মোদি-বন্দনায় দেশে রামরাজ্য প্রায় প্রতিষ্ঠিত। হ্যাটট্রিকও প্রায় নিশ্চিত। এত বৈভব, প্রচার, ক্ষমতার অপব্যবহার, এমন ‘বিরোধীশূন্য’ রাজনৈতিক আবহ সত্ত্বেও বিজেপি কি নার্ভাস? সংশয়ী? নইলে রাজ্যে রাজ্যে এখনও কেন দল ভাঙানি পর্ব বহমান? কোথাও কি তবে ২০০৪ সালে ‘শাইনিং ইন্ডিয়া’-র মুখ থুবড়ে পড়ার ছবি ঘুরপাক খাচ্ছে? লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়।
এক কান কাটা গাঁয়ের ধার দিয়ে কেন যায়? কারণ, তার লজ্জাশরম তখনও কিছুটা অবশিষ্ট।
সে চুল দিয়ে কাটা কান ঢাকার চেষ্টা করে। কখনও পারে, কখনও পারে না। এদিক-সেদিক ফালুক-ফুলুক চায়। সেই দৃষ্টিতে অপরাধবোধের রেশ কিছুটা হলেও থাকে। কিন্তু দু’-কান কাটা গাঁয়ের মাঝখান দিয়ে বীরদর্পে হাঁটে। তার আর বাড়তি কিছু হারানোর ভয় নেই। সে যে নির্লজ্জ-বেহায়া, সেটুকু জাহির করতে দ্বিধাগ্রস্ত হয় না। তাতে আখেরে তার লাভ। কেননা, সে অন্যদের সমীহ আদায় করে। ঘৃণাও। যদিও তাতে তার কিছু যায়-আসে না।
ইডি, সিবিআই, আয়কর বিভাগ ইদানীং যা শুরু করেছে, তাদের নির্লজ্জ-বেহায়াপনা ও বেলাগাম আচরণ দেখে এই প্রাচীন প্রবাদটাই মনে এল। আরও মনে পড়ল প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা শুনে। রবিবার রামলীলা ময়দানে বিরোধী সমাবেশের উদ্দেশে মিরঠের জনসভায় তিনি যখন বলেন, ‘যে লড়াই শুরু হয়েছে, তা দুর্নীতির রক্ষকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি বিনাশকারীর’, তখন ঢাকাই কুট্টির ঢঙে বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল, ‘চুপ করেন কত্তা, চুপ করেন, শুনলে ঘুরায় হাসব।’ যদিও ব্যাপারটা এখন আর মুখ টেপাটিপি-হাসাহাসির পর্যায়ে নেই। ক্রমেই বিরক্তিকর হয়ে উঠেছে।
বিজেপিকে ‘ওয়াশিং মেশিন’-এর সঙ্গে তুলনা প্রথম কে করেছিলেন জানি না। তাতে ভুল কিছু না-থাকলেও খামতি কিছুটা ছিল। ওয়াশিং মেশিন শুভ্রতা দিলেও পবিত্রতার পরাকাষ্ঠা নয়। হালের বিজেপি যেন কলুষবিনাশিনী পবিত্র তরঙ্গিণী চিরস্রোতস্বিনী গঙ্গা! সেখানে অবগাহন করার অর্থ কলঙ্ক দূর হওয়ার পাশাপাশি পবিত্র হয়ে যাওয়া। ‘বিজেপি’ নামক গঙ্গায় কলঙ্ক ঘুচিয়ে পবিত্র হওয়ার দীর্ঘ তালিকার সর্বশেষ সংযোজন প্রফুল্ল প্যাটেল। শরদ পাওয়ারকে ছেড়ে অজিতের হাত ধরে বিজেপির ঘর করতে এসে প্রফুল্ল যেন রাতের ঘুম ফিরে পেয়েছেন। অজিতের মতো, কংগ্রেসের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অশোক চৌহানের মতো,
তিনিও এখন কালিমামুক্ত ও পবিত্র। আহা, বিজেপির কী মাহাত্ম্য!
অথচ, ২০১৪ সালে বিজেপির নির্বাচনী ইস্তেহারে ৩০ হাজার কোটি টাকার ‘এয়ার ইন্ডিয়া কেলেঙ্কারি’-র খলনায়ক হিসাবে চিহ্নিত হয়েছিলেন এই প্রফুল্লই। শুধু তা-ই নয়, বিজেপি অভিযোগ করেছিল, ১৯৯৩ সালে মুম্বই বিস্ফোরণের পান্ডা ইকবাল মিরচির সঙ্গে সম্পত্তি কেনাবেচাতেও তিনি জড়িত ছিলেন। সিবিআই মামলা রুজু করেছিল প্রফুল্লর বিরুদ্ধে। বিজেপি পণ করেছিল তঁাকে জেলে ঢোকানোর। রবিবার জানা গেল– প্রমাণ অমিল, তাই সিবিআই প্রফুল্লর বিরুদ্ধে আনা মামলা ‘ক্লোজ’ করে দিয়েছে। প্রতিশ্রুতি পূরণের নামগন্ধও নেই প্রধানমন্ত্রীর মুখে। অরবিন্দ কেজরিওয়াল এঁদের মতো চালাক হতে পারলেন না। হেমন্ত সোরেনও। হলে চিত্রনাট্য অন্যভাবে লেখা হত। হননি, তাই প্রধানমন্ত্রী ‘দুর্নীতি বিনাশকারী’-র ভূমিকা পালন করে চলেছেন। ধন্য ভারতের গণতন্ত্র!
এজেন্সির গোয়েন্দারা আজকাল দু’-কান কাটা বেয়াদপের মতো গঁায়ের মাঝখান দিয়ে হঁাটছেন। স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত অতি পরিচিত উপদেশ ধার করে সামাজিক মাধ্যমে ঘোরাঘুরি করছে এই বাক্যটি–‘ওয়ান সামন আ ডে কিপ্স ইডি হ্যাপি’। সেই ‘সামন’, অর্থাৎ সমন, ভুলেও বিজেপিমুখী হয় না। নন্দ ঘোষেরা সবাই বিরোধী। প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্রয় আছে, তাই কোনও কিছুর তোয়াক্কাও নেই। দেশের কোনও আদালতে কখনও কোনও রাজনৈতিক নেতা প্রধানমন্ত্রীর মদতপুষ্ট কোনও সরকারি এজেন্সির বিরুদ্ধে এত খোলামেলা দোষারোপ করেছেন কি না জানা নেই। কেজরিওয়াল সেটাই করলেন। এবং করলেন ঘোষণা করেই। বিচারকের অনুমতি নিয়ে। সরকার পক্ষ তঁাকে থামানোর চেষ্টা করেছিল। পারেনি। এজলাসের রেকর্ডে তাই থেকে গেল ইডির ‘অপকর্মের খতিয়ান’। কোনও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে এটা সম্মানজনক হতে পারে না।
অবশ্য বিরোধীদের সম্মানের আশা প্রধানমন্ত্রী করেনও না। অনমনীয় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ অনেক দিন আগেই তঁার দৃষ্টিতে শত্রু। তঁার দলের কেউ সামাজিকতার ধারও ধারে না। শীর্ষ বিরোধী নেতাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর স্বাভাবিক সৌজন্য বিনিময়টুকুও আজকাল হয় না। দশ বছর ধরে ভারতীয় গণতন্ত্র এক অন্য প্রবাহে বইছে। সেই অভিমুখ ঘোরানো বড় কঠিন।
আক্ষেপের বিষয়, দুর্নীতির উৎসমুখ বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসে প্রধানমন্ত্রী নিজেই উৎসস্থল হয়ে গেলেন। দেশ-বিদেশে তিনি এভাবেই চর্চিত। ইলেক্টোরাল বন্ড ‘অসাংবিধানিক’ ঘোষিত হয়েছে। এর কলঙ্ক সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর মুখে লাগিয়েছেন রাজনৈতিক, অর্থনীতিবিদ ও সামাজিক ভাষ্যকার পরকাল প্রভাকর। তঁার স্ত্রী নির্মলা দেশের অর্থমন্ত্রী। তবু একবারের জন্যও তিনি তঁাকে রেয়াত করেননি। বরং বারবার সরকারি নীতির সমালোচনা করে তথ্য সহকারে দেখিয়েছেন কেন এই অর্থনীতি একপেশে।
নির্বাচনী বন্ডকে পরকাল প্রভাকর ‘বিশ্বের বৃহত্তম আর্থিক কেলেঙ্কারি’ বলেছেন। ভুল কিছু বলেছেন কি? সরকারি তোলাবাজির এর চেয়ে বড় নমুনা কেউ কি কোথাও দেখেছে? ইডি-সিবিআইকে লেলিয়ে চঁাদা আদায়, হাজার-হাজার কোটি টাকার সরকারি প্রকল্পের কাজ পাইয়ে দিয়ে বন্ডের আড়ালে ‘কাটমানি’ নেওয়ার যেসব ‘প্রমাণ’ সামনে আসছে, তাতে ‘সরকার’ ও ‘মাফিয়া’-র তফাতটা বুঝে ওঠা দায় হয়ে যায়। সুপ্রিম কোর্ট মামলার রায় দিয়ে তার দায়িত্ব পালন করেছে। কিন্তু নৈতিকতা-কেন্দ্রিক দায়িত্ব পালনের কিছু প্রশ্ন তবু থেকেই যাচ্ছে। সেই দায়িত্ব সাহসের সঙ্গে পালন দেশের জন্যই করা উচিত। কে করবে? কীভাবে? উত্তর জানা নেই।
বন্ড নিয়ে যঁারা মামলা করেছিলেন, এই কঠিন সময়ের ‘সেলেব্রিটি’ তঁারা-ই। তঁারা কি নতুন করে উদ্যোগী হবেন ‘পিএম কেয়ার্স’-এর স্বরূপ উদ্ঘাটনে? অনেকের ধারণা, নির্বাচনী বন্ডের চেয়েও অনেক বড় ‘দুর্নীতি’ লুকিয়ে আছে এই তহবিলে। সামাজিক মাধ্যমগুলি এ নিয়ে সরগরম। সবার সন্দেহ, এখানেও এমন কিছু রয়েছে, যা সরকার গোপন রাখতে চায়।
পিএম কেয়ার্স তহবিল নিয়ে বিস্ময় অনেক! কোভিড-কালে গঠিত এই তহবিলে প্রধানমন্ত্রীর ছবি রয়েছে। অশোক স্তম্ভ আছে। প্রধানমন্ত্রীই এই তহবিলের চেয়ারম্যান। ট্রাস্টিদের মধ্যে রয়েছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী। এঁরা ছাড়া প্রধানমন্ত্রী মনোনীত আরও তিনজন ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি কে. টি. টমাস, ঝাড়খণ্ডের বিজেপি নেতা কারিয়া মুন্ডা ও শিল্পপতি রতন টাটা। এই তহবিলে দান করলে আয়করে ছাড় মেলে। বিদেশি অনুদানও স্বাগত। এত কিছু সত্ত্বেও এই তহবিল কিন্তু ‘সরকারি’ নয়। এটি ‘বেসরকারি দাতব্য সংস্থা’! এর কোনও সাংবিধানিক স্বীকৃতি নেই। সংসদে আইনে পাস করেও এই তহবিল গড়ে তোলা হয়নি। এখানে স্বেচ্ছা অনুদান জমা হয়।
এই তহবিল তথ্য জানার অধিকার আইনের আওতাতেও পড়ে না। সবচেয়ে বড় কথা, যে-তহবিলে হাজার হাজার কোটি টাকা জমা পড়ছে, ভারতের ‘কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল’ (সিএজি) তার অডিট করতে পারে না! কেন? কোন যুক্তিতে? সরকারি ভাষ্য, ওই তহবিলে সরকার বাজেট থেকে কোনও অর্থ সাহায্য করে না তাই। অথচ আশ্চর্যের বিষয়, সরকার নিয়ন্ত্রিত ‘নবরত্ন’ সংস্থাগুলো বড় দাতা। তিন বছরে এই তহবিলে জমা পড়েছে সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকারও বেশি। সবটাই অনুদান! এই টাকার ৪০ শতাংশ এখনও অব্যবহৃত।
সরকারি ও বেসরকারি প্রচার-যন্ত্রের দিবারাত্রি মোদি-বন্দনায় দেশে রামরাজ্য প্রায় প্রতিষ্ঠিত। হ্যাটট্রিকটা হয়ে গেলে বাকিটুকু করা স্রেফ সময়ের ব্যাপার। এত ক্ষমতা, এত টাকা, এত বৈভব, এত প্রচার, ক্ষমতার এমন অপব্যবহার, দু’-কান কাটাদের এত দাপাদাপি ও এমন ‘বিরোধীশূন্য’ রাজনৈতিক আবহ সত্ত্বেও বিজেপি কি নার্ভাস? সংশয়ী? নইলে রাজ্যে রাজ্যে এখনও কেন দল ভাঙানি পর্ব বহমান? রামলীলা ময়দানে ‘ইন্ডিয়া’ সমাবেশকে কেন এত কটাক্ষ? প্রধানমন্ত্রীর অবচেতনে কোথাও কি তবে ২০০৪ সালে ‘শাইনিং ইন্ডিয়া’-র মুখ থুবড়ে পড়ার ছবি ঘুরপাক খাচ্ছে? দেশের গণতন্ত্র ও সংবিধান কিন্তু ‘ইন্ডিয়া’-র দিকে চাতক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.