দীপঙ্কর দাশগুপ্ত: প্রথমেই যেটা স্মরণে রাখা দরকার, তা হল, যে কোনও সরকারি বাজেটই একটি স্বল্পমেয়াদি প্রকল্প। ১ ফেব্রুয়ারি একটি বাজেট (Union Budget 2023) পেশ করা হল, এবং ঠিক এক বছর পরে আবার ১ ফেব্রুয়ারি একটি বাজেট পেশ করা হবে। অর্থমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় এমনটাই যেন ইঙ্গিত করলেন। তথাকথিত আগামী ২৫ বছর অমৃতকালের জন্য আজকের বাজেট প্রথম ধাপ মাত্র। এরপর ২৫ বছর ধরে কী হবে, তা জানতে হলে আরও ২৫ বছর অপেক্ষা করতে হবে, আরও ২৫টি বাজেট শুনতে হবে, দেশে ও বিদেশে কী কী ঘটনা ঘটল জানতে হবে। কাজেই আগামী এক বছরে কী হবে-আপাতত এর বেশি ভাবারই কোনও অবকাশ আমাদের নেই।
কেইন্স দীর্ঘমেয়াদি ঘটনা সম্পর্কে বলেছিলেন, দূরপাল্লার ব্যাপারে একটাই কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। তা হল অন্তহীনকাল আমরা কেউই বেঁচে থাকব না। কাজেই অর্থনীতির আলোচনা অদূর ভবিষ্যতের চিন্তার মধ্যেই নিবদ্ধ থাকা ভাল। এই অদূর ভবিষ্যতে অর্থনীতি ভাল থাকবে কি না, অর্থাৎ সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থান হবে কি না, তারা খেয়েদেয়ে, সিনেমা দেখে, এদিক-ওদিক বেড়িয়ে সংসার ধর্ম পালন করতে পারবে কি না-এটাই মূল প্রশ্ন। কর্মসংস্থান নির্ভর করে কর্মসংস্থাদের উপরে। তারা কি আদৌ পণ্য উৎপাদন করবে? না করলে শ্রমিকের প্রয়োজন নেই। কিন্তু উৎপাদন করতে হলে কর্মসংস্থার মালিকদের জানতে হবে তাদের উৎপাদিত পণ্যের জন্য চাহিদা থাকবে কি না। অন্যদিকে, তাদের হাতে অর্থেরও প্রয়োজন হবে, কারণ মজুরি দিলে তবেই শ্রমিক কাজ করবে।
এবার বাজেটের মূল বক্তব্য দেখা যাক। এই বক্তব্য বোঝার জন্য সংখ্যার প্রয়োজন নেই। প্রথম কথা হল, মালিক শ্রেণির জন্য, এবং এর মধ্যে ক্ষুদ্র, মাঝারি মালিকরাও রয়েছেন, বিভিন্ন ধরনের বহিঃশুল্ক কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে উৎপাদনের খরচ কমে যাবে এবং বাজারে জোগান বেড়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হবে। কিন্তু কেবলমাত্র জোগান বাড়লেই চলবে না। চাহিদাও বেড়ে ওঠা দরকার। কাজেই সাধারণ মানুষের কর-কাঠামোর দিকে নজর দেওয়ার দরকার ছিল। সেটাই করা হয়েছে আয়কর কমিয়ে। একেবার অতি ধনী ছাড়া কর-কাঠামোর আওতায় রয়েছেন এমন সর্বশ্রেণির মানুষের জন্যই কর কমিয়ে দেওয়া হয়েছে এই বাজেটে। কাজেই একদিকে চাহিদা বাড়ার সম্ভাবনা, অন্যদিকে জোগান বৃদ্ধির ব্যবস্থা।
তবে এখানেই শেষ নয়। স্থায়ী পুঁজি ও পরিকাঠামো গড়ে তোলার জন্য সরকার নিজেও খরচ বাড়াচ্ছে। এখানে সংখ্যাটি লক্ষণীয়। স্থায়ী পুঁজি ও পরিকাঠামো খাতে কেন্দ্রীয় সরকার খরচ বাড়াচ্ছে ৩৩ শতাংশ এবং রাজ্যগুলিকেও সাহায্য দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। সব মিলিয়ে অনুমান, ১৩.৭ লক্ষ কোটি টাকার বিনিয়োগ করবে কেন্দ্র। এর ফলে বেসরকারি সংস্থাগুলিও বিনিয়োগে উৎসাহী হবে বলে ধারণা। রেল পরিষেবা, অন্যান্য পরিবহণ, শহর উন্নয়নের পরিষেবা, গ্রামোন্নয়ন এবং আরও অনেক ক্ষেত্রে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত এই বাজেটে ঘোষণা করা হয়েছে। এ সমস্তই নতুন উৎপাদনের পক্ষে অনুকূল।
এই বাজেটকে ‘বৃদ্ধির সহায়ক’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু আমরা প্রথমেই বলেছি যে, বাজেট কোনও দূরপাল্লার ‘নীল নকশা’ নয়। ভারতীয় অর্থনীতি যে সঠিক পথেই চলছে, তার প্রমাণস্বরূপ অর্থমন্ত্রী জানালেন যে, ২০২২-’২৩ সালে বৃদ্ধির হার ছিল ৭ শতাংশ। এবং ২০২২-’২৩-এর অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০২৩-’২৪ সালের বৃদ্ধির হার হবে ৬ থেকে ৬.৮ শতাংশের কাছাকাছি। এত ব্যবস্থা নেওয়া সত্ত্বেও বৃদ্ধির হার কেন কমবে? এই প্রশ্নের উত্তর রয়েছে আন্তর্জাতিক দুনিয়ার হালচালের মধ্যে লুকিয়ে। ধনী সমস্ত দেশেই অর্থনৈতিক সমস্যা চলছে। রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ (Russia-Ukraine War) কমার লক্ষণ নেই। চিনে পুনর্বার কোভিডের আক্রমণ। এমন অনেক আন্তর্জাতিক সমস্যা রয়েছে। কাজেই ভারতের অর্থনীতিকে সেই সমস্ত অজানা আতঙ্কের মধ্যেই পথ খুঁজে পেতে হবে। মনে হয়, এসব মাথায় রেখেই আমাদের নীতি-নির্ধারকরা ২০২৩-’২৪—এর বৃদ্ধির হার কিছুটা কম করে ধরেছেন। এর ফলে বেসরকারি সংস্থাগুলিও বিনিয়োগে উৎসাহী হবে বলে ধারণা। রেল পরিষেবা, অন্যান্য পরিবহণ, শহর উন্নয়নের পরিষেবা, গ্রামোন্নয়ন এবং আরও অনেক ক্ষেত্রে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত এই বাজেটে ঘোষণা করা হয়েছে। এ সমস্তই নতুন উৎপাদনের পক্ষে অনুকূল।
এই মুহূর্তে আমাদের আশাবাদী হওয়াই ভাল। তাছাড়া কেবল নৈরাশ্য দিয়ে কিছু গড়া চলে না। তবু সেরকম একটি নিরাশার কথা দিয়ে শেষ করা যাক। সরকারি বিনিয়োগের সিংহভাগ যাবে বৈদ্যুতিন পরিষেবার উন্নয়নে। কিন্তু এই পরিষেবা জনসাধারণের কাছে অপর্যাপ্ত পরিমাণে পৌঁছবে কি? ১৪ জানুয়ারির ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ পত্রিকা এই নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। কোভিড লকডাউনের সময় টের পাওয়া গিয়েছিল যে, বহু সাধারণ মানুষের কাছেই স্মার্টফোন নেই। ফলে তাদের ছেলেমেয়েরা অনলাইন লেখাপড়ার ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। একটি ব্যবহারযোগ্য স্মার্টফোনের মূল্য গড়ে ১০ হাজার টাকা। সেই টাকা দেওয়ার ক্ষমতা অধিকাংশ মানুষেরই নেই। মনে রাখতে হবে যে, ২০২১-’২২ সালে বর্তমান পণ্যমূল্যে ভারতের মাথাপিছু আয় ছিল ১ লক্ষ ৭০ হাজার ২২২ টাকা (তথ্যসূত্র: রিজার্ভ ব্যাঙ্ক)। এটা বার্ষিক হিসাব। তাহলে মাসিক মাথাপিছু আয় ছিল ১৪ হাজার ১৮৫ টাকা। মুশকিল হল, এটা সংসারের সকলের মাথাপিছু আয় নয়। আমরা ধরেই নিতে পারি যে, বহু সংসারে আয় এর চেয়ে অনেক কম।
‘দ্য ইকোনমিস্ট’ পত্রিকা অনুযায়ী, ২০২১ সালে ভারতে স্মার্টফোনের বিক্রি বেড়ে হয়েছিল ১৬.১ কোটি। গত বছর সেটি নাকি নেমে গিয়েছিল ১৪.৮ কোটিতে। তাই বৈদ্যুতিন যোগাযোগ ব্যবস্থার যতই প্রসার হোক না কেন, সেই ব্যবস্থা যতক্ষণ না ব্যবহার করার মতো অর্থ মানুষের হাতে আসছে, ততক্ষণ অনেক কিছুই আটকে থাকবে। ভারতের জনসংখ্যা কিন্তু ১০০ কোটির ঢের বেশি। শেষ অবধি হয়তো আয়-বৈষম্যের দিকে কিছুটা ফিরে দেখতে হবে। অর্থনৈতিক বৃদ্ধির সঙ্গে আয়-বৈষম্য দূর করাটাও নিশ্চয়ই প্রয়োজন। তবে সেটা নিয়ে সরকারকে সমালোচনা হয়তো করা যায় না। পৃথিবীর কোনও ধনী দেশ নেই, যেখানে বৃদ্ধির সঙ্গে আয়-বৈষম্য বাড়েনি। অন্তত গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোর ভিত্তিতে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.