Advertisement
Advertisement

Breaking News

নিষ্ঠা তোমার রক্তে

'অপর মা' শাঁওলী মিত্র-কে খোলা চিঠি অর্পিতা ঘোষের।

An emotional open letter to Shaoli Mitra by Arpita Ghosh | Sangbad Pratidin
Published by: Krishanu Mazumder
  • Posted:January 18, 2022 11:39 am
  • Updated:January 18, 2022 11:44 am  

২০০০ সালের শেষ থেকে মৃত্যুদিন পর্যন্ত তোমার সঙ্গে সঙ্গে থেকেছি। আমার জন্মদাত্রী মা বলতেন, ‘শাঁওলী-ই তোকে তৈরি করেছে, বাঁচিয়ে রেখেছে।’ সেই অপর মা শাঁওলী মিত্র-কে (Shaoli Mitra) খোলা চিঠি। অর্পিতা ঘোষ (Arpita Ghosh)

মাম্মু,
যে ঘরটায়, যে খাটে তুমি শুয়েছিলে গত রবিবার অবধি– সেই খাটে বসে তোমাকেই চিঠি লিখছি। মনে পড়ছে, ২০০০ সালের পয়লা জানুয়ারির দিনটা। আমার প্রথম দিন ‘পঞ্চম বৈদিক’-এ। তুমি এসে ঢুকলে একগাল হাসি-মুখ নিয়ে, আমি তো শিহরিত! এই সেই শাঁওলী মিত্র– রেডিওতে যাঁর নাটক শুনে দিনের পর দিন কেটেছে! অবশ‌্য তোমার নামে তখন প্রচুর কথাও শুনেছি– তুমি নাকি অহংকারী, তাই একটু ভয়ও করছিল!

Advertisement

ক্লাস শুরু হল। তোমার হা-হা হাসি– আমার মনে হল, তোমার অনেক বিরুদ্ধ পক্ষ আছে, তারপর পঞ্চম বেদ চর্যাশ্রমে অামার একবছর কাটল– ততদিনে আমি একটু-একটু করে কাজ শিখছি। তারপর ঘটনাচক্রে থাকার জায়গা নিয়ে একটা অসুবিধার মধ্যে পড়লাম। তুমি তৎক্ষণাৎ আমাকে তোমার বাড়িতে জায়গা করে দিলে। সেটা বোধহয় ২০০০ সালের শেষের দিক।

[আরও পড়ুন: প্রয়াত প্রবীণ কার্টুনিস্ট নারায়ণ দেবনাথ! স্রষ্টাহীন বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদারা]

সেই থেকে গত পরশু পর্যন্ত তোমার সঙ্গে সঙ্গে থেকেছি। একসঙ্গে থাকতে-থাকতে কখন যে আমরা মা-মেয়ে হয়ে গিয়েছি, জানতেও পারিনি! মনে আছে মাম্মু, ভাল করে শাড়ি পরতে পারতাম না বলে ‘চণ্ডালী’ নাটকটি করার সময় তুমি আমাকে সারাদিন শাড়ি পরিয়ে রাখতে! তখন বিরক্ত লাগত। পরে বুঝেছি, ওই অভ্যেস তৈরি না হলে আমি অভিনয়টাই করতে পারতাম না।

২০০৬ সালে ‘পশুখামার’ মঞ্চস্থ হওয়ার পরে, ২৫ সেপ্টেম্বর প্রথম সিঙ্গুরে লাঠিচার্জ হয়েছিল বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ‌্যায় ও সিঙ্গুরের অনিচ্ছুক কৃষকদের উপর। তুমি কি অস্থির হয়েছিলে সেদিন? তারপর ২ ডিসেম্বর পুলিশ কৃষকদের খেতে নেমে ধান নষ্ট করে, তাদের মারধর করে। তুমি পরদিনই মঞ্চে দাঁড়িয়ে তীব্র ভাষায় তার প্রতিবাদ জানালে! আমি শিখলাম মৃদুভাষী মানুষের তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর!

আমাদের সময় কলেজে যে-রাজনীতি আমরা করতাম, এত মৃদুভাষ বা শালীন শব্দের প্রয়োগ সেখানে দেখিনি! তুমি আমাকে শিখিয়ে দিলে শিল্পীর প্রতিবাদের ভাষা। তারপর তো কত লড়াই! যেদিন নন্দীগ্রামে তোমার গাড়ির উপর গুন্ডাবাহিনী হামলা করেছিল, আমি সেদিন তোমার সঙ্গে ছিলাম না। খবরটা পেয়ে আমি পাগলের মতো তোমাকে ফোন করছিলাম। তোমার গলা শুনে সেদিন চমকেও গিয়েছিলাম। গলায় ভয়ের লেশমাত্র ছিল না। আমি আবারও চমকিত! মাম্মু, লিখতে বসে না সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে– কত কথা যে লিখতে চাই!

একটা কথা খুব মনে পড়ছে। আমার অ‌্যাপেনডিক্স অপারেশনের কথা। প্রচণ্ড পেটব‌্যথা নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম দুপুরে। তুমি বিকেলে আমাকে শুয়ে থাকতে দেখে সন্দেহ করেছিলে। পেটব‌্যথার কথা জানতে পেরে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে জোর করে নার্সিং হোমে নিয়ে গিয়েছিলে। পরে জেনেছিলাম ডাক্তারের কাছ থেকে, সেদিন যদি আমাকে ভর্তি করা না হত, আমার প্রাণসংশয় হতে পারত। আমার জন্মদাত্রী মা, ২০২১-এর জুন মাসে চলে গেলেন। মা সবসময় বলত, ‘শাঁওলী-ই তোর আসল মা। ও-ই তোকে তৈরি করেছে, বাঁচিয়ে রেখেছে।’

থিয়েটারের কথা কী বলব– সবই তো তোমার কাছে শেখা। ২০০০ সালের পরে তুমি আর থিয়েটার করবে না বলেছিলে। আমাদের কয়েকজনের অনুরোধে তুমি আবার মঞ্চে ফিরলে– ‘রানিকুঠি’-তে নিয়মিত অভিনয়। কী অসম্ভব অসুস্থতা নিয়ে তোমাকে দিনের পর দিন অভিনয় করে যেতে দেখেছি! অবাক হয়ে তোমাকে দেখতাম আর শেখার চেষ্টা করতাম! ‘নিষ্ঠা’ শব্দটা যেন তোমার রক্তের মধ্যে ছিল।

তোমার রিহার্সাল করা, নিজের স্ক্রিপ্টে মার্কিং, নিজেকে তৈরি করার পদ্ধতি– সবই আমি দেখেছি। যদিও আমি তোমার মতো অতটা নিষ্ঠাবান হতে পারিনি। কিন্তু জানো মাম্মু, আমি ‘পঞ্চম বৈদিক’-এর সবাইকে বলি, ‘আমার মতো হওয়ার চেষ্টা করো না, শাঁওলীদির মতো হও।’ কারণ, আমি তো জানি মা, আমার মতো হওয়া তেমন শক্ত নয়, কিন্তু তোমার মতো হতে গেলে আগুনের পথ পেরতে হয়। যা পরিশুদ্ধ করে এক জীবনকে।

গত পরশু সকালে তুমি যখন আমাকে বললে যে, তোমার হাতে আর সময় নেই– তখনও আমি বুঝিনি যে, সেদিনই তুমি আমাদের ছেড়ে চলে যাবে! ক্রমশ সময় এগিয়ে আসছিল আর আমি প্রতি মুহূর্তে মিরাক্‌লের আশা করছিলাম। যখন তুমি বললে, ‘আমাকে যেতে দে, Let me go.’– আমি বুঝলাম তুমি আর থাকতে চাইছ না। তোমাকে কি তোমার বাবা-মা ডাকছিলেন মাম্মু? আর লিখতে পারছি না মাম্মু, খুব কষ্ট হচ্ছে। তোমার শেষ হাসি আর কথা আমি আজীবন মনে রাখব মা গো। কেমন হাসি-মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বললে,
‘যাই তাহলে?’ ভাল থেকো মাম্মু, আর এই মেয়েটাকে পথ দেখিও। অনেক আদর আর ভাল‌বাসা।

তোমার আদরের
সোনা-মা (অর্পিতা)

[আরও পড়ুন: ৩১ মার্চের মধ্যে দলীয় ভোট তৃণমূলের, সভানেত্রী থাকছেন মমতাই]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement