Advertisement
Advertisement

Breaking News

Bangladesh

দুই মিত্র, দুই মেরু

মার্কিন চাপে বাংলাদেশও কি চিনের দিকে ঝুঁকে যাবে?

America is very active in directly influencing the internal affairs of Bangladesh। Sangbad Pratidin
Published by: Biswadip Dey
  • Posted:November 15, 2023 11:16 am
  • Updated:November 15, 2023 11:16 am

বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন যাতে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হয় এবং সর্বোপরি তাতে যেন বিরোধী কণ্ঠস্বর রোধ না-হয়, তাই নিয়ে সরব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এদিকে ‘গণতন্ত্রর স্বার্থে’ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সরাসরি প্রভাব খাটাতে যুক্তরাষ্ট্রর অতিসক্রিয়তা ভারতকে চিন্তিত রেখেছে। আশঙ্কা, বাইডেন প্রশাসনের খবরদারির চাপে বাংলাদেশও শেষমেশ কম্বোডিয়ার মতো চিনের পায়ে না নতজানু হয়! লিখলেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

ব্রিটেনের ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় গত ১০ নভেম্বরের এক প্রতিবেদন শুরু হয়েছে এইভাবে– “বাংলাদেশের কোনও জেলখানায় তিলমাত্র জায়গা আর নেই। শুধুমাত্র গত
দু’-সপ্তাহে প্রায় ১০ হাজার বিরোধী নেতা, কর্মী ও সমর্থককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আগে থেকেই হাজার-হাজার রাজনৈতিক বন্দিতে জেলখানাগুলো বোঝাই। তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে রয়েছে শত শত অপরাধের অভিযোগ। রাজশাহির কেন্দ্রীয় কারাগারে বড়জোর ৪ হাজার জনকে বন্দি রাখা যায়। আজ সেখানে বন্দির সংখ্যা ১৩ হাজার ৬০০!”

Advertisement

হঠাৎ কী এমন হল যে প্রতিবেশী দেশের জেলখানাগুলোয় এমন ‘ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই’ রব? উত্তরটা সংক্ষিপ্ত, বছর ঘুরতে-না-ঘুরতেই যে সে দেশের জাতীয় সংসদের ভোট। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (Sheikh Hasina) টানা চতুর্থবারের জন্য ক্ষমতাসীন হওয়ার লড়াইয়ে অবতীর্ণ। কিন্তু বিরোধীরা চায় ভোটের আগে তিনি সরে যান। ভোট পর্যন্ত একটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার গড়া হোক, অথবা একটা সর্বদলীয় সরকার, যাতে ভোট পরিচালনা নিরপেক্ষ হতে পারে এবং ভোটগ্রহণ হয়ে ওঠে সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ। সরকার ও বিরোধীদের এই টানাপোড়েনে গোটা দেশ অগ্নিগর্ভ। গত ২৮ অক্টোবর বিরোধীদের সমাবেশ হিংসাত্মক হয়ে ওঠার পর দিন থেকে শুরু হয় ব্যাপক ধরপাকড়। জেলখানাগুলো তাই উপচে পড়ছে।

Advertisement

[আরও পড়ুন: ‘কাশ্মীর গাজা নয়’, একদা সমালোচক শেলা রশিদের মুখেই মোদির জয়গান]

নিজেদের দাবিতে বিরোধীদের অনড় থাকার কারণ ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন। প্রথমটিতে বিরোধীরা অংশই নেয়নি। ২০১৮ সালে অংশ নিলেও ভোটের নামে স্রেফ প্রহসন হয়েছিল। কেন্দ্রে কেন্দ্রে বুথে বুথে আগের রাতেই ব্যালট বাক্সগুলো ভরে গিয়েছিল ‘ছাপ্পা’ ভোটে। শাসক দল, নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও পুলিশের সক্রিয় যোগসাজশের সে ছিল এক বিস্ময়কর সিম্ফনি! এবার তা রুখতে বিরোধীরা আদা-জল খেয়ে নেমেছে। মোকাবিলায় কোমর কষেছে শাসক দল। পরিণতি– অশান্তি। প্রতিদিন অবরোধ হচ্ছে। জ্বলছে গাড়ি। প্রতিদিন বিরোধী নেতা-কর্মীরা গ্রেফতার হচ্ছেন। গ্রেফতার এড়াতে অজ্ঞাতবাসে যাওয়ার হিড়িক বেড়েছে। এই মুহূর্তে এটাই বাংলাদেশের দিবারাত্রির কাব্য।

এই কাব্যের এক গুরুত্বপূর্ণ কুশীলব ভারত। প্রতিবেশী এই রাষ্ট্রের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের শরিক। না হয়ে উপায়ও নেই। কেননা বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ভারতের হৃদয়ে। তার ভাল-মন্দ থাকার সঙ্গে আম-দুধের মতো মিশে আছে ভারতের ভাগ্য। হাসিনা থাকলে একরকম, না থাকলে অন্য কথা। ভারত ঘরপোড়া গরু। বাংলাদেশ নিয়ে অদূর অতীতের অভিজ্ঞতা তার ভয়ংকর। কিছুতেই তাই ভারত চায় না পূর্ব সীমান্ত ও গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চল আরও একবার অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠুক। অনিশ্চয়তা ও আশঙ্কার দিনগুলো ফিরে আসুক। অর্থনীতি ও সমাজ টলমলে হয়ে যাক। নষ্ট হোক আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা। হাসিনার থাকা না থাকার সঙ্গে এভাবেই জড়িয়ে গিয়েছে ভারতের ভাগ্য।

[আরও পড়ুন: রাহুল ‘মূর্খের সর্দার’! ভোটপ্রচারে কংগ্রেস নেতাকে তীব্র কটাক্ষ মোদির]

তবে শুধু ভারত নয়, বাংলাদেশের নির্বাচনের সঙ্গে এই প্রথম নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পড়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমি দুনিয়া। ভোট যাতে অবাধ, অংশগ্রহণমূলক, শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠুভাবে হয় সে জন্য তারা নানা চাপ সৃষ্টি করে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রর এই আচরণ ও মনোভাব ভারতের অনুমোদন পাচ্ছে না। কারণ, ভারত মনে করে, যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে এগচ্ছে তাতে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নড়বড়ে হয়ে যাবে, এই অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী ও মৌলবাদী শক্তি ফের ডানা ঝাপটাবে এবং সেই অবসরে ধীরে অথচ নিশ্চিতভাবে প্রভাব বিস্তার করবে চিন। ভারত তো বটেই, যুক্তরাষ্ট্রর পক্ষেও সেই পরিস্থিতি মোটেই সুখের ও স্বস্তির হবে না।
বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের এই ব্যাখ্যা বাইডেন প্রশাসনের মনপসন্দ নয়। তারা মনে করে, গণতন্ত্রর নামে বাংলাদেশে (Bangladesh) শেখ হাসিনা একনায়কতন্ত্র কায়েম করেছেন। মনে করে বলেই তাদের উদ্যোগে আয়োজিত বিশ্ব গণতান্ত্রিক সম্মেলনে বাংলাদেশ ডাক পায় না, অথচ পাকিস্তান পায়! যুক্তরাষ্ট্র এতকাল বাংলাদেশের ভাল-মন্দ ভারতের চোখ দিয়ে দেখে এসেছে। এই প্রথম তারা স্বাধীন মূল্যায়নে অনড়। এক্ষেত্রে অাবার ভারতই তাদের প্রধান বাধা।

কনট্রাডিকশনও এখানেই। ভূ-কৌশলগত রাজনীতিতে এশিয়ায় তো বটেই, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলেরও ভারসাম্য রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান মিত্র ভারত। এই সখ্য দিন-দিন বাড়ছে। চিনের প্রাধান্য রুখতে যুক্তরাষ্ট্রর কাছে ভারত হয়ে উঠেছে ‘ব্যালেন্সিং ফ্যাক্টর’। ভারতকে নিয়ে চতুর্দেশীয় অক্ষ ‘কোয়াড’ গড়ে তোলার মূল কারণও তা। অথচ, ‘গণতন্ত্রর স্বার্থে’ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সরাসরি প্রভাব খাটাতে যুক্তরাষ্ট্রর অতিসক্রিয়তা ভারতকে চিন্তিত রেখেছে। দুই ‘পরম মিত্র’-র অবস্থান এই ক্ষেত্রে দুই মেরুতে। এটা যতটা বিস্ময়ের, ততটাই অবিশ্বাস্য বাংলাদেশ নীতিতে ভারত ও চিনের এক কাতারে দঁাড়িয়ে যাওয়া! চিন খুল্লমখুল্লা হাসিনার সরকারকে সমর্থন করছে। ভারত করছে একটু রেখেঢেকে। যদিও দৃঢ়ভাবে।
দৃঢ়ভাবে করছে বলেই যুক্তরাষ্ট্রর বিদেশমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিনের সঙ্গে ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের বৈঠকে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ প্রবলভাবে উঠে এসেছে। ভারত বোঝাতে চেয়েছে কেন কোনও স্বাধীন সার্বভৌম ও গণতান্ত্রিক দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কারও নাক গলানো উচিত নয়।

বাংলাদেশের ভাগ্য সে দেশের জনগণই তৈরি করবে বলার মধ্য দিয়ে ভারত তাদের বুঝিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র যা করতে চাইছে তাতে হিতে বিপরীত শুধু তাদেরই নয়, গোটা উপমহাদেশকেই দঁাড় করাবে এক অভূতপূর্ব অনিশ্চয়তার মুখে। তাতে নেপো হিসাবে দই খেয়ে যাবে চিন।
ভারতের পক্ষে সবচেয়ে ভাল হত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যদি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতার অভিযোগ না উঠত, যদি তিনি দুর্নীতির রাশ টেনে ধরতে পারতেন এবং আকাশছোঁয়া বাজার দর নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। এই তিন ক্ষেত্রে ব্যর্থতার দরুন সাধারণ মানুষের কাছে হাসিনার জনপ্রিয়তা মারাত্মকভাবে কমে গিয়েছে। সেই হাসিনাকে রাজনৈতিক দিক থেকে সমর্থন করার কারণে বাংলাদেশের অভ্যন্তরের ঐতিহাসিক ভারত বিরোধিতার মাত্রাও বেড়ে গিয়েছে প্রবলভাবে। সামাজিক মাধ্যমে চোখ রাখলে তার ভূরি ভূরি প্রমাণ পাওয়া যায়। জনপ্রিয় ধারণা, ২০১৮ সালের ভোটচিত্রের পুনরাবৃত্তি হবে ২০২৪ সালেও। কারণ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অবাধ ভোট হলে পাশার দান অবধারিত ওল্টাবে। সেই ঝুঁকি হাসিনার দল নেবে না। ভারতও।

যুক্তরাষ্ট্র ব্যর্থ হলে তারা কি অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারির রাস্তায় হঁাটবে? প্রশ্নটি এখনও অমীমাংসিত। পশ্চিমি দুনিয়ায় এই নিয়ে বিতর্ক আছে। আর্থিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের অর্থ– সাধারণ মানুষকে আরও বিপদ ও হাহাকারের মুখে ফেলে দেওয়া। ভিসা নীতির রূপায়ণও কতটা কার্যকর হবে বলা কঠিন। গত জুলাইয়ে কম্বোডিয়ার নির্বাচনেও এমন ভয় দেখিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কিচ্ছুটি করতে পারেনি। ২০১৮ সালে আওয়ামি লিগ যেভাবে সমর্থনের ধস নামিয়ে জিতেছিল, কম্বোডিয়ার শাসক হুন সেনের দল সিপিপি তেমনভাবেই জিতে ক্ষমতা ধরে রেখেছে। সেই সঙ্গে দেশটাকে তারা প্রায় তুলে দিয়েছে চিনের কোলে।

যুক্তরাষ্ট্রর বিরোধিতা করে আসন্ন ভোটে হাসিনার জয়ও কি চিনের পক্ষে তেমন লাভজনক হতে পারে? এই চিন্তা ভারতকে কুড়ে খাচ্ছে। তিস্তার ব্যবস্থাপনা নিয়ে চিনের প্রস্তাবে বাংলাদেশ এখনও চূড়ান্তভাবে ‘হঁ‌্যা’ বা ‘না’ বলেনি। কক্সবাজারে সাবমেরিন ঘঁাটি সম্প্রসারণেও চিন আগ্রহী। সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্র বন্দর স্থাপনের কাজ তাদের হাতছাড়া হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ফেরত পাওয়ার আশা তারা এখনও ছাড়েনি। রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থনের কথা প্রকাশ্যে জানানোর পাশাপাশি অর্থনৈতিক সাহায্যের হাতও যে তারা বাড়িয়ে রেখেছে সে কথা দ্বিধাহীন চিত্তে জানিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত চিনের রাষ্ট্রদূত। ডলার সংকট বাংলাদেশকে খাদের কিনারায় নিয়ে গিয়েছে। মালদ্বীপে ভারত-বিরোধী ও চিনপন্থীরা ক্ষমতায় এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রর চাপাচাপিতে বাংলাদেশও যদি চিনের দিকে ঝুঁকে যায় প্রিয় সখা ভারতকে তাহলে বিনিদ্র রজনী যাপন করতে হবে। এই কথাটাই মার্কিন মুলুককে ভারত বুঝিয়ে চলেছে। কিন্তু তারা বুঝতে পারছে কি?

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ