওয়ার পর আগামী একমাস তিনি-ই ‘ম্যান অফ দ্য ম্যাচ’। গোটা জানুয়ারি মাস আমরা বলব, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের মতো গায়ক আর আসেননি কখনও, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর মতো কবি পড়িনি কখনও, আর মৃণাল সেন পৃথিবীর সর্বোত্তম মহান পরিচালক। একজন ৯১, একজন ৯৪ আর শেষজন ৯৫। বাঙালিয়ানার শুভ্রতা নিয়ে আজীবন কাটিয়েছেন তিনজনই। সৌজন্য ও ভদ্রতাবোধে তিনজনই সুপারঙ্গম।

আমার কপালগুণে মৃণাল সেনের স্নেহস্পর্শ জুটেছে কখনও। আমার কলেজের সিনিয়র। স্কটিশের এগজিবিশনের জন্য একটা লেখা চাইতে গিয়েছিলাম। সে তো দিলেনই, শুকনো মুখের অজানাকিছু ছাত্র—ছাত্রীকে তিনি ও গীতা সেন ঘরে বসিয়ে খাইয়েওছিলেন। তখনও ‘কোরাস’ দেখিনি, ‘ভুবন সোম’—ও না। পরবর্তী যাওয়া ছিল চন্দ্রবিন্দুর ‘ডাকনাম’ অ্যালবাম প্রকাশের জন্য। ঘণ্টা দুয়েক আড্ডা দিয়েছিলেন আমাদের সঙ্গে। তাজ বেঙ্গলের এক অনুষ্ঠানে তিনি এসে অ্যালবামটি প্রকাশ করেন। অনেকক্ষণ গল্প করেছিলেন। তার অনেকটা জুড়ে ছিল তাঁর যৌবনের ইচ্ছা—অভিলাষের গল্প। মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ ছিলেন। আর, স্বপ্ন দেখতেন ছবি বানাবেন। কেমন ছবি? যা ইডিওলজিক্যাল, এক্সপেরিমেন্টাল, হলিউড—না অনুসারী, নন—লিনিয়ার। তাঁর প্রথম দু’টি ছবি, ‘রাত ভোর’ আর ‘নীল আকাশের নীচে’—কে জীবনে কোনও দিন ফিল্মোগ্রাফিতে রাখতে চাননি। ওগুলো নেহাতই ছিল ক্র‌্যাফ্‌ট—টা বোঝার প্রস্তুতি মাত্র। ‘বাইশে শ্রাবণ’ থেকে তিনি চেনা মৃণাল সেন। যিনি ‘ইন্টারভিউ’ বানান, ‘আকালের সন্ধানে’ ঘোরেন, ‘খারিজ’—এ দীর্ণ করেন মধ্যবিত্ত মনন, ‘খণ্ডহর’—এ আবিষ্কার করেন এক আশ্চর্য তেলেনাপোতার অন্ধকার। যে ধরনের ছবি আমাদের অভ্যাসের সঙ্গে জড়িয়ে, তার বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে তিনি, মৃণাল সেন। ছবি কী এবং কেন, তার মতভেদ নিয়ে ‘দ্য স্টেটসম্যান’—এ সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে পত্রবিতর্কটিও তাঁর ছবির পলিটিক্সের কথা বলে। যে অনায়াস কাটাছেঁড়ার ঔদ্ধত্য তিনি দেখাতে পেরেছিলেন ছবিতে, ভারতীয় কেন আন্তর্জাতিক আঙিনাতেও তার দৃষ্টান্ত বিরল। ছবির ‘ন্যারেটিভ’ ঠিক কোন ফর্মে বলা হবে, এ বিষয়ে আমাদের দেশের শ্রেষ্ঠ মানুষ তিনি—ই। জন্মসূত্রে বাঙালি, কিন্তু চিন্তনের পরিধিতে আন্তর্জাতিক দীর্ঘদেহী এক শিল্পী। যতদিন চলচ্চিত্র থাকবে, ততদিন এ শিল্পমাধ্যম ঋণী থাকবে তাঁর কাছে।

Advertisement

এই মাস্টার ফিল্মমেকার বেঁচে থাকতেই একটি ট্রিবিউট সংখ্যা ‘রোববার’ করেছিল। তাঁর পুত্র কুণাল সেন, মনোজ্ঞ একটি লেখা লিখেছিলেন আমাদের জন্য। একে—অপরকে তাঁরা ‘বন্ধু’ বলে ডাকতেন। কুণালদার সঙ্গে দেখা করতে সেই শেষবার মৃণাল সেনের বাড়ি যাওয়া। তখন তিনি ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত। আমরা কথা বলছি দেখে ঋজু, শক্ত শরীরে চলে এলেন। হাসলেন। ‘কেমন আছো?’ কুণালদা একটু অপ্রস্তুত। নিশ্চয়ই গুলিয়ে ফেলছে অন্য কারও সঙ্গে। ‘তুমি চিনতে পারছ ওঁকে?’ মৃণাল সেন মাথা নাড়লেন। ‘হ্যাঁ, ওদের একটা দল আছে। গান করে।’ ওই চিনতে পারাটুকু মনে পড়লেই বুকের ভিতর কোথাও একটা ধক করে ওঠে। উনি জানতেন। চিনতে পারতেন সব। কিন্তু আমরা কি পেরেছি ওঁকে চিনতে? যে উচ্চতায় ওঁর অধিষ্ঠান ছিল, পেরেছি সেই সম্মানটুকু অর্পণ করতে? সিনেমার দোহাই, এই মৃত্যু, এই ঋজুতার অবসান কি সত্যি নতুন করে আবার বাঁচিয়ে তুলতে পারে না তাঁকে?

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement