Advertisement
Advertisement

Breaking News

Human

রাজনৈতিক সচেতনতা ধোঁকার টাটি

রাজনৈতিক উত্তেজনাকে মানবমস্তিষ্ক কেমন করে গ্রহণ করে?

All human decisions are heart driven, says expert

প্রতীকী ছবি

Published by: Biswadip Dey
  • Posted:May 30, 2024 4:06 pm
  • Updated:May 30, 2024 4:07 pm  

রাজনৈতিক উত্তেজনাকে মানুষের মস্তিষ্ক ঠিক কী ধরনের সংবেদনের আকারে গ্রহণ করে, সেই সংক্রান্ত বিবিধ সমীক্ষার নজির ড্রিউ ওয়েস্টেনের ‘দ্য পলিটিকাল ব্রেন’। এই বইয়ের মাধ‌্যমে ওয়েস্টেন জানাচ্ছেন, মানুষের সব সিদ্ধান্তই হৃদয়চালিত, মগজের ভূমিকা সেখানে শূন্য! ভোটরঙ্গই হোক অথবা জীবনের শামিয়ানা, যুক্তি-বুদ্ধির চেয়ে আবেগের সুড়সুড়ি চিরকালই মগজে খেলে বেশি ভালো। লিখলেন ঋত্বিক মল্লিক

মোটামুটি নিশ্চিন্তি আর নির্বিরোধে দিন গুজরান করা সাধারণ মধ্যবিত্তর ঘর এই মুহূর্তে আলো করে রেখেছে নির্বাচনী রঙ্গ। জননেতাদের চোখের পর্দা থাক বা যাক, টিভি থেকে শুরু করে হাতের মোবাইল পর্যন্ত সবরকম পর্দায় চিত্রবিচিত্র হয়ে ফুটে উঠছে রাজনৈতিক কার্টুন, প্রার্থীদের ভাইরাল হওয়া প্রচার-মুহূর্ত, চ্যানেলে চ্যানেলে গোলটেবিল বৈঠকের হঁাকডাক আস্ফালন। দেশের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক উৎসবের প্রস্তুতি থেকে উদ্‌যাপন পর্যন্ত সবটাই মশকরায় মশগুল, আর সেটাই নাকি আমাদের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক সচেতনতার হাতেগরম প্রমাণ! আত্মসমালোচনায় নিমগ্ন হয়ে লাভ নেই, উন্নত থেকে উন্নয়নশীল অবধি সর্বত্রই ছবিটা এক।

Advertisement

যে কোনও দেশের নির্বাচনী পদপ্রার্থীদের চিরকাল ভাবিয়ে এসেছে এই প্রশ্নটাই। মধ্যবিত্তর দাবিদাওয়া নিয়ে কথা বলি তো আমরাই, সাধারণের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে ভাবি তো আমরাই, তবু গড়পড়তা মধ্যবিত্তর প্রথম পছন্দের ঝেঁাকটা বরাবর চলতি হাওয়ার দিকেই কেন? ড্রিউ ওয়েস্টেন, এমরয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজি, সাইকিয়াট্রি এবং বিহেভিয়ারাল সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক, ডেমোক্র্যাট দলের এক স্বঘোষিত হতাশ সমর্থক, নিজের পেশার অলিগলিতে খুঁজতে এসেছিলেন এই প্রশ্নের উত্তর। তঁার বিষয় মূলত ক্লিনিকাল সাইকোলজি, আরও বিশেষভাবে বললে ক্লিনিকাল পলিটিকাল সাইকোলজি। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব কিংবা রাজনৈতিক বিষয়ে জড়িয়ে পড়া নেহাত সাধারণ লোকজনের ব্রেন স্ক্যান রিপোর্ট কাজে লাগিয়ে, একেবারে ফলিত মনস্তত্ত্বর কাঠামোয় ফেলে অসংখ্য তথাকথিতভাবে ‘সফল’ এবং মুখ থুবড়ে পড়ার মতো ‘অসফল’ রাজনৈতিক ক্যাম্পেনের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে ওয়েস্টেন লিখলেন– ‘দ্য পলিটিকাল ব্রেন’। রাজনৈতিক উত্তেজনাকে মানবমস্তিষ্ক ঠিক কী ধরনের সংবেদনের আকারে গ্রহণ করে, সেই সংক্রান্ত বিবিধ সমীক্ষার নজির এই বই।

[আরও পড়ুন: ‘আমাদের শরীরে ক্ষত্রিয়র রক্ত বইছে’, কঙ্গনাকে ‘ছোট বোন’ সম্বোধন যোগীর]

২০০৪ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় ড্রিউ ওয়েস্টেন একটি সমীক্ষা চালান তঁার সহকর্মী স্টিফেন হামান আর ক্লিন্ট কিল্টসের সঙ্গে। এই সমীক্ষা, আজকের নির্বাচনের সময়, হে পাঠক আপনাকে নিয়েও চালানো যায়। দুই পার্টিরই সমান সংখ্যক ‘কমিটেড’ ভোটারের সামনে রাখা যাক কয়েকটা এমন স্লাইড, যাতে একেবারে তথ্য ধরে ধরে দুই পার্টির বিবিধ বদকর্মের খতিয়ান রয়েছে। প্রতি ক্ষেত্রেই স্লাইডে যে-দলের দুর্নীতির কথা বলা আছে, স্লাইড দেখানো হচ্ছে সেই দলের সমর্থকদেরই। স্লাইডের কয়েকটা যুক্তির কাঠামোয় বঁাধা, আর কয়েকটা বেশ মেলোড্রামাটিক আবেগে ভাসানো। এই স্লাইডগুলো দেখার সময় মস্তিষ্ক কীভাবে কাজ করে, তা বোঝার জন্য এদের ব্রেন স্ক্যান করলেন ওয়েস্টেন।

দেখা গেল, পছন্দের পার্টির করা অন্যায় কাজ সামনে আসা মাত্র সক্রিয় হয়ে উঠল আপনার মস্তিষ্ক, অন্যায়কে যে-মুহূর্তে অন্যায় বলে শনাক্ত করে ফেললেন আপনি, শুরু হল যুক্তি আর আবেগের লড়াই। একদিকে রয়েছে প্রিয় দলের প্রতি আপনার পক্ষপাত আর অন্যদিকে বিরোধিতার বয়ানেও রয়েছে অকাট্য যুক্তি, ফলে তৈরি হচ্ছে ‘কনফ্লিক্ট’। এই অস্বস্তি মগজকে এতটাই ‘ডিসট্রেস’-এর মধ্যে ফেলছে যে, নিউরাল সার্কিটে ধরা পড়ে যাচ্ছে সেই সংবেদনা। কিন্তু মস্তিষ্কের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা খুব অদ্ভুত, নানা ডিফেন্স মেকানিজম তৈরি করে সে আপনার পাশে দঁাড়িয়ে লড়ে যাবে। আপনার মগজও বোঝে, যুক্তির দিকে বেশি ঝুঁকতে গেলেই বিপদ। তিক্ত সত্যি হজম করা কষ্ট, ফলে সত্যিকে মিথ্যে বানিয়ে দেওয়ার খেলায় এবার নেমে পড়ে সে। ‘রিজনিং’-এর সার্কিটটিকে মস্তিষ্ক ক্রমশ একেবারে অফ করে দেয়। এই মুছে ফেলার প্রক্রিয়াটি এতটাই দ্রুততার সঙ্গে হয় যে, যুক্তির চিহ্নমাত্র নিশানা পড়ে থাকে না কোথাও। এখন, যে কোনও ক্রিয়ারই একটা বিপরীত প্রতিক্রিয়া তো থাকেই। ফলে, এই মুছে ফেলা ক্রিয়ার বিপরীতে গিয়ে মস্তিষ্ক আর-একটা প্রতিক্রিয়াও তৈরি করে ফেলে। ‘নেগেটিভ ইমোশন’ বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে দ্বিগুণ সক্রিয় করে তোলে ‘পজিটিভ ইমোশন’-এর সার্কিট। ফলে নিজের পছন্দের দল সম্পর্কে আপনার কাছে চারটে খারাপ কথা বলা হলে, প্রথমে আপনি একটু ভড়কে যাবেন ঠিকই, কিন্তু অচিরেই সেসব স্মৃতি স্রেফ মুছে ফেলবে
আপনার মগজ। বরং দলের প্রতি বিশ্বাস আর ভালবাসার তাগিদ বাড়িয়ে তুলবে বহুগুণ। চোখের সামনে সত্যিটা দেখেও এজন্যই আপনি আর বিশ্বাস করতে চান না, কোনটা ভাল আর কোনটা খারাপ। ওয়েস্টেন তাই আপনাকেই বলবেন, ‘পলিটিকাল জাঙ্কি’, রাজনীতির মাদকে আদ্যোপান্ত আসক্ত। নিজেকে সচেতন নাগরিক বলে মনে করেন তো? ওয়েস্টেন কিন্তু দেখিয়ে দিয়েছেন, সবচেয়ে বেশি ‘পলিটিকালি ইনভলভড’ মানুষও জীবনে যত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে, তার মাত্র ০.৩ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত নেওয়া হয় ঠান্ডা মাথায়, পূর্বাপর ভেবে। বাকি ৯৫ থেকে শুরু করে ৯৯.৭ শতাংশ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক চাল কী হতে চলেছে, তা নির্ধারণ করার জন্য একমুখী, ফোকাসড ভাবনাচিন্তার সময় আপনি মোটেই বরাদ্দ করেন না। আপনার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গজিয়ে ওঠে রুটির প্যাকেট কিনতে কিনতে, টয়লেট পেপার আঙুলে জড়াতে জড়াতে, নিবিড় প্যাশনের সঙ্গে পার্টনারকে চুমু খেতে খেতে! এমনকী, ঘুমের মধ্যে আলগা স্বপ্নের ঘোরেও রাজনীতির ঠিক-ভুল, হঁ‌্যা-না, কর্তব্য-অকর্তব্য স্থির করেন আপনি। আবেগ আর যুক্তির এই দ্বিবিধ দ্বন্দ্বকে যদি সেই চিরাচরিত হৃদয় আর মস্তিষ্কের লড়াইয়ের রূপকে ধরার চেষ্টা করি, তাহলে হে ভোটার! আপনার সব সিদ্ধান্তই হৃদয়চালিত, মগজের ভূমিকা সেখানে শূন্য!

[আরও পড়ুন: ভোটের লোভে আমার অসুস্থতা নিয়ে মিথ্যাচার, ‘বন্ধু’ মোদিকে একহাত নিলেন নবীন

ধরা যাক প্রার্থী ‘ক’ এবং ‘খ’ দুই যুযুধান প্রতিপক্ষর প্রতিনিধি। এখন কোনও একটি বিশেষ ইস্যুতে প্রার্থী ‘ক’-এর যে অবস্থান, যুক্তি দিয়ে বিচার করলে তা হয়তো আপনার বক্তব্যর সঙ্গে অনেকটাই মিলে যায়। কিন্তু ঠিক তখনই হয়তো প্রার্থী ‘খ’-কে দেখে আপনার মনে হল, বাঃ, এই ছেলেটি তো বেশ, এর কথাবার্তা, চালচলন সবই ঠিক আমার মনের মতো! তাহলে নির্দ্বিধায় আপনার ভোট পড়বে ‘খ’-এর ঘরেই! ‘ক’-এর হাজার বাস্তবোচিত পদক্ষেপ কিংবা ভবিষ্যৎ আশ্বাস সত্ত্বেও তার দিকে ফিরেও চাইবেন না আপনি। আর মাথা চাপড়ে এ-কথা স্বীকার করতে কসুর করেননি ওয়েস্টেন, ঠিক এই জায়গাটাতেই হেরে বসে আছেন অধিকাংশ চিন্তাশীল রাজনীতিবিদ। আবেগ যেখানে বাজারের পণ্য, তার একচেটিয়া ব্যবসা দিতে হলে মানুষের হাসিকান্নার কঁাচা হিসাব নিপুণভাবে কষতে জানতে হবে, সেখানেই নিহিত জয়ের ফরমুলা।

কোন পদপ্রার্থীকে আপনি বেছে নেবেন, তা নির্ভুল বলে দেওয়ার ঠিক চারটে ধাপ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন ওয়েস্টেন। এক, প্রার্থী যে-দলের হয়ে ভোটে দঁাড়াচ্ছেন, সেই পার্টি এবং তার নীতি সম্পর্কে মোটের ওপর আপনার ধারণাটা ঠিক কেমন। দুই, প্রথম দর্শনে সেই প্রার্থীর সম্পর্কে আপনার কী মনোভাব তৈরি হয়; তিন, খুঁটিয়ে দেখলে সেই প্রার্থীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কোন দিকগুলো আপনার চোখেও পড়ল, মনেও ধরল। যেমন, তাকে আপনি চেনা ছকে ফেলতে পারলেন কি না, তার কথা মেনে নিতে আপনার ইচ্ছা করছে কি না, চক্ষুলজ্জা না রেখেই নিজের ভালবাসা-ঘৃণা-রাগ-বিবমিষার রগরগে চেহারাগুলো সে আপনার সামনে প্রকাশ করছে কি না– মোদ্দা কথা, একদম মেলোড্রামাটিক পটবয়লার ফিল্মের মতো তার ভেতরটা এক্স-রে মেশিন দিয়ে দেখে ফেলার অবকাশ আপনি পাচ্ছেন কি না। ফিরিস্তির একদম শেষ ধাপে, চতুর্থ স্তরে এসে আপনি যাচাই করতে বসবেন, আপনার প্রয়োজনীয় ইস্যুটিতে ওই প্রার্থীর অবস্থান কী। ফলে, আপনার রাজনৈতিক সচেতনতা, ধোঁকার টাটি!

ওয়েস্টেন দেখাচ্ছেন, মানুষের স্বাভাবিক ঝেঁাক থাকে এমন ক্যান্ডিডেটের দিকে, যার মুখ স্বাভাবিক। হঁ‌্যা, মুখ সুন্দর কি অসুন্দর, তার চেয়েও বড় কথা, চেহারায় কোনও বিকৃতি আছে কি না। অর্থাৎ, জননেতার মুখের কোনও অংশ বঁাকা কি না, অসমান কি না, কথা বলার সময় চোখ কঁাপে কি না, কথা বলার সময় বেশিবার ঘাড় নড়ে কি না, লোকটা বেশি গম্ভীর কি না, এ সমস্ত ফিরিস্তি অজান্তেই নথিবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে আপনার মনে। এর একচুল বিচ্যুতিও কিন্তু আপনার ভেতর-মন বরদাস্ত করবে না। সে আপনি বাইরে বডিশেমিং-এর বিরুদ্ধে যতই বড় বড় কথা বলুন, আদতে নানা অছিলায় আপনি তাকে প্রত্যাখ্যান করবেনই। আদর্শ প্রার্থীর চেহারা আপনার কাছে স্টেনসিলের ছঁাচে ফেলা মডেল শরীরের মতো। শুধু বাহ্যিক কাঠামোয় নয়, প্রার্থীর ক্যাম্পেন নিঃসৃত প্রতিটি কথার মধ্যেও আপনি খুঁজে নিতে চাইবেন রূপকথার মতো ওঠাপড়া। হিসাবটা একেবারে মিলে যায় যান্ত্রিক হৃদয়রেখার সঙ্গে। টানা একরৈখিক লাইনে চলা মানেই হেরে যাওয়া, ছিটকে যাওয়া জীবন থেকে। যেখানে উচ্চাবচ নেই, জীবনের হৃৎস্পন্দ সেখানে থেমে গিয়েছে কবেই!

এ বইয়ের মূল প্রতিপাদ্যটাই দঁাড়িয়ে আছে নাকচ করার উপরে। ‘পলিটিকাল ব্রেন’-এর কথা বলতে বসে ছত্রে ছত্রে প্রমাণ করেছেন ওয়েস্টেন– ‘The political brain is an emotional brain’। একেবারে কড়া বাস্তব থেকে তুলে আনা ঘটনার ময়নাতদন্ত করে করে ওয়েস্টেন দেখিয়ে দিচ্ছেন, শেষকথা বলবে মানুষের আবেগ। ভোটরঙ্গই হোক অথবা জীবনের শামিয়ানা, যুক্তি-বুদ্ধির চেয়ে আবেগের সুড়সুড়ি চিরকালই মগজে খেলে বেশি ভাল। যুক্তি রাখা থাকবে শেষের পাতায়। জয়ের হুইসল বাজবে শুধু মলাট দেখেই। নিখাদ সত্যি, পহলে দর্শনধারী। পাঠক, আপনি মানতে না চাইলেও, এই হল আপনার তথাকথিত রাজনৈতিক চেতনার সারাৎসার। ওয়েস্টেন যেভাবে একের পর এক কেস স্টাডি-র মাধ্যমে চুলচেরা খুঁড়ে দেখিয়েছেন রাজনৈতিক ভাবনাচিন্তায় মজে থাকা মানুষের মগজ, পড়লে সত্যিই অবাক হয়ে যেতে হয়। এই প্রপঞ্চময় জগতে সবই যে বিনোদনের সার্কাস, অ্যাড্রিনালিনের ট্রাপিজ, তা এত ভয়াবহভাবে সত্যি প্রমাণ হয়ে গেলে অস্বস্তিতেও পড়তে হয় বইকি!

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement