জীবনের দহন, যন্ত্রণা, আনন্দ, বিষাদের মধ্য দিয়ে না-গেলে কেমন করে শুধু কৃত্রিম বুদ্ধির জোরে একটা প্রাণহীন যন্ত্র লেখক বা সৃষ্টিশীল শিল্পী হয়ে উঠবে? যাপিত জীবন যার নেই, কী করে সে হয়ে উঠবে শিল্পী, করবে সৃজন? এই সূত্রই সম্প্রতি ধরিয়ে দিলেন সলমন রুশদি। প্রসঙ্গ: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কেরামতি। লিখছেন রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়।
‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’, ডাকনাম, ‘এআই’, বাংলা নাম, ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’– এর প্রতাপ, প্রাবল্য, প্রসার উত্তরোত্তর বাড়ছে। এবং বাড়ছে তার স্পর্ধন ও ঔদ্ধত্য। গ্রিকরা এই অমাঙ্গলিক অপগুণকেই চিহ্নিত করেছিল ‘হিউব্রিস’ (hubris) নামে। এবং গ্রিক জীবনদর্শন অনুসারে, ‘হিউব্রিস’ পথ কেটে নিয়ে আসে ‘নেমেসিস’, অনিবার্য প্রাপ্য শাস্তি। খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দাপট এবং প্রভাব এতটাই বেড়েছে এবং ক্রমশ এতই ভয়ংকর হয়ে উঠছে তার বিজয়োল্লাস ও তর্জন, যে, মানুষ বেশ অসহায়, অনিশ্চিত এবং অবদমিত মনে করতে শুরু করেছে নিজেকে। শিক্ষা, বুদ্ধি, প্রতিভাকর্মের যে কোনও ক্ষেত্রে মানুষ যা কিছুই করতে পারুক, ‘এআই’-ও সেসব কাজই করতে পারে, বা অচিরে করতে পারল বলে। এবং শুধু তা-ই নয়। মানুষের থেকে অনেক তাড়াতাড়ি এবং অনেক নিখুঁতভাবে পারবে, প্রতিকূল অবস্থার সমস্ত বাধা পেরিয়ে! এমন একটা সময় আসবে, মানুষের আর কিছু করারই থাকবে না। শাসক এবং নিশ্চিতভাবে শোষকের আসনেও বসবে এহেন অভূতপূর্ব ক্ষমতা এবং বুদ্ধির অধিকারী যন্ত্র! তার কাছে আত্মসমর্পিত অস্তিত্ব মেনে না নিয়ে মানুষের আর উপায় থাকবে না।
কিন্তু সত্যিই কি তা হতে চলেছে? এবং খুব তাড়াতাড়ি? এই প্রশ্নের উত্তর সরাসরি না দিয়ে, একটি সাম্প্রতিক ঘটনার বরং উল্লেখ করা যায়। ঘটনাটি শুরু হোক, পাঁচটা ইংরেজি বাক্যে একটি বিশ্ববিখ্যাত ইংরেজি বইয়ের সূচনা দিয়ে– On the stroke of midnight, as a matter of fact. Clock-hands joined palms in respectful greeting as I came. Oh, spell it out, spell it out; at the precise instant of India’s arrival at independence, I tumbled forth into the world. There were gasps. And outside the window, fireworks and crowds.
এখনকার সলমন রুশদি কিন্তু এই পাঁচটা বাক্য আর এইভাবে লিখবেন না! চেষ্টা করলেও হয়তো পারবেন না। সে-কারণে চেষ্টাও করবেন না। কারণ, তিনি যন্ত্র নন। তাঁর অস্তিত্ব প্রাণহীন নয়। তাঁর জীবন প্রাণময়। রুশদি এই পাঁচটা বাক্য লিখেছিলেন ১৯৮১ সালে। এই পাঁচটা বাক্য তৈরি করেছিল তাঁর “মিডনাইট’স চিলড্রেন”-এর প্রথম প্যারা। এই বই বেরতেই পেল বুকার প্রাইজ। ১৩ বছর পর এই বই-ই পেল বুকার অফ দ্য বুকার্স।
‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ বা ‘এআই’ কি পারবে এমন গদ্য লিখতে? এমন বোধহীন প্রশ্নটি জেগেছে অনেকের মনে। এবং এ-প্রশ্ন লুফে নিয়েছেন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের অসামান্য, অবিশ্বাস্য পারগতার সমর্থক এবং সৃষ্টিকর্তারা। রুশদিও বলে বসলেন, ঠিক আছে দেখা যাক, সত্যিই লিখতে পারে কি না চ্যাটজিপিটি। চ্যাটজিপিটি-র কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে ৪৩ বছর আগের রুশদির গদ্য-স্টাইল নকল করে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে লিখে ফেলেছে ২০০টি শব্দের কয়েকটি প্যারা। সেই লেখা পড়ে রুশদি শুধু মুখ থেকে খসিয়েছেন চারটি শব্দ: ‘আ বাঞ্চ্ অফ ননসেন্স’।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সমর্থকরা জানতে চাইলেন, কেন বলছেন এই লেখা একগুচ্ছ অর্থহীন বাক্যমাত্র? রুশদির উত্তর, শুধু বুদ্ধি দিয়ে কী হবে? নিজস্ব রসবোধ, কৌতুকবোধ, জীবনচেতনা– এসব কোথায়? এসব ছাড়া গভীর সাহিত্য লিখবে কী করে চ্যাটজিপিটি? কৃত্রিম মেধা দিয়ে হয়তো লেখা যায় বাজারি সিনেমার স্ক্রিপ্ট, কিংবা চটজলদি গোয়েন্দা গল্প, কিংবা হালকাপলকা বেস্টসেলার উপন্যাস। কিন্তু মৌলিক এবং গভীরপ্রসারী সাহিত্য রচনা যাপনের অভিজ্ঞতা ছাড়া লেখা যায় না। চ্যাটজিপিটি তো একটা প্রাণহীন যন্ত্র। তার জীবন অভিজ্ঞতা কোথায়?
জীবনের দহন, যন্ত্রণা, আনন্দ, বিষাদ, এই সবকিছুর মধ্য দিয়ে না গিয়ে, কেমন করে শুধু কৃত্রিম বুদ্ধির জোরে একটা প্রাণহীন যন্ত্র লেখক বা সৃষ্টিশীল শিল্পী হয়ে উঠবে? অসম্ভব। যাপিত জীবন যার নেই, যার নেই কোনও যাপিত দুঃখ, কষ্ট, বিচ্ছেদ, যন্ত্রণার স্মৃতি, যার নেই একাকিত্বের যাতনা, অসুখের কাতরতা, মৃতু্যর ভয় বা শোক, কী করে সে হয়ে উঠবে শিল্পী, করবে সৃজন?
রুশদির এই ইঙ্গিত এবং প্রত্যয়ে সন্দেহাতীত সারবত্তা আছেই। এই প্রসঙ্গে তঁার ‘নাইফ’ বইটির কথা না বলে পারছি না। এককথায়, ‘নাইফ’ কোনও মহৎ সাহিত্য নয়। কিন্তু ‘নাইফ’ ছুরির আঘাতে আঘাতে রক্তাক্ত হয়ে যাওয়া একটি মানুষের বিক্ষত শরীর, যন্ত্রণাময় মন, গভীর প্রতিবাদ এবং প্রবল প্রাণশক্তি থেকে উৎসারিত চটি বই। যন্ত্রচালিত কৃত্রিম বুদ্ধি দিয়ে এই বইটির ভাষা ও ভঙ্গির অনুকরণ হাস্যকর প্রহসনে পরিণত হতে বাধ্য। লেবানিজ তরুণ ধর্মীয় আক্রোশ ও প্রতিহিংসাবশত আক্রমণ করে রুশদিকে, চোখে ছুরি মারে! রুশদি এক চোখের দৃষ্টি খুইয়েছেন। আমার মনে পড়ে যায় ক্রিস্টোফার মার্লো-র উপর শুঁড়িখানায় তিন চক্রান্তকারীর আক্রমণ। মার্লোকে খুন করা হয়েছিল ছুরি মেরে-মেরে। এবং তাঁর বাঁ চোখটি উপড়ে নিয়ে। তিনি ডান চোখ দিয়ে দেখতে পেয়েছিলেন হয়তো, তাঁর বাঁ চোখটা পড়ল শুঁড়িখানার টেবিলে প্লেটের উপর। আমি মাঝে মধ্যে ভাবি, মার্লো মরলেন না। বেঁচে থাকলেন। এবং লিখলেন এই ভয়ংকর অভিজ্ঞতার স্মৃতি! সম্ভব কোনও প্রাণহীন, চক্ষুহীন, যন্ত্রণাহীন, চেতনাহীন যন্ত্রের পক্ষে, শুধু বুদ্ধির জোরে, মার্লোর সেই লেখার অনুকরণ? এই ক্রিস্টোফার মার্লো-ই তো গ্রিক সুন্দরী হেলেনের অবিস্মরণীয় মুখশ্রী কল্পনা করে লিখেছেন এক অনির্বাণ কবিতা: ‘দ্য ফেস দ্যাট লঞ্চড্ আ থাউসেন্ড শিপ্স’। মার্লোর কোনও কবিতার সঙ্গে এই কবিতার ভাষা, ভঙ্গি, বিন্যাস, স্টাইল মেলে না। পারবে চ্যাটজিপিটি একইরকম কালজয়ী কবিতা, হেলেনের মুখশ্রী নিয়ে?
স্মৃতির অবদান, মেদুরতার বিষাদ, মনকেমনের যাতনা ছাড়া সম্ভব নয় সৃজন– এই সৃজনদর্শন মিলান কুন্দেরার। চেকোস্লোভাকিয়া তখন কমিউনিস্টদের দখলে। কমিউনিস্ট শাসকরা বলল কুন্দেরাকে, তোমার অতীতকে বিক্রি করে দাও আমাদের কাছে। আমরা তোমাকে দেব এক উজ্জ্বল, কর্মব্যস্ত সংশয় ও প্রশ্নহীন বর্তমান। কুন্দেরা বললেন, আমার সমস্ত মনকেমন ভুলে, আমার সব অতীত বিসর্জন দিয়ে আমি লিখব কী করে? শাসকরা বলল, তোমাকে কে বলেছে লেখক হতে? তুমি প্রশ্নহীন, ভাবনাহীন কর্মী হবে। কুন্দেরা লিখলেন, স্মৃতিই লেখকের একমাত্র ভাণ্ডার, স্মৃতি ছাড়া সৃজনশীল শিল্পী হওয়া অসম্ভব। চেকোস্লোভাকিয়া ছেড়ে কুন্দেরা চলে এলেন প্যারিসে। এবং তাঁর উপন্যাসের মৃগয়াভূমি হয়ে উঠল মনকেমনের তেপান্তর। কোনও চ্যাটজিপিটির প্রাণহীন প্রোগ্রাম করা যান্ত্রিকতায় শুধু তো মানুষেরই পুরে দেওয়া তথ্য আর বুদ্ধির হাঁড়ি। কিন্তু চেতনা ছাড়া কে জ্বালাবে আলো? জীবনদহন ছাড়া কে দেবে এই ভাষা, এই প্রত্যয়, এই যাপনদর্শনের গান? কোনও চ্যাটজিপিটির পক্ষে হওয়া সম্ভব কি যাপনযন্ত্রণায় দহিত রবীন্দ্রনাথ: ‘এই করেছ ভালো, নিঠুর হে,…/ এই করেছ ভালো।।/ এমনি করে হৃদয়ে মোর/ তীব্র দহন জ্বালো।’
রবীন্দ্রনাথের শুধু সন্তানশোকই ধরা যাক। পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিনজন চোখের সামনে মারা গেলেন। দ্বিতীয় কন্যা রেণুকার বিয়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথ জোর করে। তাঁর যক্ষ্মা হল। মারা গেলেন ১২ বছর বয়সে, ১৯০৩ সালে। চার বছর পরে, ১৯০৭ সালে মারা গেলেন রবীন্দ্রনাথের ছোট ছেলে শমীন্দ্র, ১১ বছর বয়সে, কলেরায়। ১৯১৮ সালে যক্ষ্মা হানা দিল আবার, কেড়ে নিল রবীন্দ্রনাথের বড় মেয়ে মাধুরীলতাকে। রবীন্দ্রনাথ লিখলেন:
মানুষের কাছে
যাওয়া আসা ভাগ হয়ে আছে।
তাই তার ভাষা
বহে শুধু আধখানা আশা।
আমি চাই সেইখানে মিলাইতে প্রাণ
যে সমুদ্রে ‘আছে’ ‘নাই’ পূর্ণ হয়ে রয়েছে সমান।
কবিতাটি ১৯১৮ সালে বড় মেয়ে মাধুরীলতার মৃত্যুর পরেই লিখলেন রবীন্দ্রনাথ। কবিতার বিচারে তেমন কিছু নয় হয়তো। চ্যাটজিপিটি হয়তো মুহূর্তে লিখে দেবে এই কবিতার ভাষা ও ছন্দ। কিন্তু কবিতার ভাবটি এক অতল স্পর্শ করছে এই পঙ্ক্তিতে: ‘আমি চাই সেইখানে মিলাইতে প্রাণ’। প্রাণহীন চ্যাটজিপিটি কেমন করে পাবে মৃত্যু পেরিয়ে এই প্রাণ সমুদ্রে ‘আছে’, ‘নাই’-এর দার্শনিক সামীপ্য?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.